যুদ্ধকথা
মরণফাঁদ পেতে পাকসেনাদের খতম করতাম : আবুল হাশেম
সত্তরের নির্বাচনের পরই পেটের দায়ে খুলনার সোনালী জুট মিলে পাড়ি জমান পটুয়াখালী জেলাধীন দুমকি উপজেলার নলদোয়ানী গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাশেম প্যাদা। মেজর আব্দুল জলিলের অধীনে যুদ্ধ করেন ৯ নম্বর সেক্টরে। জীবনের শেষ সময় পঙ্গুত্ব বরণ করা জাতির এ বীর সন্তানের শেষ ভরসা এখন ছোট্ট একটি চায়ের দোকান। সেখানে বসেই একাত্তরের বীরত্বগাঁথা স্মৃতিকথা শুনিয়েছেন এনটিভি অনলাইনকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. নাঈম হোসেন।
যুদ্ধে যাওয়ার ঘটনা বলতে গিয়ে মুক্তি আবুল হাশেম প্যাদা প্রথমেই কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেন তাঁর তৎকালীন কর্মস্থল খুলনার সোনালী জুট মিলের ম্যানেজার মমিন সাহেবকে। যার গ্রামের বাড়ি ছিল ময়মনসিংহে। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘এপ্রিলের এক বৃহস্পতিবারে আমাদের বেশ কয়েকজনকে বাংলোতে ডাকলেন জুট মিলের ম্যানেজার মমিন সাহেব। বললেন, আপনাদের মিলের ডিউটি করা লাগবে না। এখানে ট্রেনিং করতে হবে। সকালে দুই ঘণ্টা ও বিকেলে দুই ঘণ্টা ট্রেনিং করবেন। সপ্তাহ শেষে আমি আপনাদের বেতনের পুরো টাকা দিয়ে দেব। দেশ আক্রান্ত হয়েছে। যেকোনো মূল্যে দেশটাকে রক্ষা করতে হবে। ম্যানেজার সাহেবের কথা মতো পরের দিন থেকেই বাংলোর মধ্যে ট্রেনিং শুরু করলাম। সেখানেই পরিচয় হয় আমাদের দলনেতা কলেজ শিক্ষক সুফিয়ান সাহেবের সাথে। তিনিই আমাদের অস্ত্র চালনা ও যুদ্ধের কৌশল শেখাতেন। আমরা দলে ৮০ জন ছিলাম। হঠাৎ একদিন সুফিয়ান সাহেব বললেন ব্যাংকের ছাদে (বাংলোর কাছের একটি উঁচু বিল্ডিং) বালুর বস্তা নিয়ে যেতে। আমরা সবাই বালুর বস্তা জড়ো করলাম। এরপর তিনি আমাদের পজিশন নিতে নির্দেশ দিয়ে বললেন সামনের রাস্তা দিয়ে পাকিস্তানিদের গাড়ি যাবে। ওরা আসার সাথে সাথে ফায়ার করতে হবে। আমরা প্রস্তুত হওয়ার কিছুক্ষণ পরই দেখলাম খানসেনাদের একটি গাড়ি বহর রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। আমরা দেখার সাথে সাথে ফারারিং শুরু করলাম। প্রথমে ওরা কী করবে বুঝে উঠতে পারেনি। পরে ওরাও পাল্টা গুলি ছোড়া শুরু করল। তবে এর মধ্যেই পাকসেনাদের ২০-২৫ জন খতম হয়ে গেল। ওরা তাড়াহুড়া করে ট্রাকে লাশগুলো ভরে সটকে পড়ল। আমরা তখন ব্যাংক ভবনের পেছন থেকে খাল সাঁতরে রেল লাইনের ফুলবাড়িয়া গেইটে পৌঁছে যাই।’
যুদ্ধে কৌশল প্রয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাশেম বলেন, ‘পাকবাহিনী মূলত আমাদের কৌশলের কাছেই হেরে যায়। আমরা সড়কে সড়কে ফাঁদ পেতে পাকস্তানি সেনাদের খতম করতাম। একেক সময় একেক ধরনের মরণফাঁদ তৈরি করতাম আমরা।’ এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা ফুলবাড়িয়া রেল গেইটে পৌঁছে রাতের আঁধারে রেল লাইন উপড়ে ফেলে ফাঁদ তৈরি করি। যখনই পাকসেনারা রেলগাড়িতে আসত তখনই রেলের বগি ছিটকে পড়ত আর আমরা ফায়ারিং শুরু করতাম। মাথা সমান গর্ত তৈরি করে সেখান থেকে লুকিয়ে গুলি ছুড়তাম আমরা। খুলনা-যশোর রোডে অপারেশন চালিয়েছি আমরা। আমরা রাস্তা কেটে বিশাল গর্ত তৈরি করি। পরে সেই গর্তে কলাগাছ দাঁড় করিয়ে তার উপর প্লাস্টিকের চট বিছিয়ে এমনভাবে রাস্তা তৈরি করি যাতে বোঝা না যায় যে রাস্তার মাঝেই লুকিয়ে বিশাল মরণফাঁদ। পাকসেনাদের গাড়ি বহর রাস্তা পার হতে গেলেই হঠাৎ সামনের গাড়িটি গর্তে পড়ে যেত। আর তখন পেছনের গাড়িগুলো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এদিক সেদিক উল্টে পড়ত। আমরা লুকিয়ে থাকতাম রাস্তার পাশে তৈরি করা ছোট ছোট গর্তে। সেখান থেকেই উপর্যুপরি গুলি ছুড়তাম ওদের ওপর।’
একাত্তরের এই বীর সেনা এ সময় আরো বলেন, ‘সামরিক শক্তি নয় বরং বাঙালি যোদ্ধাদের কৌশলের কাছেই পরাজিত হয় সুপ্রশিক্ষত পাকিস্তানি বাহিনী।’ যুদ্ধের সময়ের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে আবুল হাশেম বলেন, ‘ যুদ্ধ চলাকালে স্ত্রীকে পটুয়াখালী রেখে আসতে রওনা হই। খুলনা শহরে একদল বিহারির হাতে ধরা পড়ে যাই। ওরা আমাকে বিবস্ত্র করে পরীক্ষা করে যে আমি মুসলিম কি না। পরে আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। স্ত্রীকে বাড়িতে রেখে এসে আবার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। ৯ ডিসেম্বর আমি যুদ্ধ শেষ করি।’
জীবনের শেষ সময় কিছু পাওয়ার আছে কি না- এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন প্রায় ৮০ বছর বয়সী আবুল হাশেম। চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হয়েছে। এর চেয়ে বেশি প্রাপ্তি আর কী হতে পারে।’
সব শেষে কী বলবেন? ছোট্ট প্রশ্নের উত্তরটি খুব ছোট করেই দিলেন। বললেন, ‘যুদ্ধ শুরু করেছিলাম জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলে। সব শেষেও বলব জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। জয় হোক স্বাধীন দেশের।’