স্বাধীনতা দিবস
বিদেশি খবরে পাকিস্তানি বর্বরতার খণ্ডচিত্র
বাঙালির মুক্তিযুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলেছিল পাকবাহিনী। তারা বাঙালির ন্যায্য দাবি জানানোর কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে এবং বাঙালির মনে ভীতি সৃষ্টির জন্য নিপরাধ মানুষকে বর্বরোচিত নির্যাতন করেছে, নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে। জ্বালিয়ে দিয়েছে মানুষের ঘরবাড়ি, সম্পদ। এমনই অসংখ্য ঘটনার মধ্য থেকে কয়েকটি ভয়ঙ্কর চিত্র এখানে উপস্থাপন করছি।
আমেরিকার প্রখ্যাত সংবাদ সাময়িকী ‘নিউজউইকে’ ১৯৭১-এর ২৮ জুন প্রকাশিত একটি নিবন্ধে পাকিস্তানি সৈন্যদের বর্বরতার ছবি স্পষ্ট হয়। রিপোর্টটির কিছু কিছু অনুবাদ এখানে যুক্ত করা হলো।
টিক্কা খানের নির্মম হত্যাযজ্ঞ
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের ওপর তাঁর সামরিক বাহিনীর নিষ্ঠুর আচরণের খবর যাতে বাইরের বিশ্বের কাছে না পৌঁছায়। বাঙালিরা তাদের স্বাধীনতার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। পূর্ব পাকিস্তানে বিদেশি সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। করাচির সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস লন্ডনে সানডে টাইমসের জন্য লিখতেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা দেখে এতটা মর্মাহত এবং ভীত হয়েছিলেন যে, পুরো সংবাদ প্রকাশ করতে তার পরিবার নিয়ে লন্ডনে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি লেখেন, ঢাকায় তাকে বারবার পাকিস্তানি সামরিক এবং বেসামরিক কর্তৃপক্ষ বলেছে, তাদের অভিপ্রায় হচ্ছে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নির্মূল করা। এতে ২০ লাখ মানুষ নিহত হতে পারে। এটা ছিল এক ভয়ঙ্কর ঘটনা।
পাকবাহিনীর নৃশংস ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নিউজউইকের টনি ক্লিফটন যুদ্ধকালীন ভারতের শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। তিনি তাঁর প্রতিবেদনে লেখেন—
‘যে কেউ বা যারা ভারত সীমান্তে শরণার্থী শিবিরে গিয়েছে তারা বিশ্বাস করবে যে, পাঞ্জাবি সেনাবাহিনী যেকোনো জঘণ্য কাজ করতে পারে। আমি গুলিবিদ্ধ শিশু এবং অনেক লোকের পিঠে চাবুক মারার ক্ষত চিহ্ন দেখেছি। আমি অনেককে বাকরুদ্ধ অবস্থায় দেখেছি। কেউ কেউ বাকরুদ্ধ হয়েছে স্বচক্ষে সন্তানদের হত্যার দৃশ্য দেখে। পাকিস্তানি সৈন্যরা অনেকের চোখের সামনে তাদের মেয়ে কিংবা স্ত্রীকে ধর্ষণ করেছে। এই দৃশ্য দেখে তারা নির্বাক হয়েছে। আমার ধারণা, এই সংখ্যা ১০০ হবে। পূর্ব পাকিস্তানে এর চেয়েও অনেক বেশি। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিস্মিত হই। আমি নিজেই সেই ভয়াবহ দৃশ্য দেখতে অস্বস্তিবোধ করি। কিন্তু তারপরও দাঁড়ালাম। এ রকম হত্যাকাণ্ডের মধ্যে কীভাবে একজন মানুষ নিজেকে সামলাতে পারে তা ভেবে আমি আশ্চর্য বোধ করি।’
পশুর মতো জবাই : একটি ছোট বালিকার গল্প বলছি। তার পরনে ছিল ছেঁড়া লাল-গোলাপি রঙের পোশাক। সে কারো জন্য কোনো ক্ষতির কারণ ছিল না। কৃষ্ণনগরের একটি হাসপাতালে আমি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। অন্যান্য রোগীর সঙ্গে সেও সেখানে আছে। তার ঘাড়ে ক্রুদ্ধ কারো নিষ্ঠুর আঘাত যা সে ঢেকে রেখেছে। একজন পাকিস্তানি সেনা বেয়োনেট দিয়ে তার গলনালি কেটে দিয়েছে। সে জানায় তার নাম ইসমত আরা। মৃত ইসহাক আলীর মেয়ে। সে আমাকে জানাল, আমার বাবা কুষ্টিয়ায় ব্যবসা করত। প্রায় দুই মাস আগে সে আমাদের বাড়ি থেকে তার দোকানে যায় এবং এরপর তাকে আমি আর দেখিনি। ওই রাতে বিছানায় যাওয়ার পর আমি চিৎকার এবং কান্না শুনলাম। আমি সেখানে কী ঘটছে তা দেখতে গেলাম। সেখানে পাঞ্জাবি সেনারা ছিল। আমার চার বোন মেঝেতে মৃত অবস্থায় পড়ে আছে এবং আমি দেখলাম আমার মাকে তারা হত্যা করেছে। আমি সেখানে থাকা অবস্থাতেই তারা আমার ভাইকে গুলি করে। আমার ভাই বিজ্ঞানে স্নাতক পড়ছিল। এরপর একজন সৈন্য আমাকে দেখল এবং আমাকে তার ছুরি দিয়ে আঘাত করল। আমি মাটিতে পড়ে গেলাম এবং মৃতের ভান করলাম। যখন সেনারা চলে গেল তখন আমি দৌড়ে গেলাম এবং এক লোক আমাকে বাইসাইকেলে উঠাল এবং এরপর আমি এখানে আসি।
আমি তাকে বললাম, তুমি সম্পূর্ণ ঠিক আছ। তুমি এখানে নিরাপদ। কিন্তু আমি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম— সত্যিকারে তার কী হবে? কী হবে তার মতো ছেলেমেয়ে এবং নারী-পুরুষদের যারা তাদের অগ্নিদগ্ধ গ্রাম থেকে পালিয়ে এসেছে। ওই আগুনের স্ফূলিঙ্গ আমি পূর্ব পাকিস্তানের আকাশে দেখতে পাই। ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার একটি হাসপাতাল সীমান্ত থেকে অর্ধেক মাইল দূরে। এই হাসপাতাল ইতিমধ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়েছে এমন লোকদের দ্বারা পরিপূর্ণ। সেখানে চার বছরের একটি বালক আছে যার পাকস্থলি বুলেটবিদ্ধ হয়েছে। এক মহিলা জানাচ্ছিল, কীভাবে তার চোখের সামনেই তার দুই সন্তানকে পাক সেনারা গুলি করে হত্যা করেছে। এরপর তারা তাকে গুলি করে। তার কোলে ছিল ছোট ছেলে। গুলিটি তার সন্তানের নিতম্ব ছিন্ন করে তার নিজের বাম বাহুতে বিদ্ধ হয়েছে।
আমি এরপর মেঝেতে শুয়ে থাকা দুটি বালকের কাছে গেলাম। তারা বানরের মতো একে অপরকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। ডাক্তাররা জানালেন, তাদের বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। দুজন বাদে তার পরিবারের সবাই নিহত হয়েছে। তারা এখানে তিনদিন ধরে আছে। কিন্তু তাদের পরিচয় সম্পর্কে আমি জানি না। তারা এত ভীত ছিল যে, কথা বলতে পারছে না। তারা কেবল একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। যদি খাওয়ার জন্য তাদের ডাকা হয় তাহলেও তাদের উঠানো যায় না। এটা বলা কঠিন যে, তারা কখন কথা বলতে পারবে এবং কখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সির কংগ্রেসম্যান করনেলিয়াস গ্যালঘার যিনি আগরতলার এই হাসপাতাল পরিদর্শন করেছিলেন। তিনি ভারতে এসেছিলেন এই জন্য যে, নৃশংসতার দৃশ্য বাড়িয়ে বলা হচ্ছে কি না তা দেখতে। কিন্তু যখন তিনি নিজে আহতদের অবস্থা দেখলেন তখন তার কণ্ঠস্বর নিচু হয়ে গেল। তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই সৈনিক আমাকে বললেন, আমি ফ্রান্সের নরম্যান্ডিতে হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য দেখেছি। যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে নৃশংস স্থান ছিল। কিন্তু এখানকার চেয়ে ভয়াবহ দৃশ্য আমি কখনো দেখিনি। কান্নার এই দৃশ্য আমার সমস্ত শক্তি কেড়ে নিয়েছে।
ধর্ষণ : প্রথম দিকে অন্যান্য বিদেশিদেরও নৃশংসতার ঘটনা নিয়ে সন্দেহ ছিল। কিন্তু বিভিন্ন উৎস থেকে তাদের কাছে বারবার একই তথ্য আসায় তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে। ব্রাইটন জন হেস্টিংস গত ২০ বছর ধরে বাংলায় বাস করছেন এবং তিনি একজন খ্রিস্টান। তিনি আমাকে বললেন, সেনারা শিশুদের আকাশে ছুঁড়ে মেরেছে এবং ওই শিশুরা তাদের বেয়োনেটের ওপর পড়েছে। আমি দেখেছি, সেনারা মেয়েদের ধর্ষণ করেছে এবং পরে তাদের হত্যাও করেছে। হত্যার আগে তারা মেয়েদের দুই পায়ের মাঝখানে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়েছে।
এসব ভয়াবহ ও নৃশংস দৃশ্য দেখে মনে হলো, পাকিস্তানি সেনারা রক্তের খেলায় মেতে উঠেছিল। অথবা তার চেয়ে আরো বেশি কিছুর দ্বারা উৎসাহ পেয়েছিল। তারা বাঙালিদের বিরুদ্ধে হিংস্র গণহত্যা চালিয়েছিল। আর এর স্থপতি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান। অনুমান করা যায়, পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটছে সেই বিষয়ে কিছু জানতেন। কিন্তু তিনি হয়তো অনুধাবন করতে পারেননি যে, শিশুদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। মেয়েরা যৌন দাসত্বের শিকার হয়েছে এবং সম্পূর্ণ পরিবারকে হত্যা করা হয়েছে। ইয়াহিয়া খান সামরিক গভর্নরকে বিদ্রোহীদের দমনের নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং টিক্কা খান সেটা খুব দক্ষতা এবং নিষ্ঠুরতার সঙ্গে পালন করেছিলেন, এর ফলে পূর্ব পাকিস্তান এখনো নামেমাত্র পাকিস্তানের অংশ হিসেবে আছে। কিন্তু গত তিন মাসে পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিমাদের ভয়াবহ এবং নৃশংস অত্যাচার এই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, পাকিস্তানের দুই অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। আর এই দুই দেশের ভাঙন অবশ্যম্ভাবী। তবে আহত ও নির্যাতনের শিকার বর্তমানের শিশুরা বড় হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত স্মরণ করবে তাদের দেশ টিকিয়ে রাখতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কী নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ছিলেন।
পাক সৈন্যদের নির্মমতা
মার্চ মাসে পুরান ঢাকার হিন্দু প্রধান এলাকা শাখারী বাজারে পাক বর্বরতার একটি চিত্র প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে জানা যায়—“...শাখারী বাজারের প্রতি ঘরে প্রবেশ করলাম—দেখলাম মানুষের লাশ, নারী-পুরুষ, যুবক যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, বালক-বালিকা, কিশোর, শিশুর বীভৎস পচা লাশ...মেয়েদের অধিকাংশ লাশ আমি সম্পূর্ণ উলঙ্গ দেখলাম, দেখলাম তাদের বুক থেকে স্তন তুলে নেওয়া হয়েছে। কারো কারো যোনি পথে লাঠি ঢোকানো আছে। বহু পোড়া ভস্ম লাশ দেখেছি।” “পাকিস্তানি বাহিনী দোসরদের সহায়তায় বা এককভাবে সাধারণ মানুষের ওপর ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, বয়স নির্বিশেষে যে নৃশংস হত্যা, নির্যাতন, নিপীড়ন, চালিয়েছিল তার ধরন ছিল যেমন জবাই করে হত্যা, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, ফাঁস লাগিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে, জীবন্ত মানুষকে মাটিচাপা দিয়ে, দীর্ঘ সময়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়ে, শিশুদের টুকরো করে, শিশু থেকে বৃদ্ধা নারীদের ওপর বিভিন্ন প্রকৃয়ায় বিকৃত যৌন লালসায় দগ্ধ করে পরিশেষে হত্যা করেছে।” (ডা. এম. এ. হাসান, যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ, ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি, ২০০১)
পাকবাহিনীর বর্বরতার এমন বিভৎস চিত্র দেশজুড়ে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস প্রত্যক্ষ করা গেছে। এসব চিত্রের উন্মোচন হলে মানতেই হবে ১৯৭১-এ বাঙালির মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের হত্যাযজ্ঞ পৃথিবীর বিভৎসতম গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।
লেখক : অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।