রাজীবের দ্বিখণ্ডিত হাত : দায় কার?
সকালে ঘুম থেকে উঠেই পত্রিকার পাতায় চোখ আটকে গেল একটি সংবাদ দেখে। দুটি গাড়ির মাঝখানে আটকে আছে একটি দ্বিখণ্ডিত, সংরক্ত হাত, ২১ বছর বয়সী কলেজছাত্র রাজীব হাসানের হাত। অভাগাই বলব বেচারাকে, অভাগা জন্মের পর থেকেই। পিতা-মাতা কেউ-ই নেই। সামনে এগোনোর জন্য একমাত্র পথ ছিল লেখাপড়া। আত্মীয়স্বজনদের সহৃদয় সহযোগিতায় সে পথেই এগোচ্ছিলেন তিনি। নিজেই পড়ছিলেন শুধু তাই নয়, একটি অফিসে কম্পিউটারে টাইপিং করে খরচ চালাতেন নিজের, ছোট দুই ভাইয়ের। তার মাঝেই বাধা হয়ে দাঁড়াল কালকের এই ঘটনা; মর্মস্পর্শী, বেদনাদায়ক তো বটেই।
প্রতিদিনের মতো বাসে করেই যাচ্ছিলেন কলেজে। সেটিই কাল হয়ে দাঁড়াল তাঁর জন্য। খবরে লিখেছে যে, তিনি বাসের দরজার কাছে একটা হাত বের করে ঝুলে ছিলেন। আর সে সময় আরেকটা বাস ওভারটেকিং করতে গিয়ে ঘেঁষা দেয় রাজীব হাসান যে বাসে অবস্থান করছিলেন, সেই বাসে। এবং দুই বাসের প্রবল চাপে রাজীব হাসানের একটা হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে শরীর থেকে। কতটা কষ্ট পেয়েছিলেন অ্যানেসথেশিয়াবিহীন হাত কর্তনে। তার চেয়ে বেশি কষ্ট যে পেয়েছেন হাত হারিয়ে, কর্মক্ষমতা হারিয়ে তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। হয় তো ভাবছেন, নিজের ভবিষ্যৎ যেমন অন্ধকার হয়ে গেল, তেমনি করে অন্ধকার হয়ে গেল তাঁর অন্য দুই ভাইয়ের ভবিষ্যৎও। কারণ, তাঁর ওপরই তো নির্ভরশীল তাঁর অন্য দুটি ভাই।
বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তকমা পেয়েছে, চারদিকে তার আনন্দে টেকা ভার। কিন্তু সিরিজ ধর্ষণ আর আর নানা সামাজিক অব্যস্থাপনা ও বৈকল্যের মাঝে রাজীব হাসানের হাত হারানোর মর্মান্তিক ঘটনা কি আমাদের উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে, না পেছাবে? উন্নয়ন বিশ্লেষকরাই এ বিষয় ভালো বলতে পারবেন। কিন্তু রাষ্ট্র কি এই হাত ফেরত দিতে পারবে, পারবে কি দায় এড়াতে?
রাজীব হাসান যে বাসে ছিলেন, সে বাসটি ছিল বিআরটিসির, রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থার। আর অন্য বাসটি ছিল ব্যক্তি মালিকানাধীন। তাহলে রাজীবের হাত হারানোর জন্য কে দায়ী হবে? সরকারি এই পরিবহন সংস্থা? নাকি ব্যক্তিমালিকানাধীন বাসের মালিক? এই প্রশ্ন করতে গেলে আমাদের নজর দিতেই হবে যে আসলেই কি বিআরটিসির ওই বাস রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থা দ্বারা পরিচালিত হচ্ছিল, না অন্য কেউ লিজ নিয়ে বা ভাড়ায় চালাচ্ছিল? কারণ বিআরটিসির যেসব বাস ঢাকার রাস্তায় চলে, তার অধিকাংশই একটি শ্রেণি বিআরটিসির কাছ থেকে দৈনিক নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার বিনিময়ে ভাড়া নেয়। যাঁরা এসব বাস চালান তাঁরা কি দক্ষ? বা তাদের কি গাড়ি চালানোর বৈধ কাগজপত্র আছে?
যে পরিমাণ যাত্রী ওঠার কথা, তার চেয়ে দুই গুণ, মাঝেমধ্যে তারও বেশি যাত্রী বহন করে বিআরটিসির এই বাসগুলো। এই কারণেই রাজীব হাসানদের বাধ্য হয়ে ঝুলে থাকতে হয়, আর হাত হারাতে হয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থা হিসেবে বিআরটিসির উচিত ছিল সংস্থার সকল বাস সংস্থার নিয়ন্ত্রণে রেখে চালানো এবং তা অবশ্যই দক্ষ ও লাইসেন্সপ্রাপ্ত ড্রাইভারের মাধ্যমে। কিন্তু ফিটনেস ও অব্যবস্থাপনার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থার পরিবহনগুলোয় যে ড্রাইভাররা গাড়ি চালান, তাঁরাও অদক্ষ ও লাইসেন্সহীন।
এর পরও কেন প্রতিবছর রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটি লসের কবলে পড়েই চলেছে, লাভের মুখ দেখছে না? ধরা যাক যেখানে বিআরটিসির একটি বাসে ১০ জন যাত্রী চড়ার কথা, সেখানে চড়ছে দ্বিগুণ, ২০ জন। তাহলে প্রতিবছর কীভাবে বিআরটিসির কোটি কোটি টাকা লোকসান হয়? প্রশ্ন করা যাবে, সদুত্তর পাবেন না। উত্তর পাবেন রাজীব হাসানের হাত হারানোর মধ্য দিয়ে। দুঃখজনক।
বাংলাদেশের অন্যান্য ব্যবস্থার মতো সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার অবস্থা খুবই বেহাল, দেখার যেন কেউই নেই। কিন্তু এই ব্যবস্থাটিই সবচেয়ে গতিশীল, সুব্যস্থাপনাময় হওয়া উচিত ছিল, একটি দেশের উন্নতির জন্য। কিন্তু হয়নি, ক্রমবর্ধমান এই জনসংখ্যার ঢাকাতে এটা কি কোনোদিন সম্ভব হবে? যেখানে মানুষ বাড়ছে জ্যামিতিক হারের চেয়েও বেশি হারে। ফলে ট্রাফিক জ্যাম একটি নিত্যবিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে নাগরিক জীবনে। ধ্বংস হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার কর্মঘণ্টা! সবাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে এই ট্রাফিক জ্যামে।
আর এই পরিস্থিতি কেউ ঢাকার রাস্তায় গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা না থাকলে বুঝতে পারবে না প্রকৃত অবস্থা। কে যে কোন পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে, আর কে যে কখন কার গাড়িতে ধাক্কা দিচ্ছে, আর কে যে হরহামেশাই লেন পরিবর্তন করছে সবকিছুই বড়ই ভৌতিক ঠেকবে একজন নতুন চালকের কাছে, যে ঢাকাতে প্রথম গাড়ি চালাচ্ছে। আর এর ফলে রাজীব হাসানদের হাত হারানোটা ত্বরান্বিত হচ্ছে।
বেপরোয় গতি মহাসড়কে যেমন মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে, তেমনি করে ঢাকা শহরেও বেপরোয়া গতি দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ। আর ওভারটেকিংয়ে তো আছেই। ওভারটেকিংয়ের বিষয়টা মাত্রা যেন ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। ওভারটেকিংয়ের সময় ড্রাইভাররা কোনো ধরনের খেয়াল রাখে না মাথায়, উন্মাদের মতো ছোটে। আর এই ওভারটেকিংয়ের জন্য কোনো ধরনের শাস্তি তো নেই-ই, সঙ্গে সঙ্গে এগুলো দেখার জন্য কেউ কি আছেন? কখনই কারো চোখে পড়েছে কি, যে প্রশাসনের মাধ্যমে ওভারটেকিংয়ের তদন্ত বা দেখভাল হচ্ছে? যদি হতো তাহলে কি আজ রাজীব হাসানরা ওভারটেকিংয়ের বলি হয়ে হাত হারাতেন?
ঢাকায় ট্রফিক পুলিশ কাজ করে না? নাকি ড্রাইভাররা ট্রাফিক আইন মেনে চলে না? নাকি দুই পক্ষের মধ্যেই সমন্বয়ের অভাব? ট্রাফিক পুলিশ বিভাগই নিয়ন্ত্রণ করে ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থা। ফলে কালকের ঘটনার জন্য দায় কি ট্রাফিক পুলিশের ওপর বর্তাবে? ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের যে জনবল আছে, তা দিয়ে কি আদৌ এই মেটাসিটির ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব? আসলেই সম্ভব না। তাই রাজীব হাসানদের নিয়তই হাত হারাতে হয়, হবে।
এবার আসি অন্য প্রসঙ্গে, কোর্ট-কাচারির বিষয়ে। দুটি বাসের মালিককে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন, রাজীব হাসানের হাতের ক্ষতিপূরণ হিসেবে টাকা দিতে। টাকায় কি সব মিটে যায়। মিটে যায়, এ ভূমিতে, যেখানে টাকা দিয়ে মাপা হয় হাতের মূল্য! কিন্তু এ দুটি বাসের ড্রাইভারের বা মালিকের কি কোনো বিচার হবে না? নাকি বিচার চাইতে গেলে ধর্মঘটের ডাক দিবে পরিবহন মালিকরা? যেমনটা দেখলাম মিশুক মুনীর ও তারেক মাসুদের বিচারের বেলায়, ধর্মঘট আর টাকাতেই বিচার হল, আসামি খালাস পেল। আর কত এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি? কত দিন চলবে এমন পরিস্থতি, পরিবহন ব্যবস্থায়? গণপরিবহনে জনগণ কি স্বস্তিতে চলাফেরা আর কোনোদিনই করতে পারবে না? উন্নয়নের এই জোয়ারে, বাংলাদেশের জনগণ কি চাইতে পারে না একটি স্বস্তিকর গণপরিবহন ব্যবস্থা। এই আশা আমরা রাখতেই পারি, স্বাধীন, সার্বভৌম এবং উন্নয়নশীল দেশের মানুষ হিসেবে।
অনেক রক্তের বিনিময়ে এই দেশ। স্বাধীন দেশেও রক্তের ধারা বন্ধ হয়নি। নানাভাবে রক্ত ঝরছে, যেমন কালকের বাসের রক্তের কথাই ধরা যাক। আর যেন রাজীব হাসানের মতো কেউ হাত না হারায়, আর যেন রক্ত না ঝরে, তার জন্য যেন সরকার গ্রহণ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সাধারণ মানুষ এমনটাই চাচ্ছেন, এর বেশি না। নিরাপদ ও স্বস্তিকর একটি গণপরিবহন ব্যবস্থা এখন সময়ের দাবি। সরকার সেটা পূরণ করবেন, সেই আশাবাদ আমরা রাখতেই পারি।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়