প্রতিক্রিয়া
শিক্ষকদের কর্মকাণ্ডে শিক্ষার্থীরা লজ্জিত
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা জাহাঙ্গীরনগরের পাশ দিয়ে যখন যাতায়াত করতাম, তীর্থের কাকের মতো চেয়ে থাকতাম ক্যাম্পাসের দিকে। কত জল্পনাকল্পনা উঁকি দিত মনে! কখনো কি ঢোকার যোগ্যতা হবে এর গেট দিয়ে! কত মহান মানুষেরা জানি থাকে এখানে! ক্লাসে-আড্ডায় কত জ্ঞানগর্ভ আলোচনা তাঁরা করেন! তাঁদের চালচলন-কথাবার্তা সবকিছু নিশ্চয় ভিন্ন ধরনের। কত বড় মানুষদের সঙ্গে কথা বলার, প্রশ্ন করার, আড্ডা দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন এখানকার শিক্ষার্থীরা! আরো কত ধরনের কল্পনা! সে ছিল এক স্বপ্নময় ঘোরের সময়।
প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যে করেই হোক কোনো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট দিয়ে ঢোকার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। ফলে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য দৈনিক ১৪-১৫ ঘণ্টা পড়াকেও কঠিন মনে হয়নি। পড়ালেখার ক্ষতি হবে ভেবে দুই ঈদে ঢাকা থেকে বাড়ি যাইনি।
কয়েক মাসের দীর্ঘ সংগ্রাম তারপর পাঁচটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেলাম দুটিতে। জাহাঙ্গীরনগরে ভর্তি হলাম। তখনো আহমদ ছফার 'গাভী বিত্তান্ত' বইটি পড়িনি। বইটা পড়লাম ফার্স্ট ইয়ারে ক্লাস শুরু হওয়ার কিছুদিন পর।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছত্রে ছত্রে, প্রতিটি কোণে কোণে যেসব ভয়ংকর নোংরামির চর্চা হয়, গল্পে গল্পে তার বর্ণনা দিয়েছেন ছফা। বইটি পড়ার পরও মোহভঙ্গ হয়নি। ভেবেছি এটা হয়তো কেবলই গল্প। ছফা বাড়িয়ে লিখেছেন। কিংবা হতে পারে এটা ছফার সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র। এখন নিশ্চয়ই পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছু।
কিছুদিন ক্লাস করার পর বিশ্ববিদ্যালয়কে বুঝতে শুরু করলাম কিছু কিছু। হলে উঠতে গিয়ে অভিজ্ঞতা হলো আরো অনেক কিছুর। যা কিছু কল্পনা করেছিলাম, তার কিছুই যে নেই তা নয়। তবু মোহভঙ্গ হতে থাকল প্রতিদিন।
ফার্স্ট ইয়ার শেষে যখন ক্যাম্পাস সাংবাদিকতায় যুক্ত হলাম, তখন জানতে শুরু করলাম এমন সব বিষয়, যা একজন সাধারণ শিক্ষার্থী জানতে পারেন কদাচিৎ। নানা কারণে একজন সাংবাদিকের পক্ষেও সেসবের খুব কম অংশই লেখার সুযোগ হয় পত্রিকায়।
শ্রদ্ধা বাড়তে থাকল ছফার সাহিত্যিক সত্তার প্রতি। এত নিপুণভাবে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হালচাল তুলে ধরতে পারেননি কেউ। এখানে সব দিক নিয়ে আলোচনা সম্ভব নয়। শিক্ষক রাজনীতির নোংরা দিকটা নিয়েই কথা বলি!
ছফা তাঁর উপন্যাসের শুরুর দিকে এক জায়গায় লিখেছেন, 'সকলের দৃষ্টির অজান্তে এখানে একের অধিক হনন কারখানা বসেছে, কারা এন্তেজাম করে বসিয়েছেন সকলে বিশদ জানে। কিন্তু কেউ প্রকাশ করে না। ফুটন্তে গোলাপের মতো তাজা টগবগে তরুণরা শিক্ষক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার পর হনন কারখানার ধারেকাছে বাস করতে করতে নিজেরাই বুঝতে পারেননা কখন যে তারা হনন কারখানার কারিগরদের ইয়ারে দোস্তে পরিণত হয়েছেন। তাই জাতির বিবেক বলে কথিত মহান শিক্ষকদের কারো কারো মুখমণ্ডলের জলছবিতে খুনি খুনি ভাবটা যদি জেগে থাকে তাতে আঁতকে ওঠার কোনো কারণ নেই। এটা পরিবেশের প্রভাব। তুখোড় শীতের সময় সুঠাম শরীরের অধিকার মানুষের হাত-পাগুলোও তো ফেটে যায়।'
“একজন তরুণ শিক্ষককে কোনো ছাত্রাবাসের আবাসিক শিক্ষকের রদ্দি মার্কা কাজটি পেতেও জুতোর সুখতলা ক্ষয় করে ফেলতে হয়। কোনো শিক্ষক যখন অবসর নেন, তার বাসাটি দখল করার জন্য শিক্ষকদের মধ্যে যেভাবে চেষ্টা তদবির চলতে থাকে, কে কাকে ল্যাঙ মেরে আগে তালা খুলবে সেটাও একটা গবেষণার বিষয়বস্তু হয়ে উঠতে পারে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে 'বিনা যুদ্ধে নাহি দেগা সূচাগ্র মেদিনী' এটা একটা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
আরেক জায়গায় লিখেছেন, ‘অতীত গৌরব গরিমার ভার বইবার ক্ষমতা বর্তমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই। সাম্প্রতিককালে নানা রোগব্যাধি বিশ্ববিদ্যালয়টিকে কাবু করে ফেলেছে। মাছের পচন যেমন মস্তক থেকে শুরু হয়, তেমনি যাবতীয় অসুখের জীবাণু শিক্ষকদের চিন্তা-চেতনায় সুন্দরভাবে স্থান করে নিয়েছে।... এখন শিক্ষক সমাজ বলতে কিছু নেই। আছে হলুদ, ডোরাকাটা, বেগুনি এসব দল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতা কব্জা করার জন্য দলগুলো সম্ভব হলে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হতো। মাঠ এবং রাস্তা ছাত্ররা দখল করে রেখেছে বলে শিক্ষকদের লড়াইটা স্নায়ুতে আশ্রয় করে নিয়েছে।’
এই কয়েকটি কথায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ক্ষমতালিপ্সু নোংরা রাজনীতির একটা মোটামুটি চিত্র পাওয়া যায়।
ছফা আশঙ্কা করেছেন যে, সম্ভব হলে শিক্ষকরা সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হতেন। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ছফা দেখে যেতে পারেননি—বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা ইতিমধ্যেই তার নজির স্থাপন করে ফেলেছেন।
ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে নিজ দলের শিক্ষকদের মধ্যেই হাতাহাতি, ধস্তাধস্তি রীতি হয়ে উঠছে। যেটা ছফার সময়ে ছিল না।
গত ৩ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের দুটি পক্ষ হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন। একে অপরকে লাথি দেন, চেয়ার দিয়ে মারেন। একটি পক্ষে ছিলেন প্রক্টর নিজে।
গত বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রগতিশীল শিক্ষকসমাজ নামধারী আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের দুটি গ্রুপ একটি ইস্যুতে মতদ্বৈধতার কারণে হাতাহাতিতে জড়ান।
সর্বশেষ, গত মঙ্গলবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে হাতাহাতি ধস্তাধস্তিতে জড়িয়ে পড়েন আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের দুটি গ্রুপ। শিক্ষকদের একটি পক্ষ উপাচার্যের বিভিন্ন পদক্ষেপের বিরোধিতা করে ডাক দেন সর্বাত্মক ধর্মঘটের। অপর পক্ষ ঠেকাতে তৎপর হন ধর্মঘট। এক পর্যায়ে সেটা রূপ নেয় বাকবিতণ্ডা থেকে হাতাহাতিতে।
একটি ভিডিওতে দেখা যায়, এক গ্রুপের শিক্ষক অপর গ্রুপকে উদ্দেশ করে অশালীন গালি দিতেও কসুর করেননি।
এ ঘটনাগুলো দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আর রাজনৈতিক নোংরামি কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। এ শিক্ষকরা কীভাবে নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁদের গবেষণা, একাডেমিক পারফরম্যান্স কেমন, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। রাজনীতিতে জড়ানো তাদের কাজ কিনা এ নিয়েও বিতর্ক করা যায়। যতই দলাদলি আর গ্রুপিং করুন না কেন দিনশেষে তো তাঁরা হাই প্রোফাইল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। তাঁরা কি এ পরিচয়টিও মনে রাখবেন না?
এখানে শিক্ষাগুরুর মর্যাদা, তাৎপর্য, মাহাত্ম্য, ভূমিকা, করণীয় ইত্যাদি নিয়ে ভাবগম্ভীর আলোচনার অবতারণা করতে চাই না । সেসব সবাই জানেন।
শুধু একটা বিষয় বলতে চাই, শিক্ষার্থীরা সব সময়ই চান তাঁদের শিক্ষকরা এমন হবেন যেন তাঁদের দেখলে শ্রদ্ধায় মাথায় নুয়ে আসে। শিক্ষার্থীরা চান তাঁদের শিক্ষকরা এমন হবেন যেন তাঁদের নিয়ে গর্ব করতে পারেন।
শিক্ষকরা যদি এ সুযোগ শিক্ষার্থীদের দিতে একান্তই না পারেন তবে করজোড়ে আর্জি জানাই, অন্তত এমন কিছু করবেন না যাতে অতিশয় লজ্জিত হতে হয় শিক্ষার্থীদের। জাতির বিবেক বলে যারা পরিচিত আশা করি তাঁদের এর চেয়ে বেশি কিছু বলার প্রয়োজন নেই।
লেখক : শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী।