অভিমত
বাসচালকরা কি অন্য গ্রহের?
চলন্ত বাসে ধর্ষণ, ধর্ষণের পরে হত্যা—এ রকম খবর এখন আর বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়। সম্প্রতি টাঙ্গাইলে রূপা নামের এক কলেজছাত্রীকে বাসে গণধর্ষণের বিচার হয়েছে। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই রাজধানীর অদূরে সাভারে একইভাবে এক পোশাকশ্রমিককে ধর্ষণ করা হয় চলন্ত বাসে। এর কয়েক দিন পর খোদ রাজধানীতে তুরাগ পরিবহনের একটি বাসে উত্তরা ইউনিভার্সিটির এক ছাত্রীকে শ্লীলতাহানির অভিযোগ ওঠে।
আগে যাওয়া এবং প্রতিদ্বন্দ্বীকে ঘায়েল করার জন্য রাজধানী এবং রাজধানীর বাইরে সারা দেশেই লোকাল বাসগুলো যে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামে, যেভাবে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, সিটিং সার্ভিসের নামে যে ধরনের চিটিংবাজি করে, ‘মহিলা সিট খালি নাই’ বলে তারা রাস্তার মাঝখানে যেভাবে নারীদের হেয় করে কথা বলে, আবার বাসের ভেতরেও নারীদের যেভাবে হয়রানি করে এবং এসবের প্রতিবাদ করলে তারা যেভাবে যাত্রীদের সঙ্গে অসভ্য আচরণ করে, আইন অমান্য করে যখন তারা বাসের ভেতরেই ধূমপান করতে থাকে, নিজেদের মধ্যে বিরোধের জেরে যখন তারা নির্ধারিত স্টপেজ থেকে অনেক দূরে যাত্রীদের নামিয়ে দেয় (ঝালকাঠি-বরিশাল রুটে এখন যা হচ্ছে) এবং নারী-বৃদ্ধ-শিশুদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগের কারণ ঘটায়, তাতে মাঝেমধ্যে প্রশ্ন জাগে, এই পরিবহন শ্রমিকরা কি অন্য গ্রহের কেউ? তাদের মধ্যে মানবিকতা বলে কিছু কি নেই? যদি না থাকে তাহলে এর জন্য দায়ী কে?
এই অভিযোগগুলো মূলত লোকাল বাসের ক্ষেত্রেই বারবার আসে। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট বা এ রকম দূরপাল্লার রুটে চলাচলকারী স্বনামধন্য পরিবহন কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে কেন এ জাতীয় অভিযোগ ওঠে না? তারাও তো পরিবহন শ্রমিক? ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে যিনি গাড়ি চালান বা সুপারভাইজারগিরি করেন, তিনিও রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ আবার রাজধানীসহ সারা দেশের লোকাল বাসের চালক-কন্ডাক্টর-হেলপাররাও এই সমাজ ও রাষ্ট্রেরই নাগরিক। আমাদেরই ভাই-বন্ধু-আত্মীয়-পরিজন। তাহলে কেন এই বিস্তর ফারাক?
তফাৎটা আসলে শিক্ষায়, মানসিকতায় এবং পদ্ধতিতে। দূরপাল্লার রুটে চলাচলকারী বাসচালকরা তুলনামূলক শিক্ষিত, উন্নত প্রশিক্ষিত এবং তারা ভালো বেতন-বোনাস ও আর্থিক সুবিধা পায়। ফলে রাস্তায় তাদের রেষারেষি করতে হয় না। অন্য গাড়ি টপকে তার আগে যাওয়ার তাড়া নেই। বরং বেপরোয়া চালিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হলে, যাত্রীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করলে বা বড় কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে তার চাকরি চলে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। ফলে দূরপাল্লার রুটে চলাচলকারী অভিজাত কোম্পানির বাসগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ কম আসে। দূরপাল্লার রুটে বাসও দুর্ঘটনায় পড়ে, তবে সেটি সাধারণত নৈশকোচ এবং অনুসন্ধানে দেখা যাবে, সেসব পরিবহনের মালিক ও শ্রমিকদের ওরিয়েন্টেশনে ত্রুটি আছে।
বাস্তবতা হলো, চালকরা যখন এ রকম রেসে নামেন, তখন তাদের বিবেচনায় একবারও এটি আসে না যে, গাড়ির ভেতরে বসে বা দাঁড়িয়ে অন্তত ৫০ জন মানুষ, যাদের মধ্যে বৃদ্ধ, নারী, শিশু, এমনকি অসুস্থ মানুষও থাকতে পারেন। এ রকম অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামা আরেকটি বাসেই হয়তো এই বাসচালকের ভাই-বোন বা স্ত্রীও থাকতে পারেন, সেই চিন্তাটা সম্ভবত তাদের মাথায় আসে না। আসে না কারণ সেই বোধশক্তিটুকু তাদের মধ্যে হয় নেই, অথবা লুপ্ত হয়েছে।
অনেক সংগঠন যাত্রী নিরাপত্তার কথা বলে বিভিন্ন মানববন্ধন বা আন্দোলন-সংগ্রাম অথবা সংবাদ সম্মেলন করে। নিয়মিত তারা দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে, পরিসংখ্যান দেয়। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি এ রকম কোনো সংস্থা গণপরিবহনের শ্রমিকদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার উদ্যোগ কখনো নিয়েছে বলে শোনা যায়নি।
এটা ঠিক যে মানবিক মূল্যবোধ প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করা যায় না। কিন্তু একটি বিষয় নিয়ে যখন অব্যাহতভাবে কথা বলার চর্চা সমাজে জারি থাকবে, একটি বিষয় নিয়ে যখন পরিবহন শ্রমিকরা অব্যাহতভাবে শুনতে থাকবেন, তাদের মধ্যে যখন এই বোধটুকু ঢুকিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে যে, তার একার বেপরোয়া মনোভাবের কারণে ৫০ জন মানুষের জীবন বিপন্ন হতে পারে, তখন তিনি হয়তো একটু শান্ত হবেন। আরেকটি বাসের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার আগে, ট্রাফিক আইন ভাঙার আগে হয়তো তিনি ভাববেন।
আমরা কোটি কোটি টাকা খরচ করে ফ্লাইওভার বানাই, হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতুর অপেক্ষায় থাকি, জাপান-চীন-ভারত থেকে ঝকঝকে গাড়ি আমদানি করি, কিন্তু সেই ফ্লাইওভার কিংবা সেই পদ্মা সেতুতে ওই গাড়িগুলো যাঁরা চালাবেন, অর্থাৎ যাঁদের হাতে আমরা স্টিয়ারিং তুলে দেবো, তাঁরা কারা? তারা কতটা মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষ, তারা মানুষের জীবনের মূল্য কতটুকু বোঝে, সেই পরীক্ষা কি রাষ্ট্র কখনও নিয়েছে? রাস্তায় ‘গরু-ছাগল চিনলেই’ যদি কেউ গণপরিবহনের চালক হয়ে যায়, তাহলে সেই চালকদের কাছে মানুষের জীবন একটি গরু বা ছাগলের চেয়ে বেশি হবে না। মূলত রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের এ রকম ভয়ানক এবং অদ্ভুত ও যুক্তিহীন কথাবার্তার কারণেই সড়কের মৃত্যুর মহামারী কমছে না।
পড়াশোনা না জানা লোক যখন পেছনে ৫০ জন যাত্রী নিয়ে রাস্তায় দৌড় দেন, তিনি এটি ভাবেন না বা এ কথা তার মাথায়ও আসে না যে, এই বাসের ভেতরেই রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক, পরিবেশকর্মী, রয়েছে সম্ভাবনাময় তরুণ যে আগামীতে দেশকে বিশ্বে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে, রয়েছেন অন্তঃসত্ত্বা নারী, রয়েছে শিশু এবং তার বাবার বয়সী কোনো বৃদ্ধ। এই ভাবনাটা তাঁর মাথায় নেই বলেই তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী বাসের সঙ্গে রেসে নামেন। আর সেই উদ্ধত আচরণের শিকার হয়ে দুটি বাসের মাঝখানে পড়ে স্যান্ডউইচ হয় সম্ভাবনাময় তরুণ রাজীব; পা হারায় গৃহকর্মী রোজিনা, চাকায় পিষ্ট হতে থাকে মা এবং অসহায় ছেলে সেই বাস ধাক্কা দিয়ে সরানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে।
দূরপাল্লার বড় বড় কোম্পানির চালক হতে গেলে ন্যূনতম তাকে রাস্তার নিয়মকানুন জানতে হয়। বৈধ লাইসেন্স থাকতে হয়। ন্যূনতম ওরিয়েন্টেশন তাদের রয়েছে। কিন্তু লোকাল রুটের চালকদের একটা বড় অংশই হেলপার থেকে ড্রাইভার। কোনো ধরনের বৈধ লাইসেন্স নেই। গাড়ি চালাতে চালাতে সে ড্রাইভার। ঢাকার বিভিন্ন রুটে যেসব লেগুনা চলে, তার একটা বড় অংশের চালকই বয়সে কিশোর। ড্রাইভিং লাইসেন্স তো দূরে থাক, গাড়ি চালানোর ন্যূনতম জ্ঞানও তাদের নেই। অথচ তারা গাড়ির ভেতরে ১২/১৪জন লোক নিয়ে সাঁই সাঁই করে চলে যাচ্ছে। আর মানুষও বিকল্প না থাকায় বা কম খরচে গন্তব্যে যেতে পারায় উঠে পড়ে এইসব চলন্ত অ্যাটম বোমায়।
অনুসন্ধানে দেখা যাবে, সড়কে মৃত্যুর যে মহামারী তার পেছনে প্রধানত দায়ী এইসব অদক্ষ এবং অমানবিক চালক; যারা কোনো ধরনের নিয়মকানুন জানে না বা জানলেও তার ধার ধারে না। তারা নিজেদের রাস্তার রাজা মনে করে। যে কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির দায়ে আদালত কোনোও চালককে যাবজ্জীবন সাজা দিলে তারা এর বিরুদ্ধে রাজপথে নামে। তারা আদালতের সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়। তারা সারা দেশে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়েই ক্ষান্ত হয় না, তারা অ্যাম্বুলেন্সও ভাঙে। তারা মোটরসাইকেল থেকে যাত্রীদের নামিয়ে দেয়। তাদের সঙ্গে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীদের বৈঠকে বসতে হয়। তাদের দাবি মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে হয়।
সড়ক দুর্ঘটনার অধিকাংশের কোনো বিচার হয় না। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার শিকার হয় দরিদ্র মানুষ। পক্ষান্তরে পরিবহন মালিকরা আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী এবং শ্রমিকরাও অত্যন্ত সংগঠিত, কারণ তাদের পেছনে রয়েছে শক্তিশালী রাজনৈতিক আশীর্বাদ। ফলে তাদের সঙ্গে পেরে ওঠা সহজ নয়। তারা জানে, চাকায় দু-চারজনকে পিষে মেরে ফেললে কিছু হবে না। চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ এবং সাংবাদিক মিশুক মুনীরের মৃত্যুর ঘটনার বিচার হয়েছে কারণ এই ঘটনার বিচার দাবিতে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অব্যাহতভাবে লেগেছিল। সড়কে প্রতিদিন যাদের প্রাণ যায়, তাদের বড় অংশই সমাজের নিচুতলার। ফলে তাদের জন্য গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অত সময় বরাদ্দ নেই।
সুতরাং এ কথা বলা যায় যে, যত দিন পর্যন্ত না পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে মানবিক গুণাবলি প্রতিষ্ঠিত হবে, যত দিন না তারা যাত্রীদের মানুষ ভাবতে শুরু করবে এবং যত দিন না তারা বাসের ভেতরে থাকা একজন নারীকে তাদের মা ও বোনের মতো সম্মান ও স্নেহ করতে শিখবে, যত দিন না মালিকরা তাদের ঠকানো বন্ধ করবেন এবং শ্রমিকদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেবেন, তত দিন রাস্তায় এই রেষারেষি চলবে, এই বেপরোয়া মনোভাবেই তারা গাড়ি চালাবে এবং নিয়মিত এ রকম চাকায় পিষ্ট হওয়া, দুই বাসের ভেতরে পড়ে শিক্ষিত তরুণের হাত ঝুলে থাকা, গাড়িতে উঠতে গিয়ে বা রাস্তা পেরোতে গিয়ে বাসের ধাক্কায় জীবন সংকটাপন্ন হওয়া এবং বাসের ভেতরে গণধর্ষণ ও হত্যার মতো ভয়ানক ঘটনাগুলো ঘটতেই থাকবে।
লেখক : সাংবাদিক