আন্তর্জাতিক
ইউরোপে বড় ধরনের অভিবাসী সমস্যা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথমবারের মতো ইউরোপের দেশগুলো অবৈধ অভিবাসীদের নিয়ে বড় ধরনের সমস্যার মধ্যে পড়েছে। অতীতে এমনটি কখনোই হয়নি। সাম্প্রতিককালে ইউরোপে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যা বেড়েছে। প্রধানত দুটি রুট ব্যবহার করে সিরীয় ও আফ্রিকার অভিবাসীরা ইউরোপে প্রবেশ করছে। একটি রুট হচ্ছে সিরিয়া থেকে তুরস্ক, তার পর সেখান থেকে গ্রিস। অন্যদিকে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর অতিক্রম করে ইতালিতে যাওয়ার চেষ্টা। যাঁরা গ্রিসে ঢুকছেন, তাঁরা মূলত পূর্ব ইউরোপের হাঙ্গেরি-সার্বিয়া সীমান্ত অতিক্রম করেই গ্রিসে প্রবেশ করছেন। গ্রিসে প্রবেশ করার পর তাঁদের একটি দ্বীপে ‘ডিটেনশন সেন্টারে’ রাখা হচ্ছে। আগস্টের শেষ সপ্তাহে অস্ট্রিয়ার সীমান্তে একটি পরিত্যক্ত লরিতে ৭১ অভিবাসীর মৃতদেহ উদ্ধার কিংবা লিবিয়া সীমান্তে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে প্রায় দুই হাজার অভিবাসীর মৃত্যুর খবর আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার পায়। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন এই অভিবাসী সমস্যায় উদ্বেগ প্রকাশ করে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে একটি মহাসম্মেলন ডেকেছেন।
ব্যাপক সংখ্যক অভিবাসীকে ইউরোপে প্রবেশ ও প্রবেশের চেষ্টা সেখানে বড় ধরনের বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এই ব্যাপক সংখ্যক অভিবাসীর অনুপ্রবেশ নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যে প্রশ্নটি অনেকেই করার চেষ্টা করেন তা হচ্ছে, হাজার হাজার অভিবাসী ইউরোপকে বেছে নিল কেন? ইউরোপ দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক আশ্রয়ধারীদের স্বর্গরাজ্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। গত ২০-৩০ বছরে হাজার হাজার শরণার্থী ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়ে সেখানে বসবাস করে আসছেন এবং সেখানকার নাগরিকত্বও অর্জন করেছেন। ইউরোপের নাগরিকরা, বিশেষ করে জার্মানি কিংবা স্ক্যান্ডেনেভিয়ান রাষ্ট্রগুলো বরাবরই শরণার্থীদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল ছিল। ফলে আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা কিংবা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে এঁরা এসব দেশে নতুন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিলেন। ফলে এসব দেশ রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য এক-একটি স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছিল। মানবপাচারকারীরা এটাকেই ব্যবহার করেছিল এবং তারা এই সুযোগ গ্রহণ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা থেকে মানবপাচারের উদ্যোগ নেয়। এটা সত্য, বর্তমান প্রেক্ষাপটে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া, লিবিয়া থেকে ব্যাপক সংখ্যক মানুষের ইউরোপে অভিবাসন ঘটেছে অবৈধভাবে। তবে আফ্রিকা থেকে যাঁরা আসছেন, তাঁরা মূলত অর্থনৈতিক সচ্ছল, উন্নত জীবন, ইউরোপের জীবনযাত্রা, সামাজিক নিরাপত্তা ইত্যাদিতে আকৃষ্ট হয়ে ইউরোপে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করেন অবৈধ উপায়ে। এমন খবরও শরণার্থীদের মুখ থেকে বের হয়েছে যে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁরা দুই থেকে তিন হাজার ডলার পর্যন্ত খরচ করেছেন অবৈধ পথে ইউরোপে যাওয়ার জন্য। আবার এমনও দেখা গেছে, দালাল চক্র এসব শরণার্থীকে জিম্মি করে অবৈধভাবে অর্থ আদায় করছে। দ্বিতীয়ত, ইউরোপে যাওয়ার ব্যাপারে অভিবাসীদের আগ্রহ বেশি কেন? এর একটা কারণ আমরা খুঁজে পেয়েছি যে, ইউরোপের নেতৃবৃন্দ এসব অভিবাসীর ব্যাপারে কিছুটা আগ্রহী। এর কারণ হচ্ছে, সেখানে জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধির হার শূন্যতে নেমে এসেছে, অর্থাৎ পরিবারপ্রতি জনসংখ্যা বাড়ছে না। তরুণ প্রজন্ম তাদের স্ব-স্ব পেশার প্রতি এত বেশি মনোযোগী যে, পৃথিবীতে সন্তান জন্ম দেওয়ার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ কম। ফলে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী হ্রাস পাওয়ায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা চালানোর জন্য লোকের প্রচণ্ড অভাব অনুভূত হয়। জার্মানি একটি শিল্পোন্নত দেশ। তাদের ফ্যাক্টরিগুলো চালাতে লোক দরকার। ফলে তারা পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করত শরণার্থীদের অনুপ্রবেশের। জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয় অর্জন করলেই তা মঞ্জুর করা হতো। আশির দশকে হাজার হাজার আফগান নাগরিক জার্মানিতে পাড়ি জমিয়েছিলেন। তাঁরা সেখানকার অর্থনীতিতে বড় অবদান রেখেছেন। আজকে ঘুরেফিরে সেই পরিস্থিতি থেকে জার্মানি বেরিয়ে আসতে পেরেছে, এটা মনে হয় না। তাদের শ্রমিক দরকার কারখানাগুলো চালানোর জন্য। যদিও এটা সত্য, ১৯৯০ সালের পর পূর্ব ইউরোপ থেকে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর অভিবাসন ঘটেছে জার্মানিতে। এরা শ্বেতাঙ্গ, এরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত কোনো কোনো দেশের নাগরিক (যেমন—চেক, পোল্যান্ড)। এরা আইনগতভাবেই জার্মানিতে থাকার ও চাকরি করার অধিকার রাখেন। কিন্তু তারপরও জার্মানিতে শ্রমিক সংকট রয়েছে। ফলে আজকে শরণার্থীরা অবৈধভাবে ইউরোপ ঢোকার চেষ্টা করছেন, তাঁদের সবার টার্গেট থাকে জার্মানিতে যাওয়ার। তৃতীয়ত, ইউরোপে এই অভিবাসী সমস্যা কোনো একটি দেশের সমস্যা নয়; বরং সমস্যাটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ)। এর সমাধান ইউরোপীয় ইউনিয়নকেই খুঁজে বের করতে হবে।
এরই মধ্যে জার্মানির উদ্যোগে বলবান রাষ্ট্রগুলোর একটি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল অংশ নিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল একটাই, কী করে অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধ করা যায়। কিন্তু ভিয়েনা সম্মেলনে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। জার্মানি চাইছে ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে এই সমস্যা মোকাবিলা করা। কিন্তু ইইউর নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিভক্তি আছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, শেনজেন জোনের সুযোগ গ্রহণ করে এ অঞ্চলে একটি পাচারকারী চক্র অত্যন্ত সক্রিয়। এই ‘জোন’-এ অন্তর্ভুক্ত যেকোনো একটি দেশে প্রবেশ করলে অন্য দেশে ভিসা ছাড়াই যাওয়া যায়। ফলে পাচারকারীরা হাঙ্গেরি সীমান্ত ব্যবহার করছে। প্রতিদিন হাঙ্গেরিতে পা রাখছে প্রায় তিন হাজার মানুষ। হাঙ্গেরি সার্বিয়ার সঙ্গে ১৭৫ কিলোমিটার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করছে, যাতে করে সার্বিয়া থেকে অবৈধ অভিবাসীরা হাঙ্গেরিতে প্রবেশ করতে না পারে। একবার হাঙ্গেরিতে প্রবেশ করলে ইইউভুক্ত যেকোনো দেশে যাওয়ার সুযোগ তাদের জন্য তৈরি হয় এবং হাঙ্গেরিতে প্রবেশ করামাত্র ইইউর সব সুযোগ-সুবিধা তারা পাবে। জার্মানি এরই মধ্যে ইউরোপে প্রবেশ করা প্রায় তিন লাখ ১০ হাজার শরণার্থীকে (জাতিসংঘের তথ্যমতে) ইইউভুক্ত প্রতিটি দেশে অভিবাসনের সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানালেও অনেক দেশই তাতে আপত্তি জানিয়েছে। হাঙ্গেরি ভিয়েনা সম্মেলনে অংশ নেয়নি। ফলে অভিবাসীদের নিয়ে একটা সমস্যা রয়েই গেছে। চতুর্থত, ব্যাপক সংখ্যক অভিবাসীর অনুপ্রবেশ ইউরোপে একটি শক্তিশালী ‘অভিবাসনবিরোধী’ মনোভাবের জন্ম দিয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জার্মানিতে উগ্র নাৎসিবাদের আবার জন্ম হয়েছে। অভিবাসীদের আশ্রয়কেন্দ্রে হাতবোমা নিক্ষেপ ও আগুন দেওয়ার ঘটনাও সেখানে ঘটেছে। সুইডেনে অভিবাসনবিরোধী রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়েছে। আর হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যেই বলেছেন, আফ্রিকা থেকে আসা অভিবাসীদের কারণে হাঙ্গেরি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব এখন বিপন্ন। প্রায় প্রতিটি দেশই অভিবাসীদের ঠেকাতে নতুন নতুন নিয়ম করার উদ্যোগ নিচ্ছে। যুক্তরাজ্য যে নতুন অভিবাসী নীতি প্রণয়ন করছে, তাতে অভিবাসীদের জেল, অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। যুক্তরাজ্যের অভিবাসনের পরিসংখ্যান থেকে জানানো হয়েছে, ব্রিটেনে অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যা এখন ৮০ লাখ। ২০০৪ সালে দেশটিতে মোট জনসংখ্যার ২৮ ভাগ ছিল অভিবাসী, যা এখন ৩৫ ভাগে উন্নীত হয়েছে। এসব অভিবাসীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে ভারতের। আর প্রথম ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ।
অবৈধ অভিবাসী ঠেকাতে ইউরোপের প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রের সীমান্তে বেড়া তৈরি হচ্ছে। ১৯৮৯ সালে বার্লিন দেয়ালের পতন নতুন এক ইউরোপের জন্ম দিয়েছিল। আজ ২৬ বছর পর নতুন করে আবার দেয়াল উঠছে—এ দেয়াল অবৈধ অভিবাসী ঠেকাতে। কিন্তু আদৌ কি এই অবৈধ অভিবাসন বন্ধ করা যাবে? হাঙ্গেরিতে অভিবাসীদের ওপর পুলিশের টিয়ার সেল নিক্ষেপের ঘটনাও ঘটেছে। এমনকি চেক রিপাবলিকের প্রধানমন্ত্রী শুধু খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের গ্রহণ করা হবে, এমন মন্তব্য দিয়ে একটি বড় বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। এই অভিবাসন প্রক্রিয়া কীভাবে বন্ধ হবে? প্রথমত, যুদ্ধপীড়িত অঞ্চলে (সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, ইয়েমেন) যদি স্থিতিশীলতা ফিরে না আসে, তাহলে মানুষ আশ্রয়ের জন্য দেশ ত্যাগ করবেই।
দ্বিতীয়ত, মানবপাচারকারীদের কঠোর শাস্তির আওতায় না আনা হলে এই অবৈধ তৎপরতা বন্ধ হবে না। তৃতীয়ত, যুদ্ধপীড়িত অঞ্চলে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মোতায়েন করা জরুরি, বিশেষ করে সিরিয়ায়। সেখানে একদিকে রয়েছে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরা, অন্যদিকে রয়েছে সরকারি বাহিনী। মার্কিন বোমা বর্ষণ সত্ত্বেও আইএসকে নির্মূল করা যায়নি। এরই মধ্যে সিরিয়া ও ইরাকের কিছু এলাকা নিয়ে ‘জিহাদি রাষ্ট্রের’ জন্ম হয়েছে। এখানে যাঁরা থাকছেন, তাঁদের বাধ্য করা হচ্ছে আইএসের কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে। যাঁরা নিচ্ছেন না, তাঁরা অবৈধ পথে তুরস্ক হয়ে দেশ ত্যাগ করছেন। চতুর্থত, অর্থনৈতিক অভিবাসন ঠেকাতে আফ্রিকায় বিনিয়োগ বাড়ানো ও কাজের ক্ষেত্র সৃষ্টি করা জরুরি। মানুষ যদি বেকার থাকে, তখন উন্নত জীবনের আশায় তারা বের হবেই। এ মুহূর্তে যেসব অভিবাসী ইউরোপে প্রবেশ করেছেন, তাঁদের আশ্রয় দেওয়া জরুরি। অন্যদিকে অবৈধ অভিবাসী ঠেকাতে ভূমধ্যসাগরে নৌ তৎপরতা বাড়ানো এবং যেসব স্থান থেকে তারা ছোট ছোট নৌকায় ওঠে, ওই সব স্থানে কড়াকড়ি ব্যবস্থা আরোপ করা জরুরি। একটি বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে ইউরোপ, যদি না খুব দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করা যায়।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।