নান্নুকে নিয়ে বিস্ময় মেশানো মুগ্ধতা গ্রিনিজের!
কুড়ি বছর আগের যে লোকটাকে বাংলাদেশ ক্রিকেট প্রেস ইন্টারভিউ করত সেই লোকটা আর এই লোকটাকে মোটেও এক মনে হয়নি! সেটাও খুব স্বাভাবিক। দীর্ঘ সময়ে কত কিছু পাল্টে গেছে। নিম্ন আয়ের দেশ থেকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের ক্রিজে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সমুদ্র জয় করেছে। মহাকাশে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। ঢাকা শহরে একের পর এক উড়াল সেতু দাঁড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ গোটা পাঁচেক ক্রিকেট বিশ্বকাপ খেলেছে। চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল খেলেছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে পেছনে ফেলে টেস্ট ক্রিকেটে আট নম্বরে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। আর যার ছোঁয়ায় বাংলাদেশের ক্রিকেটে পরিবর্তনের শুরু তিনি পাল্টাবেন না তা কী করে হয়!
হ্যাঁ, তিনিও পাল্টেছেন। তবে সাদা চোখে দেখে সেটা বোঝার উপায় নেই। ৬৭ বছরের ভদ্রলোককে দেখে আপনি ৪৭ এর সেই মানুষটাকে খুঁজে পাবেন। তবে সেটা বাহ্যিক। ভেতরে অন্য এক মানুষ। যিনি অনেক বিনয়ী। কম উদ্ধত। ভেতরের উত্তপটা কমিয়ে ফেলেছেন।এক সময়ের ক্যারিবীয় ক্রিকেট যোদ্ধা যিনি এখন শান্তিতে আছেন। নির্ঝঞ্ঝাট জীবন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট রূপকথার অন্যতম চরিত্র তিনি। বাংলাদেশ ক্রিকেটে তাঁর আবির্ভাব ‘বিপ্লবী’ হিসেবে। গত শতাব্দীর শেষ দিকে তিনি কোচ হিসেবে বাংলাদেশ ক্রিকেটে একটা বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। সেই বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে এদেশের ক্রিকেট বাঁক পরিবর্তন করেছে। এবার ঢাকায় দেখলাম সেই লোকটারও কত পরিবর্তন। তবে বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে তাঁর ভেতরের আবেগটা আগের মতোই আছে। ক্যারিবিয়ান সাগরের ঢেউে সেটা ধুঁয়ে মুছে যায়নি। ঢাকায় এবার ঘন্টা তিনেক একান্তে কথা বলার সময় এমন এক গর্ডন গ্রিনিজকে আবিষ্কার করলাম, যার সাথে কথা বলে বিস্মিত হতে হয়েছে। অনেক মুগ্ধতা আর বিস্ময়ের জন্ম দিয়ে গেলেন তিনি।
বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে তিনি যখন কথা বলেছেন, তা শুনতে শুনতে নিজের মনে প্রশ্ন জেগেছে ঠিক শুনছি তো! বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রয়েছি তাঁর মুখের দিকে। তিনি যখন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কোচ, তখন তাঁকে মনে হত তিনি জেনারেল। তাঁর দলের ক্রিকেটাররা সোলজার। যুদ্ধ জয় ছাড়া অন্য কোন লক্ষ্য তিনি তাঁর বাহিনীর সামনে রাখতে জানতেন না। বছর তিনেকের সেই চাকরি জীবনে তিনি দেখেছেন, কত কাঁটা ছড়ানো পথ। কত রক্ত মাড়িয়ে এগুতে হয়েছে। কত মানসিক যন্ত্রণা সয়ে এক একটা যুদ্ধ জিততে হয়েছে। তিনি-ই আবার দেখেছেন তাঁর সৈন্যরা কত ভীরু! যে কারণে জেনারেলকে বিদায় নিতে হয়েছিল চোখের জলে! কত দ্রুত অবসৃত হয়ে গেলেন তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট থেকে! কারণটা রহস্যাবৃতই থাকুক না!
তবে কুড়ি বছর পরে বিস্ময়াহত চোখে দেখলাম সেই গর্ডন গ্রিনিজ কত রোমাঞ্চিত এবং শিহরিত তাঁর সৈন্যদের নিয়ে। তাদের সম্পর্কে যখন কথা বললেন, সেখানে বিস্মিয়ের আরো রসদ। বিস্ময়ের সেই ঢাকনা খুলে দিলেন, র্নিমোহ ভঙ্গিতে। আকরাম-বুলবুল- নান্নুদের ক্রিকেটীয় স্কিল এমনভাবে ব্যাখ্যা করলেন, সেখানে আবার কোন তাপ-উত্তাপ-আবেগ-বিদ্বেষ-রাগ-ক্ষোভের ছিটেফোঁটা নেই। গর্ডনের নিজের কথা, ‘আকরাম-বুলি-নান্নু। ওরা ক্রিকেটার হিসেবে আলাদা। মানুষ হিসেবে আলাদা। ওদের ক্রিকেট দর্শন আলাদা। টেকনিক-ফিটনেস-নলেজ প্রত্যেকের ভিন্ন। কোনো সূচকে এদের কাউকে খুব কাছাকাছি রাখা যায় না।’
এটাও খুব স্বাভাবিক। কেউ কারো মত হবেন না। এতে বিস্মিত হওয়ার কী আছে! তবে বিস্মিত হতে হয়েছে ব্যাটসম্যান নান্নুকে নিয়ে গর্ডনের মুগ্ধতা এবং হতাশার মিশেল দেখে, ‘নান্নুর ব্যাটিং ছিল কার্ল(হুপার)-র মত। সিঙ্গেলস-ডাবলস নিত কি অনায়াসে। ফিল্ডারদের মাঝখানের গ্যাপটা ওর চেয়ে ভালো কেউ চিনত বলে মনে হয়নি আমার দলের। সত্যি ব্যাটিংটা ও দারুণ ব্যাট করত। আবার ওই হতাশ করত। কার্লের মত ত্রিশ-চল্লিশটা রান করে ফেলত কখন টের পাওয়া যেতো না। কিন্তু ইনিংসটাকে বড় করত পারত না! যেটা খুব হতাশার ছিল।’ কিন্তু কোচ হিসেবে আপনার কাছে কারণটা কি মনে হত? এমন প্রশ্নে বলেছেনও, ‘অনেস্টলি, আমার মনে হয়েছে দলে জায়গা নিয়ে ওর এবং আরও কয়েকজন ক্রিকেটারের ওপর একটা বাড়তি চাপ থাকত। ওরও হয়ত মনে হত ত্রিশ-চল্লিশটা রান করতে পারলে জায়গাটা টিকে গেলো।’ এই মিনহাজুল আবেদীনের বিশ্বকাপ স্কোয়াডে থাকা নিয়ে কত নাটক! গর্ডন গ্রিনিজ নিজেই তখন কোচ। ফ্ল্যাশ ব্যাকে উনিশ বছর পেছনে গেলে কী মনে হয় না, গর্ডনের কথাগুলো খুব একটা অসত্য নয়। বিশ্বকাপের দল ঘোষণার আগের শেষ প্র্যাকটিস ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান দেখলেন ১৫ জনের দলে তিনি নেই! পরের অংশে অনেক নাটক। তারপরের অংশ ইতিহাস। বিশ্বকাপ খেললেন মিনহাজুল আবেদীন নান্নু।
বাংলাদেশের জেতা বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ জয়ের নায়কও তিনি। প্লেয়ার অফ দ্য ম্যাচও নান্নু। আবার সেই বিশ্বকাপে নিজেদের শেষ ম্যাচের আগের দিন বরখাস্তের চিঠি ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল গর্ডনের হাতে! চোখের জলে হোটেল থেকে বিদায় জেনারেলের! উনিশ বছর পর সেই ভুলের খানিকটা প্রায়শ্চিত্ত-ই করা হলো গর্ডনকে সংবর্ধিত করে?
কিন্তু কিছু ভুল থেকে যায়। যার আগে বাড়তি একটা শব্দ বসিয়ে দেয় সময়। ‘ঐতিহাসিক’। মিনহাজুল আবেদীন নান্নুর মাথায় টেস্ট ক্যাপ উঠলো না! সেই ভুল কার? নান্নুর নাকি বাংলাদেশ ক্রিকেট কর্তাদের? নাকি নির্বাচকদের? উত্তরদাতা যদি হন গর্ডন গ্রিনিজ; কী বলবেন তিনি? ভদ্রলোক ডান হাতটা কাপালে রাখলেন। আর মুখ দিয়ে বের করলেন, ‘দিস ইজ কলড লাক।’
ভাগ্য নাকি দুর্ভাগ্য! বাকিটুকু মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, আপনি নিজে বুঝে নিতে পারেন।
লেখক: সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট।