অভিমত
গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা
১৯৪৮ সালের ১৫ মে ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে যে অবৈধ ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, তা গত ৭০ বছর ধরে ফিলিস্তিনিদের রক্ত নিয়ে হোলি খেলছে। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত এমন কোনো দিন বাকি নেই, যেদিন ইসরায়েলি নিগ্রহের ঘটনা না ঘটছে। আনুষ্ঠানিক যুদ্ধের বিচারে সেখানে ১৯৪৮, ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ মোট বড় দাগের চার-চারটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। যথারীতি ফিলিস্তিনি জনগণ যুদ্ধের ধ্বংস, মৃত্যু ও বিপর্যয় ধারণ করেছে। একেকটি যুদ্ধ সম্প্রসারিত করেছে ইসরায়েলি সীমান্ত। যুদ্ধের পর যুদ্ধ। নিত্যদিন যুদ্ধ মোকাবিলা করছে ফিলিস্তিনি জনগণ। নিহত হচ্ছে নারী ও শিশু। সেখানে ফিলিস্তিনি জনগণের বিক্ষোভ করাও অন্যায়। প্রতিবাদ করার অধিকার নেই তাদের।
গত ১৫ মে ছিল ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ৭০তম বার্ষিকী। প্রতিবছরের মতো ইসরায়েলিরা এদিন পালন করে স্বাধীনতা দিবস সাড়ম্বরে এবং জাঁকজমক পরিষদে। আর ফিলিস্তিনিরা স্মরণ করে সাত দশক ধরে আরোপিত অধীনতা, লাঞ্ছনা ও নির্যাতনের কথা। সর্বশেষ ইসরায়েলি বর্বরতায় গাজা সীমান্তে বিক্ষোভরত ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনী গুলিবর্ষণ করে। এতে এ পর্যন্ত ৬১ জন ফিলিস্তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন, আহত হয়েছেন দুই হাজার ২৭১ জন। তাঁরা সকলেই সরাসরি গুলিবর্ষণের শিকার হন। তাঁদের গুলিবর্ষণের বাহানা গাজার নির্বাচিত হামাস কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। ইসরায়েল ও তার প্রভু আমেরিকা অনবরত অভিযোগ করে যাচ্ছে যে হামাস নারী-শিশু ও নিরীহ নাগরিকদের মানব ঢাল হিসেবে নিরাপত্তা বেষ্টনী ছিন্ন করতে পাঠিয়েছে। এই অব্যাহত হত্যার বিরুদ্ধে তথাকথিত মানবাধিকারের প্রবক্তা পাশ্চাত্য দীর্ঘকাল ধরে শুধু সমর্থনই করছে না, বরং তাদের সাফাই গাইছে। নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি ইসরায়েলের ‘সংযম’-এর প্রশংসা করেছেন। তাঁর ভাষায়, ‘অন্য কোনো দেশ এ পরিস্থিতিতে যা করত, ইসরায়েল তার চেয়ে অনেক বেশি সংযমী ছিল।’ ব্রিটেন দায়সারা গোছের প্রতিবাদ করেছে। বলেছে, ‘ফিলিস্তিনি জনগণের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকার রয়েছে।’ কিন্তু হামাসের ভূমিকার তদন্তের কথা বলেছে।
সবচেয়ে নিদারুণ কষ্টের কথা, যাঁরা নিজেদের ইসলাম ও মুসলমানদের হেফাজতকারী দাবি করেন, তাঁদের সাম্প্রতিক ভূমিকা। সৌদি আরবে প্রিন্স সালমান ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের গোপন যোগাযোগ ও যোগসূত্রের খবর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সালমান গোপনে তেলআবিব সফর করেছেন—এ কথাও শোনা গেছে। প্রিন্স নিজে এটা অস্বীকার করেছেন। তবে ইসরায়েলি কর্তৃত্ব আকারে-প্রকারে এর সত্যতা স্বীকার করেছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন তেলআবিব থেকে পূর্ব জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের নির্দেশ দেন, তখন আরব বিশ্ব প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। সৌদি প্রিন্স গোপনে এটা মেনে নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের বার্তা পাঠান। আর নিজেরা মামুলি প্রতিবাদ করেন। এই প্রথমবারের মতো সৌদি আরব তার দেশের ওপর দিয়ে ইসরায়েলি বিমান চলাচলের অনুমতি দেন। প্রিন্স ক্ষমতায় আসার পর থেকে এমন সব কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করছেন, যা ইসরায়েলের অনুকূলে যাচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে অন্যান্য মুসলিম দেশের ভূমিকা বিশেষত, তুরস্ক ও ইরানের ভূমিকা প্রশংসাসূচক।
জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তর ও গাজায় গণহত্যার ঘটনা নিয়ে আলোচনার জন্য ১৮ মে ইস্তাম্বুলে ইসলামী সম্মেলন সংস্থা ওআইসির বিশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ওআইসির প্রেসিডেন্ট তুরস্ক এই বিশেষ সম্মেলন আহ্বান করেছে। তুর্কি সরকারের মুখপাত্র ও উপপ্রধানমন্ত্রী বাকীর বোজদাগ মন্ত্রিসভার সাপ্তাহিক বৈঠকের পর ওআইসির বিশেষ সম্মেলন ডাকার সিদ্ধান্তের কথা জানান। এরই মধ্যে ইসরায়েলি কার্যক্রমের কঠোর সমালোচনা করেছে তুরস্ক। এ ছাড়া তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তান, জর্ডান, কুয়েত ও মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে ফোনালাপ করেছেন বলে তুর্কি প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ থেকে বলা হয়। তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের নৃশংসতার ব্যাপারে মুসলিম বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ ব্যবস্থার ওপর জোর দেন। ব্রিটেন সফররত তুর্কি প্রেসিডেন্ট সৌদি বাদশা সালমান বিন আবদুল আজিজ ও ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গেও আলোচনা করেছেন বলে জানা গেছে।
গত ৭০ বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলে প্রধান রক্ষক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল যখন স্বাধীনতা ঘোষণা করে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান ইহুদি রাষ্ট্রটিকে স্বীকৃতি দিতে সময় নিয়েছিলেন মাত্র ১১ মিনিট। আর সকলেরই জানা কথা, ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেলফোরের ঘোষণার মাধ্যমে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। অন্যান্য পাশ্চাত্য রাষ্ট্র ও শক্তিগুলো দীর্ঘকাল ধরে একই নীতি অনুসরণ করে আসছে। এ ক্ষেত্রে সেদিনের সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকাও ছিল এক ও অভিন্ন। চীনে তখন গৃহযুদ্ধ চলায় তার কোনো ভূমিকা ছিল না। তখন সে পঞ্চ বৃহৎ শক্তির অংশও ছিল না।
পরবর্তীকালে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রদ্বয় আরবদের সমর্থন করে এলেও তা ছিল রাজনৈতিক স্বার্থের পরিপূরক। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পরিবর্তিত বৈশ্বিক সমীকরণে চীন ও রাশিয়া ক্রমবর্ধমানভাবে ফিলিস্তিনি স্বার্থের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। ১৯৪৮ থেকে এ পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে দৃঢ় সমর্থন দিয়ে গেলেও কোনো কোনো সময়ে তারা মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৭৭ সালে এ ধরনের ভূমিকার ফলে কেম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রেসিডেন্ট ওবামা বিশেষ কিছু করতে না পারলেও কায়রো ঘোষণায় ইসরায়েলি ভূমিকার সমালোচনা করা হয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর মার্কিন আগ্রাসী নীতিতে তীব্রতা লক্ষ করা যায়। প্রথমত, ট্রাম্প এত দিন ধরে অনুসৃত দুই রাষ্ট্রনীতি পরিত্যাগ করেন। স্পষ্টভাবে তিনি ইসরায়েলের একক রাষ্ট্রের পক্ষে দাঁড়ান এবং ফিলিস্তিনিদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের অধিকার অস্বীকার করেন। তিনি মনে করেন, ইসরায়েলি একক রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে ফিলিস্তিনিদের অধিকার সংরক্ষিত হবে।
দ্বিতীয়ত, পূর্ব জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে নেওয়া ছিল অনুসৃত মার্কিন নীতিতে আরো বড় ধরনের বিচ্যুতি। মার্কিন সিনেটে গৃহীত প্রস্তাবে পূর্ব জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করায় নীতিগত বাধ্যবাধকতায় থাকলেও মার্কিন প্রশাসন এত দিন ধরে নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। কিন্তু এখন ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই ভারসাম্যের নীতি অস্বীকার করায় মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় এই যে সৌদি আরবসহ মার্কিন মিত্র দেশগুলোর ভূমিকা ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফিলিস্তিনবিরোধী ভূমিকা গ্রহণে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। স্মরণ করা যেতে পারে যে প্রেসিডেন্ট ওবামা ইরানের সঙ্গে যে পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে সৌদি আরব তার মধ্যে অস্তিত্বের সংকট অনুভব করে। এর প্রতিকারের জন্য ছুটে যান সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান। আগে থেকেই ট্রাম্প জামাতা কুশনারের সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। তীব্র মুসলিম বিদ্বেষ সত্ত্বেও মার্কিন করপোরেট স্বার্থের তাঁবেদার ট্রাম্প প্রথমেই সৌদি আরব সফর করেন। সেখানে সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে বড় সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যা হোক, এখন যখন ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি ট্রাম্প বাতিল করেছেন, তখন সৌদি আরব মহাসুখে বগল বাজাচ্ছে। এই সুযোগে ইসরায়েল ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়ার সর্বাত্মক উসকানি দিয়ে যাচ্ছে। ট্রাম্প এই সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারাতে চান না, তবে তুরস্ক, রুশ-চীন যে মৈত্রী জোট ক্রমশ বাস্তবতা অর্জন করছে, তাতে ইরান আক্রমণ ইরাকের মতো সহজ হবে না।
মুসলিম বিশ্বের পারস্পরিক ঘৃণা-বিদ্বেষ ও স্বার্থে সংঘাত ইসরায়েলকে গাজায় গণহত্যার মতো ঘৃণ্য ও নির্মম ঘটনা সংগঠনে সাহায্য করছে। ইরান ও ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের এ দুই শত্রু দমনে তাদের পরিকল্পিত বিভাজন নীতি সফল হয়েছে। মিসরের সামরিক সরকার এরই মধ্যে ইসরায়েলের অধীনতামূলক মিত্রতা মেনে নিয়েছে। সিরিয়া ও লিবিয়া ইসরায়েলের দুই শক্ত বিরোধী রাষ্ট্র গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত। মুসলিম বিশ্বের এই নিদারুণ বাস্তবতায় ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি ইসরায়েলি নৃশংসতার পরিপ্রেক্ষিত বিবেচিত হতে হবে। চলমান ওআইসির বিশেষ সম্মেলন এই বাস্তবতা অনুধাবন করে একটি ঐক্যবদ্ধ ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে—এটাই সময়ের দাবি। মনে রাখতে হবে, ইসরায়েল কোনো নীতিবোধ তাড়িত মানবিক রাষ্ট্র নয়। একমাত্র শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমেই মুক্তি সম্ভব।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।