সমসাময়িক
ঢাকা এখন জনদুর্ভোগের উত্তম নমুনা
সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার বাসযাত্রায় মিরপুর থেকে কারওয়ান বাজার। যদি গতকাল লিখতে বসতাম তবে এ লেখার শিরোনামটা পুরোপুরি এমন হতে পারত। রাস্তার মোড়ে মোড়ে এত দিন অসহ্য যানজট দেখে ক্লান্ত দুচোখ অনেকটা পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিয়েছে বেশ। তেমনি রাস্তায় যানজটে পড়ামাত্র নেমে হাঁটা শুরুর অভ্যাসটাও এখন নগরবাসীর বেশ আয়ত্বে চলে এসেছে। তাই বলে পথিমধ্যে জলজট, রাস্তায় যানজট অমন শাঁখের করাতে ছিন্নভিন্ন হওয়া দুর্দিন বোধকরি নগরবাসী এর আগে তেমনটা প্রত্যক্ষ করেনি। সুদূর চক্রবালে বক্র কিংবা ঋজু দৃষ্টি দিলে শুধু চোখে পড়ে থৈ থৈ পানি। এদিকে রাস্তার অবস্থা আরো ভয়াবহ যেখানে একটু নিচু সেখানেই অথই পানি। দুপাশ দিয়ে কাদাজল মাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে জীবন সংগ্রামে বাধ্য দপ্তরমুখী মানুষ। এদিকে ইঞ্জিন কিংবা সাইলেন্সার পাইপে পানি ঢুকে থমকে দাঁড়ানো সিএনজি অটোরিকশা কিংবা নাকাল প্রাইভেটকার থমকে দিয়েছে পেছনের যানবাহনকেও। নগর পরিবহনের নানা ধরনের বাস, মাইক্রোবাস, মিনিবাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার, লেগুনা, সিএনজি অটোরিকশা আর রিকশা সবাই আছে রাস্তায়। গতিহীন স্তব্ধ এসব যানবাহনের নীরব উপস্থিতি পুরোদিনে যেন মৃত্যুর শীতলতাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছে গত মঙ্গলবার।
মাঝে মাঝে বৃষ্টি ছেড়ে রোদ উঠেছে, কিন্তু গতি পায়নি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা যানবাহনগুলো। যানজট আর জলাবদ্ধতায় বিপর্যস্ত নগরজীবনের চিত্রটা এমনি ভয়াবহ ছিল যে সেখানে আটকে থাকা বৃষ্টিসিক্ত, নোংরা কাদায় মাখামাখি অভুক্ত মানুষগুলো চাইবেন এ যন্ত্রণা অন্তত ভুলে থাকতে। সকাল দিকে যারা অফিসে পা রাখতে পেরেছেন বলতে গেলে এক অর্থে বেঁচেই গেছেন। তবে ভয়াবহতার শুরু বেলা ১১টা থেকে, যেখানে মাত্র দেড় ঘণ্টার ৪২ মিলিমিটার বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় ঢাকার প্রায় পুরোটাই। মিরপুর থেকে শুরু করে শ্যামলী কল্যাণপুরের প্রায় সব অলিগলি, জাতীয় সংসদ ভবনের সামনের পুরো রাস্তা, শুক্রাবাদ, গ্রিন রোড, ইন্দিরা রোড, পরীবাগ, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, গার্ডেন রোড, মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, ধানমণ্ডি, পান্থপথ, সোনারগাঁও হোটেল বাদ যায়নি কোনো এলাকাই।
অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে উদ্বোধন করা হাতির ঝিল এলাকাতেও কাল দেখা গেছে দুর্ভোগের অন্যরকম এক চিত্র। পানি বের হওয়ার পথগুলো দখল হয়ে যাওয়া কিংবা আবর্জনায় বন্ধ হয়ে থাকায় অল্প সময়ে অতিবৃষ্টির ধকল সইতে পারেনি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই জলজট নিরসনে ব্যর্থ দুটি সংস্থা ডিসিডি এবং ওয়াসা এ ক্ষেত্রে তাদের নির্লজ্জ ব্যর্থতা ঢাকতে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়েছে ঢাকা ও তার চারপাশের নদীগুলোর অর্থাৎ বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যার উচ্চতা বেড়ে যাওয়াকে। অন্যদিকে হাতিরঝিল থেকে যে পথে পানি নিষ্কাশিত হয় সে পথে পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়েছে বলেও দাবি তাদের। বর্ণনার সময় অনেকে বাংলার সিঙ্গাপুর এমনকি সিডনি বলে বসা এ হাতিরঝিল প্রকল্পের সাথে এখনো তেমন কোনো সংযোগ তৈরি করা হয়নি যা দিয়ে কারওয়ান বাজারের পানি নিষ্কাশন সম্ভব হয়। এ জন্য কাওরান বাজারের মধ্যে সন্ধ্যার সময়ও পানি জমে থাকতে দেখেছি আমি নিজেই।
ডিসিসির পাশাপাশি জলজট নিরসনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে ওয়াসাও দায় এড়ানোর অলিগলি খুঁজতে চাইছে। গতকাল ভয়াবহ জলাবদ্ধতার জন্য অতিবৃষ্টি ছাড়াও ঢাকা ও চারপাশের নদীগুলোর পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করেছে তারা। তাদের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মহোদয় (ডিএমডি) একটি দৈনিকে প্রকাশিত মন্তব্যে জানিয়েছেন বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালুসহ ঢাকা ও চারপাশের নদীগুলোর উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণে পানিনিষ্কাশন পাম্প চালু করতে হয়েছে পুরোপুরি। রামপুরা স্লুইসগেটের কাছে পাম্পিং স্টেশন চালু রাখা হয়েছে সার্বক্ষণিকভাবে। এ ছাড়া ধোলাইখাল, কল্যাণপুর ও গোড়ান চটবাড়ীতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পাম্প চালু রাখা হয়। জনপদে অস্থায়ী ১৫টি পাম্প চালু ছিল।
অবাক করার বিষয় হচ্ছে তাঁর বক্তব্যে দেখা গেছে অভিযোগের সুর। তিনি বলতে চাইছেন আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে বৃষ্টিপাতের যে পরিমাণের কথা বলা হয়েছে, তার চেয়ে ঢের বর্ষণে কবলিত হয়েছে ঢাকা। তাই নাকি ঢাকা ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনের ড্রেনেজ ব্যবস্থা এ অতিবৃষ্টির সঙ্গে পেরে ওঠেনি। এহেন জনদুর্ভোগে পতিত নগরবাসী চেয়েছে যন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণ কখনোই দুটি রাষ্ট্রয়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কাদা ছোড়াছুড়ি তারা প্রত্যাশা করে না। এদিকে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল সকার থেকেই দেখাচ্ছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাইদ খোকনের মন্তব্য। তিনি যথার্থই যাচ্ছেতাই জলজট এবং অসহনীয় জনদুর্ভোগের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ না করা এবং তাদের কাজের মধ্যে সমন্বয়হীনতারকে দায়ী করেছেন।
অসহায়ের মতো ভেজা জামাকাপড়ে দাঁড়িয়ে থাকা স্কুলগামী-স্কুল ফেরত শিক্ষার্থীদের মা-বাবাদের যাঁরা গতকাল রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে ভ্যান-রিকশাওয়ালাদের ত্রাহি চিৎকার শুনেছেন -ওই নদী পারাপার ২০ ট্যাকা, নদী পারাপার কোনো মুলামুলি নাই ২০ ট্যাকাই তাঁরা হয়তো মৃত্যু যন্ত্রণার আগে এ যন্ত্রণার দিনটি ভুলতে চাইবেন যেভাবে হোক। স্যুট-কোট-প্যান্ট-টাই পরা যে দপ্তরগামী ভদ্রলোক ভুস করে নেমে গেছেন এক গলা ময়লা পানিতে। যার পারফিউমের সুবাস ওঠা দামি পোশাকে মেখে গেছে মানুষের বিষ্ঠা আর আস্তাকুঁড়ের আবর্জনা তিনি অন্তত কখনোই আরেকবার মনে করতে চাইবেন না এ অভিশপ্ত দিনটিকে। মিরপুর থেকে শান্তিনগর, গাবতলী থেকে নিউমার্কেট কিংবা ফার্মগেইট থেকে আসাদ গেইট এ একই হতাশার চিত্র। গতিহীন গাড়িগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল সেই দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত। মাঝে তারা একটু নড়া চড়ায় যদিও আড়মোড়া ভেঙেছে পুরোপুরি গতিশীল হয়ে উঠতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে তাদের। এত দিন যারা যানজটে গাড়ি আটকেপড়ার পর রাস্তায় নেমে হাঁটতে অভ্যস্থ বাসের জানালা দিয়ে গলা বের করে চারদিকে তাকিয়ে শুধু ফেলেছেন দীর্ঘশ্বাস, কোথায় তাদের প্রিয় ফুটপাত, কোথায় যানজট এড়িয়ে চলার মতো সেই নোংরা দুর্গন্ধময় পথটি।
একের পর এক সেমিনার কিংবা আলোচনা অনুষ্ঠান। শুধু বক্তরা কাপের পর কাপ কফি শেষ করেছেন, একের পর এক লাঞ্চ বক্স গলধঃকরণ করে গলা খাঁকারি দিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন নানা বিষয়ে কিন্তু তাতে যাই হোক সমস্যার বরফ আরো জমাট বেঁধেছে, কথা সত্যি সে বরফ গলেনি এক রত্তি। রাজধানী ঢাকার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা নিয়ে যারা জানেন বোঝেন কিংবা নিদেন পক্ষে খোঁজ খবর রাখেন তাঁরা বলতে পারবেন এর পানি নির্গমণ পথগুলোর সম্পর্কে। নির্দিষ্ট করে কয়েকটি পানি নির্গমন পথের কথা উল্লেখ করা যায়। এর একটি প্রবাহিত হয়েছে মানিকনগরের পাশ দিয়ে। অন্যদিকে মাতুয়াইলের পানি নির্গমন পথে গ্রিন মডেল টাউন গড়ে তৈরি করেছে বিস্তর জটিলতা। কয়েকজন গবেষক বুয়েটের পক্ষ থেকে এর নানা সমস্যা জরিপ ও অনুসন্ধান করে দেখেছেন। তাঁদের হিসেবে এ জায়গা দিয়েই সবচেয়ে বেশি পানি নেমে যেত একটা সময়। তাঁরা গবেষণার ফলাফল পর্যালোচনা করে বার বার সতর্ক করেছেন যে পানি প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে একটি আবাসন প্রকল্প তৈরি করা হলে এইখানে দেখা দেবে যাচ্ছেতাই জলাবদ্ধতা।
তখন আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল যে প্রায় ১০ ফুটের মতো পানি নির্গমনের একটা রাস্তা সেখানে রাখা হবে। আগে ঢাকা শহরের বেশির ভাগ পানি এখান দিয়ে নিষ্কাশিত হতো। মাত্র ১০ ফুট চওড়া রাস্তা পুরো ঢাকার পানি নিষ্কাশনের জন্য যথেষ্ঠ না হলেও কেউ কথা রাখেনি। না রাজউক, না ডিসিসি সবাই একাট্টা আর হয়তো দুর্ভোগের মাত্রাটা এখন এত ভয়াবহ। যে যাই বলুক গবেষকরা দাবি করেছেন সাম্প্রতিক জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য এই জায়গাটা যত দ্রুত সম্ভব উদ্ধার করা প্রয়োজন।
এদিকে যদি ঢাকার পশ্চিম অঞ্চলের দিকে দৃষ্টি যায় এই একই রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে নগরবাসীকে। এ ক্ষেত্রে রাস্তার পাশ দিয়ে যে ড্রেনেজগুলো করা হয়েছে সেখানেও অনেক দখলদারের কালো থাবা। ডিসিসির লক্ষ করা উচিত ছিল অন্তত এ স্থানগুলো যেন দখলবাজির বাইরে থাকে। না হলে শুরুতেই এগুলো থেকে পরবর্তীকালে আরো বড় রকমের জলাবদ্ধতার যে আশংকা করা হয়েছিল, তা আজ মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দুয়ারে কড়া নাড়ছে। পানি যাওয়ার জন্য ১০০ ফুট প্রশস্ত জায়গা রাখার কথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত উল্লেখ করলেও শেষ অবধি প্রাপ্তির ভাঁড়ে ভবানী, আর তার পরিণতি এ উদার বিশাল প্রবাহিনী দূষণগঙ্গা। এর তরল বর্জপ্রবাহ অনর্গল বারিপাতে সয়লাব হয়ে খামচে ধরেছে নাগরিক বেলাভূমি। শুধু প্রবলম্বিত দুর্ভোগ বিবশকারী উদ্বিগ্নতা ভরে আশ্রয় দিয়েছে নগরবাসীকে আরো কয়েকটি দুর্ভাবনার প্রহর। উপযুক্ত কাজকর্মে ডিসিসির নির্মোহ নীরবতা, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতার সামনে উপযুক্ত কুঠারাঘাত হয়ে হাজির এ অতি প্রাকৃতিক জলযোগ। তাই নিশ্চয় যানবাহনে বসে ম্রিয়মাণ বিমূঢ় মানুষগুলো দৃষ্টি দিয়েছে রিস্ট ওয়াচে, কপালে করাঘাত করতে করতে ভাবছে কখন নিষ্ক্রান্ত হয় অভিশপ্ত এ নগরের প্রাণবায়ু।
একের পর এক হতে থাকা সেমিনার সিম্পোজিয়ামে মুখে ফেনা তুলে ফেলা বক্তারা কিন্তু ঠিকই বলেছিলেন পানি নিষ্কাশনের জন্য প্রয়োজনীয় জলাশয়গুলোকে ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া ঘোষণা করা উচিত। কেউ কেউ ঢাকার চারপাশের চারটি গুরুত্বপূর্ণ নদীকে এরই মাঝে ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল জোন হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি পর্যন্ত করেছেন। অবাক বিষয় হলেও সেখানে বলা হয়েছে গুলশান, বনানী, বারিধারা লেক এগুলো ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া। আর সেখানে গুলশান-বারিধারা-বনানীর দুটি সমিতি নাকি কাজ করে অনেক উন্নয়ন সাধন করতে পেরেছে। তবে ঢাকার চারপাশে ইকোলজিক্যালি গুরুত্বপূর্ণ এরিয়া হিসেবে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যার প্রবাহ স্বাভাবিক রাখার বিষয়টি বিশেষ জাদুমন্ত্রবলে এড়িয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। নানা গবেষণা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে একের পর এক দৃশ্যমানতা, বাস্তব অবস্থান ও প্রকৃতিগত দিন পর্যালোচনামূলক প্রকল্প প্রস্তাবনা জমা পড়ছে সেগুলো বিশেষ ফল আনতে পারেনি। ঢাকা ওয়াসা, বিআইডব্লিউটিএ, ভূমি অধিদপ্তর, রাজউক, জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং পরিবেশ অধিদপ্তর এতদিন এতগুলো কাজ করলেও ঠিক থাকেনি নিষ্কাশন ব্যবস্থা।
ঢাকা ওয়াসা তাদের পয়োঃপ্রণালিকে কিভাবে ঠিক রাখবে, বিআইডব্লিউটিএ তাদের কাজকে কীভাবে বাস্তবে রূপ দেবে তা নিয়ে হাজার সমীক্ষা চললেও কাজ হয়নি কিছুই। এখানে বিশেষ করে নদীর গতিপথ পরিচ্ছন্ন রাখা তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলেও সেদিকে দৃষ্টি কোথায়? এ ক্ষেত্রে উচিত ছিল নদীর গতিপথ পরিচ্ছন্ন রাখা, গভীরতা বৃদ্ধি ও নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের মিলেমিশে কাজ করা। কিন্তু তারা যেমন উপযুক্ত কাজ করতে পারেনি, ঢাকা সিটি করপোরেশন তাদের কঠিন বর্জ্যর উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা নিয়ে বার বার দুর্ভাবনার সাগরে খাবি খেয়ে পুরো নগরীকেই পরিণত করেছে এক মূর্তিমান ভাগাড়ে। যে ভাগাড় থেকে যাই হোক বের হয় না ময়লা-আবর্জনা আর এবার সাথে সাথী হিসেবে পেয়েছে দূষিত পানিকেও। প্রথম থেকেই পরিবেশ অধিদপ্তর তার প্রয়োজনীয় কাজ করে নদীকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে চেষ্টা করলে আজ হয়তো এ দুর্ভোগের সামনে পড়তে হতো না নগরবাসীকে।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত যে ঢাকা শহরের প্রায় ৮০ শতাংশ পানি নির্গমন চ্যানেল এখন বন্ধ হয়ে আছে। আপাত দৃষ্টিতে এই চ্যানেলগুলো পরিষ্কার করা সম্ভব হলে সম্প্রতি সৃষ্ট জলাবদ্ধতা দূর করা না যাক অন্তত অনেকটা কমিয়ে ফেলা সম্ভব হতো। একটা বিষয় খেয়াল করা জরুরি ছিল যে আরবান ও রুরাল হাইড্রোলজি তথা গ্রামীণ ও শহুরে পানিব্যবস্থা পুরোপুরিই ভিন্ন। মহানগরী ঢাকায় খুব দ্রুত প্লেইন ও ক্লিন সারফেসে পানি এসে জমা হচ্ছে যেটা গ্রামের বাস্তবতায় পুরো ভিন্ন। এ ক্ষেত্রে আমাদের এখনো যেখানে সুযোগ আছে গাছ লাগানো উচিত ছিল যাতে এই প্রবণতা কিছুটা হলেও কমিয়ে ফেলা সম্ভব হয়। সেটা তো সম্ভব হয়নি উপরন্তু আমরা দেখেছি একের পর সবুজ গ্রাস করতে যে বাড়িঘরগুলো তৈরি করা হচ্ছে সেগুলোর নির্মাণ উপকরণগুলোর ঠাঁই মিলছে ড্রেন থেকে শুরু করে বক্স কালভার্টে গিয়ে। এদিকে একটু খানি পানি জমে থাকার পর নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা পথগুলোর কার্পেটিং উঠে গিয়ে ফুটপাতের ময়লার সঙ্গে সেগুলোও রাস্তা থেকে ড্রেনে গিয়ে পানি চলাচলে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। এগুলোকে প্রতিরোধ করা গেলে প্রচলিত ব্যবস্থার মধ্যে যে সমস্যা নিরসন সম্ভব ছিল সেখানেও হতাশার চিত্র স্পষ্ট।
রাজধানী ঢাকার জলজট নিয়ে সে চিন্তাগুলো নানা গবেষকের মত থেকে এসেছে সেগুলোকে বরাবর অগ্রাহ্য করা হয়েছে। ভূমি দস্যুদের দাপটে একের পর এক গ্রাস হতে থাকা খালগুলোর কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে বক্স কালভার্ট নামের মূর্তিমান অভিশাপ। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু কিংবা শীতলক্ষ্যার মরণ চিৎকার যে নগরবাসী কিংবা প্রশাসন কানে তুলেনি হয়তো এখন সে নগরীর মৃত্যুঘণ্টা বাজলে স্রষ্টাও নীরব-নিশ্চুপ। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ডিসিসির যে ব্যর্থতা, পানি নিষ্কাশন লাইনের বণ্টনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যে সমন্বয়হীনতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পদে পদে যে লালফিতার দৌরাত্ম্য- এর কোনোটাই সাম্প্রতিক জনদুর্ভোগের দায় এড়াতে পারে না। তাই প্রিয় ঢাকা নগরীর এ জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এসে সবার উচিত মিলে মিশে কাজ করা। অন্তত কেউ কাউকে দায়ী না করে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সতর্ক হওয়া। সবার আগে জরুরি ভিত্তিকে পানি নিষ্কাশন লাইনগুলোকে একেবারে প্রান্তভাগ অর্থাৎ নির্গমণ মুখ থেকে শুরু পর্যন্ত পরিষ্কার করা। ভবনের নির্মাণ উপকরণ থেকে শুরু করে গৃহস্থালির আবর্জনা এর কিছুই যেন কোনোমতে ড্রেনে গিয়ে না পড়ে সেদিকে সতর্ক থাকা। পানি যাওয়ার পথ করে দিতে বন্ধ ম্যানহোলের মুখগুলোকে উন্মুক্ত ও পরিষ্কার করে দিতে চেষ্টা করাটাও জরুরি হয়ে উঠেছে এখন। সরকারি, প্রাতিষ্ঠানিক ও নাগরিক প্রতিটি পর্যায়ের সতর্কতা, দ্রুততার ভিত্তিতে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ, সুষ্ঠু রাষ্ট্রীয় নীতিমালা প্রণয়ন ও তার উপযুক্ত বাস্তবায়নই পারে প্রিয় ঢাকা মহানগরীকে এ ভয়াবহ অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে।
লেখক : পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।