ভাষা আন্দোলনের ব্রত
এয়ুরোপ মহাদেশের খ্যাতনামা ফ্রয়েড পথিক মনোবিশ্লেষণ ব্যবসায়ী জাক লাঁকা একদা বলিয়াছিলেন, ইতিহাস মানে ভূত বা অতীত নহে। তাঁহার মতে, ভূতের লেজ যেটুকু বর্তমানে বসিয়া ধরা যায় তাহাই ইতিহাস। এই মন্তব্যের অনেক উপকারিতা আছে। দেশে যখনই রাষ্ট্রবিপ্লব হয় কিংবা সরকার পরিবর্তন বিপ্লবী চরিত্র অর্জন করে তখনই ইতিহাসের নতুন নতুন ভাষ্য হাজির হয়। এই ঘটনার তাৎপর্য মহাত্মা জাক লাঁকার মন্তব্যে কিছুটা ধরা পড়িয়াছে।
সেকালে-পাকিস্তানের আদিপর্বে ভাষার প্রশ্নে যে আলোড়ন উঠিয়াছিল, যাহাকে আমরা ‘ভাষা আন্দোলন’ বলিয়া থাকি-তাহার বয়ান তখন এক প্রকার ছিল আর এখন আরেক প্রকার হইয়াছে। এখন মানে ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি বলিয়া মানিয়া লইয়াছি। ঘটনা যখন ঘটিতেছিল, তখন কিন্তু কেহ ইহাকে স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশ বলিয়া ঘোষণা করেন নাই। পাকিস্তানের ক্ষমতা যাঁহাদের হাতে ন্যস্ত ছিল, তাঁহারা এই আন্দোলনের মধ্যে আদপেই কোনো ন্যায্য দাবি দেখিতে পান নাই। তাঁহাদের চোখে এই আন্দোলন ছিল ভারতের ষড়যন্ত্র। আন্দোলনের নেতা আর হোতাদের তাঁহারা বড়জোর বিপথগামী যুবক কিংবা ভারতের চর বলিয়া প্রচার করিতেন।
বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা, অন্তত তাঁহাদের একাংশ- গোড়া হইতেই পাকিস্তান সরকারের জাতীয় ভাষানীতির বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়াছিলেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্থাপিত হয়। তাহার কিছুদিন আগে-মোতাবেক জুলাই মাসে- আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জিয়াউদ্দীন আহমদ পাকিস্তান রাষ্ট্রের শিক্ষার বাহন ও রাষ্ট্রভাষারূপে উর্দুকে গ্রহণের প্রস্তাব দিয়াছিলেন। তাঁহার যুক্তি ছিল, ভারতেও তো তাহাই করা হইয়াছে। সে দেশে উর্দু ভাষার জায়গায় অবশ্য হিন্দি রাষ্ট্রভাষা হইয়াছে। বাংলাদেশে এই যুক্তির বিরোধিতা করিয়া- অন্যান্যের মধ্যে-দাঁড়াইয়াছিলেন মুহম্মদ এনামুল হক। ১৯৪৭ সালের নবেম্বর নাগাদ প্রকাশিত এক প্রবন্ধে হক সাহেব লিখিয়াছিলেন : ‘বাংলাকে ছাড়িয়া উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা-রূপে পূর্ব-পাকিস্তানবাসী গ্রহণ করিলে তাহাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মৃত্যু অনিবার্য।’ মুহম্মদ শহীদুল্লাহও একই ধরনের কথা বলিয়াছিলেন। মুহম্মদ এনামুল হকের কথা ছিল আরো তীক্ষ্ণ- ‘সমগ্র পাকিস্তানে যদি কোনো ভাষার রাষ্ট্রীয় অধিকার পাইবার যোগ্যতা থাকে, তাহা একমাত্র বাংলা ভাষারই আছে। অন্য কোনো ভাষার নাই।’
পাকিস্তান পক্ষের ধারণা ছিল বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হইলে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হইবে। ইতিহাস দেবতা বড়ই নিষ্ঠুর। রসিকও বটে। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, উর্দু ভাষা চালু করিতে গিয়াই পাকিস্তান আপনকার জাতীয় ঐক্য নষ্ট করিয়াছে। সেকালে উঁহারা বলিতেন, পাকিস্তানে কোনো বাঙ্গালি, পাঞ্জাবি বা বিহারি থাকিবে না। পাকিস্তান হইবে এক জাতি, এক কৃষ্টি। সুতরাং তাহার ভাষাও হইবে এক। উর্দু ভাষা ও মুসলিম সংস্কৃতি হইবে পাকিস্তানি জাতির দুইটি বড় খুঁটি।
এই বক্তব্যটি বড়ই গুছাইয়া বলিয়াছিলেন পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের পাঞ্জাবি মন্ত্রী আবদুর রব নিশতার। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে কোন এক জায়গায় তিনি বলিলেন : ‘এসলাম অঞ্চলভিত্তিক দেশপ্রেম জিনিশটা অনুমোদন করে না।’ তাঁহার মতে, ‘সব মুসলমান একজাতি- এই ধারণা সম্বল করিয়াই পাকিস্তান স্থাপিত হইয়াছিল। তাই নিজেদের বাঙ্গালি, পাঞ্জাবি আর বিহারি বলিয়া যাহারা ভাবিতেছেন তাহারা পাকিস্তানের একেবারে গোড়ায় কুঠারাঘাত করিতেছেন।’ এই মন্ত্রী মহোদয়ের ধারণা, ‘বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করিবার দাবি যাহারা করিতেছেন তাহারা পাকিস্তানের দুশমন আর ভারতের চর হিশাবেই এই দুষ্কর্মে রত হইয়াছেন। তাহাদের ধ্যানধারণা দেশটাকে ধ্বংস করিয়া ফেলিবে, বোঝা যায়, পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করিবার দাবি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ যাঁহারা তুলিয়াছিলেন তাঁহাদের হিন্দু পরিচয় লইয়াই তিনি এই ঠাট্টা করিলেন।
আবদুর রব নিশতার কেন, খোদ পাকিস্তান প্রণেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহও একই কথা বলিলেন। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে তিনি ঢাকা সফর করিলেন। ২১ মার্চ তারিখে প্রকাশ্য ময়দানের এক ভাষণে তিনি ছাত্রদের উপদেশ দিলেন, বিদেশি শত্রুদের কথায় কান না দিতে। তিনি বাংলাকে পূর্ব বাংলার ভাষা বলিয়া মানিয়া লইলেন। তবে বাঙ্গালিদের উপদেশ দিলেন, নবীন পাকিস্তান রাষ্ট্রকে বিপদাপদ হইতে রক্ষাও করিতে হইবে। জিন্নাহ সাহেব সোজা ভাষায় বলিলেন, ‘মুসলিম লীগ উর্দুকে জাতীয় ভাষারূপে গ্রহণ করিয়াছে শুদ্ধমাত্র জাতীয় ঐক্য রক্ষা করিবার মানসে, বিপদাপদ হইতে পাকিস্তানকে বাঁচাইবার অভিলাষে, আর কোনো কারণে নহে।’
উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা বা জাতীয় ভাষা করিবার অপর কারণ মুসলিম ঐতিহ্য অর্থাৎ এসলাম। ২১ মার্চের সভায় জিন্নাহ সাহেব বলিলেন, শুদ্ধমাত্র এসলামই পাকিস্তানকে এক রাখিতে পারে। তাঁহার কথা ছিল এই রকম : ‘এই দেশে আমরা অনেক ভাষায় কথা কহিয়া থাকি। কিন্তু মনে রাখিতে হইবে এই দেশ কায়েম হইয়াছে এসলাম ও মুসলিম ঐতিহ্য সম্বল করিয়া।’ জিন্নাহ সাহেব বলিলেন, ‘নানান ধরনের কৃষ্টি ভেদ পার হইবার স্বার্থে, বিশেষ নানান অঞ্চলের ভেদ ঘুচাইবার প্রয়োজনে দেশে একটি সার্বজনীন ভাষা থাকিতেই হইবে। মুসলিম লীগের আসল কর্তব্য একটি মাত্র- একমেবাদ্বিতীয়ম- পাকিস্তানি জাতি গড়িয়া তোলা।’
জিন্নাহ সাহেব আরেক সমাবেশেও একই কথা বলিলেন। সে ঘটনা তিনদিন পর অর্থাৎ ২৪ মার্চ তারিখে। কিন্তু শ্রোতাদের রাজি করাইতে পারিলেন না। তাঁহার বক্তব্য ছিল সোজাসাপ্টা। বাংলা পূর্ব বাংলার ভাষা হইতেই পারে কিন্তু নিখিল পাকিস্তানের ভাষা হইবে একটি এবং একটি মাত্র। সে ভাষা উর্দু। কেননা উর্দু ভারত উপমহাদেশের মুসলমান জাতির ইতিহাস হইতে জন্ম লইয়াছে।
ঢাকায় দেওয়া জিন্নাহ সাহেবের এই দুই বক্তৃতা অনুসারে পাকিস্তান গড়া হইয়াছিল দুই দুইটা খুঁটির উপর। এক এসলাম, আরেক উর্দু। ইহা যদি সত্য হয় তো আরেক বিপদ। ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট তারিখে তিনি করাচি নগরে পাকিস্তান গণপরিষদে যে ভাষণ দেন তাহাতে বলিয়াছিলেন, রাজনীতি আর আইনের বিচারে পাকিস্তানে মুসলমানে আর হিন্দুতে কোনো ভেদ থাকিবে না। দুইজনেই প্রথমেই পাকিস্তানি, মাঝখানে পাকিস্তানি আর পরিশেষে পাকিস্তানি। সদা পাকিস্তানি। জিন্নাহর করাচি বক্তৃতাকে অনেক ইতিহাসকার তাঁহার ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাবের উদাহারণ বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। এখন ঢাকা বক্তৃতাকে তাহার সহিত মিলাইতে বড় পরিশ্রম হয়।
জিন্নাহর বক্তৃতাই- দুর্ভাগ্যের মধ্যে- শেষকথা ছিল না। ভাষা ও সংস্কৃতি পরিচয়ে বাংলাকে কাবু করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান পক্ষ আরও দুইটা উদ্যোগ নেন। তাহারা এসলামের খাতিরে আরবি হরফে বাংলা লেখার একটি প্রকল্প হাতে নেন।
এ কাজে তাহাদের মুখপাত্র হইলেন বাংলাদেশ হইতে মনোনীত মন্ত্রী- শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান। তিনি ১৯৪৯ সালে প্রস্তাব করিলেন, পাকিস্তানের সমস্ত ভাষাই আরবি হরফে লিখিতে হইবে। ১৯৪৯ সনে সরকার পূর্ব বাংলা ভাষা সংস্কার কমিটি গঠন করে। ১৯৫০ সনে কমিটির প্রতিবেদন বাহির হইল। তাহাতে- অন্যান্যের মধ্যে- সুপারিশ করা হইল, পূর্ব পাকিস্তানের মাধ্যমিক স্তরে এবং উচ্চতর স্তরে দ্বিতীয় ভাষারূপে উর্দু শিক্ষা দিতে হইবে। পশ্চিম পাকিস্তানে বাংলা শিক্ষা করিতে হইবে কি না সে বিষয়ে তাহারা অবশ্য কিছুই বলিলেন না। বলাবাহুল্য, কমিটির উদ্দেশ্য ছিল ‘পাকিস্তানের দুই পাখার মধ্যে ভাষা, সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতির বন্ধন ঘনিষ্ঠতর এবং নিবিড়তর করা।’
পাকিস্তান পক্ষ- শেষ পর্যন্ত- বাংলা ভাষায় আরবি ও পারসি শব্দের সংখ্যা বৃদ্ধি করার প্রয়াস পায়। বিশেষ করিয়া ঢাকা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ প্রচারে নতুন নতুন আরবি-পারসি শব্দ ব্যবহারের এই উদ্যোগ প্রবল বাধার মুখোমুখি হয়। ১৯৪৮ সালের জুলাই নাগাদ পাকিস্তান বেতার কর্তৃপক্ষ এই সিদ্ধান্ত একবার প্রত্যাহার করিতে বাধ্যও হন।
পাকিস্তান গণপরিষদ প্রথম দফায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে অস্বীকার করেন। এই পরিষদের অধিবেশন ঢাকায় ডাকিতেও একইভাবে তাহারা অস্বীকার করিয়াছিলেন। ফলে বাংলাদেশের বিশাল কৃষক সমাজ- যাহারা পাকিস্তানের জন্য প্রাণ দিয়াছিলেন- তাহারা মর্মাহত হইলেন। হইলেন অপর। স্বাধীনতা লাভের প্রথম দশকের মধ্যে বাংলাদেশে জন্মিয়াছেন এমন তিনজন ভদ্রলোক পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হইয়াছিলেন। ইঁহারা যথাক্রমে খাজা নাজিমুদ্দিন, বগুড়ার মোহাম্মদ আলী ও হুসায়েন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষে ঘটনা কি বুঝিয়া লওয়া সহজ ছিল না।
পাকিস্তানের দুই নম্বর প্রধানমন্ত্রী হইবার পর খাজা নাজিমুদ্দিন পহিলাবার ঢাকায় আসিলেন ১৯৫২ সালে। আসার পর ২৭ জানুয়ারি তারিখে তিনিও ভাষণ দিলেন। দিলেন জিন্নাহ যেখানে দিয়াছিলেন সেখানেই। পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখার প্রার্থনা জানাইলেন। অবিকল জিন্নাহ সাহেবের মতো তিনিও বলিলেন, পাকিস্তানে নানান সংস্কৃতি ও নানা প্রদেশের ভেদ ঘুচাইবার হাতিয়ার- এক ও অভিন্ন কোনো জাতীয় ভাষা। জিন্নাহর কসম- তিনি আবার বলিলেন- নবীন জাতির সমস্ত প্রয়োজন মিটাইতে পারে একমাত্র উর্দু ভাষা।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কল্পনাও করিতে পারেন নাই তাঁহার বক্তব্য কোন ধরনের বিস্ফোরণ ঘটাইবে। পশ্চিম পাকিস্তানের যে দুইটি গোষ্ঠী সারা দেশে রাজত্ব করিত সেই পাঞ্জাবি ও মোহাজেরদের মতন পূর্ব বাংলার জমিদার শ্রেণীর প্রতিনিধি খাজা নাজিমুদ্দিনও বলিলেন, বাংলা ভাষার জন্য যাহারা চিৎকার করিতেছেন তাহারা হয় হিন্দুর সন্তান- নয় হিন্দুস্তানের চর। তিনি খেয়াল করিলেন না সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম কমিটির সদস্যদের প্রায় সকলেই মুসলমান নাম বহন করিতেছেন।
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
সলিমুল্লাহ খান : লেখক ও চিন্তাবিদ। অধ্যাপক, ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়।