শিশু নির্যাতন
তারকাখ্যাতির কারণে শাহাদাত কি পার পেয়ে যাবেন?
শিশু গৃহকর্মী নির্যাতনের অভিযোগে এককালের পেস বোলার শাহাদাত হোসেন ও স্ত্রী নিত্যর বিরুদ্ধে মামলার ঘটনাটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নতুন কিছু নয়। খন্দকার মোজাম্মেল হক নামের এক সহৃদয় ব্যক্তি শুধু মামলা করেই তাঁর দায়িত্বটি যেন শেষ করে না দেন, সেটি এখন দেখার বিষয়। বিশেষ করে তারকাদের বিরুদ্ধে মামলা হলে সেদিকে প্রথমে মিডিয়ার দৃষ্টি থাকে, পরে সেখান থেকে মিডিয়া সরে যেতে না যেতেই তারকাখ্যাতি কাজে লাগানো হয় অপরাধের দায়মুক্তি ঘটাতে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন অনলাইন দৈনিকে প্রাপ্ততথ্যে প্রথম থেকেই হতাশার চিত্র স্পষ্ট মনে হয়েছে। বিশেষ করে শাহাদাত ও নিত্যের অত্যাচারে ঢামেকে গৃহকর্মী শিশুটি যখন মৃত্যুর প্রহর গুনছে ঠিক তখনই তাঁকে গ্রেফতারের জন্য খুঁজছে পুলিশ। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে অনেকগুলো অনলাইন পত্রিকা জানাচ্ছে মিরপুর থানার দায়িত্ব পালনরত কর্মকর্তা নাকি বলেছেন মামলার পর শাহাদাত হোসেনের বাসায় পুলিশ গিয়ে তাঁকে পায়নি। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে এ বিষয়ে শাহাদাত হোসেন একটি দৈনিককে দেওয়া বক্তব্যে বলেছেন, মেয়েটিকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়নি। সে নাকি পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়েছে এবং তাঁর ভাষ্যমতে, গতকাল সকাল থেকে মেয়েটি নিখোঁজ ছিল।
এদিকে ঘটনায় আরেক ধূম্রজাল সৃষ্টি করেছে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মিরপুর থানায় নিপীড়ক শাহাদাত ও তাঁর স্ত্রী নিত্যের পক্ষ থেকে করা একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি)। এখন আইন-আদালত যদি এগুলোকে আমলে নিয়ে শাহাদাতকে রক্ষা করার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, সেখানে মানবাধিকার সংস্থাগুলো কী করবে সেটা দেখার বিষয়। তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাঁরা অসহায় শিশুটির শরীরে নানা স্থানে আঘাতে চিহ্ন দেখতে পেয়েছেন যা অবশ্যই পড়ে গিয়ে পাওয়া আঘাতের চিহ্ন নয়। অনেকগুলো অনলাইন পত্রিকা থেকে শুরু করে প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য থেকে জানা গেছে, একসময়ের নন্দিত ক্রিকেটার পরে অফফর্মে যাওয়া শাহাদাত ও তাঁর স্ত্রী শিশুটির ওপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা এতদিনে অর্জিত তারকাখ্যাতি, বাংলাদেশের প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান বিসিবির পক্ষ থেকে সুপারিশ কিংবা মিডিয়ার প্রভাব কাজে লাগিয়ে বিষয়টিকে ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করবেন এটা স্বাভাবিক। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কারো থেকে সহায়তা নিয়ে মামলাটিকে হিমাগারে পাঠিয়ে দিয়ে আইনজীবীদের সহায়তায় একটা জামিন বের করতে পারলেই কেল্লা ফতে-এমনটাও হতে পারে।
শাহাদাত ও তাঁর স্ত্রী নিত্যের পাশবিক নির্যাতনের যে চিহ্ন শিশুটির শরীরে থেকে গেছে, তা থেকে দায়মুক্তি ঘটার সুযোগ নেই। অপরাধীর অজুহাতের যেমন অভাব থাকে না, তেমনি তেমন কিছু প্রমাণ থাকে যা তাকে উপযুক্ত শাস্তির দুয়ারে পৌঁছে দিতে পারে। বিশেষ করে নিপীড়নের শিকার ওই শিশুর শরীরের অধিকাংশ স্থানই বেশ ক্ষতিগ্রস্ত। ফেসবুকে অনেক প্রত্যক্ষদর্শী যে ছবি শেয়ার করেছেন, সেখানে তার শরীরের নানা স্থান আঘাতের প্রভাবে নীল হয়ে থাকা থেকে শুরু করে ফোলা জখমের চিহ্ন ধারণ করছে। তার ডান পায়ে গরম খুনতির ছেঁকা দেওয়ার দাগ স্পষ্ট দেখা যায়। এদিকে তার পুরো পিঠে বেতের বাড়ি মারার অনেক দিনের পুরোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকের কাছ থেকে শোনা গেছে, শিশুটিকে কমোডে মুখ ঠেসে ধরে শাস্তি দেওয়া, রেস্টরুমে দরজা বন্ধ করে নির্যাতন করা কিংবা স্টোর রুমের মধ্যে আটকে রেখে কষ্ট দেওয়ার কথাও। এর পাশাপাশি সামান্য অপরাধেই চড় থাপ্পড় থেকে শুরু করে অভুক্ত রাখার ঘটনাও শিশুটির সঙ্গে ঘটেছে হরহামেশা। আর তার পরিণতিতে প্রাণ শঙ্কায় পালিয়েছে সে শাহাদাতের বাড়ি থেকে, মৃত্যুর সঙ্গে সে লড়ছে এখন ঢামেকের সিসিইউতে।
সম্প্রতি বিশ্ব ও বাংলাদেশের দৃশ্যপট বিচার করতে গেলে হতাশা ও দীর্ঘশ্বাসের চিত্র দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে ওঠে। সিলেটে রাজন নামের সেই ছেলেটি, তস্করের দল তাকে প্রকাশে পিটিয়ে হত্যা করল, আরেক শিশুকে মাথা থেঁতলে দিল থান ইঁটের আঘাতে। এদিকে খুলনায় শিশু রাকিবের পায়ুপথে বায়ু প্রবেশ করিয়ে পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করার রেশ কাটতে না কাটতেই তুরস্কে সাগরের তীর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে শিশু আয়লান কুর্দির লাশ। এদিকে রাজধানীর প্রতিটি হোটেলে কর্মরত শিশুদের ওপর প্রতিদিন নানা অছিলায় চলছে নির্যাতন। পাশাপাশি টেম্পো, লেগুনা, ভ্যানগাড়ি, ঠেলাগাড়ি থেকে শুরু করে বাস ও মিনিবাসের ঝুঁকিপূর্ণ পেশাতেও যুক্ত হতে দেখা গেছে অনেক শিশুকে।
বিভিন্ন মোটর গ্যারেজ থেকে শুরু করে ঝালাইয়ের বিপজ্জনক কাজে যুক্ত শিশুর সংখ্যাও কম নয়। এ ক্ষেত্রে তারা যে ধরনের কাজে যুক্ত থাকে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার জরিপ বলছে তাদের স্বাভাবিক বিকাশ প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে। সে ক্ষেত্রে মালিক যদি সহনশীল হয়, অন্তত তাদের যন্ত্রণার প্রতি খানিকটা সংবেদনশীল হয়ে থাকে তবে কিছুটা দায়মুক্তি ঘটানো সম্ভব। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখা গেছে অন্যথা হচ্ছে বেশি। এ ধরনের অনেকগুলো বিষয় আমলে নিয়ে কলামিস্ট তৌহিদ ফিরোজী একটি নিবন্ধই লিখেছিলেন ‘Bangladesh under the paedophile’ শিরোনামে। সেখানে তিনি কোনো ভনিতা না করে বলেই ফেলেন ‘As the pernicious tentacles of paedophilia reach out to developing nations, where desperation drives people to cross the line of sanity quite regularly, the need to concentrate more on the perverted aspects of sexuality rises. Today, we find a child-porn maker, tomorrwo there may be the discovery of another filmmaker producing fetishist videos focusing on sadistic pleasures. The cardinal rule of pornography is that unless it’s regulated, sinister branches will form.’। আর আজ শাহাদাত ও তাঁর স্ত্রীর অপকর্মে মনে হচ্ছে ফিরোজী অবাস্তব কোনো কথা বলেননি সেদিন। অন্তত শিশুটিকে যেভাবে নির্যাতন করেছে, শাহাদাত ও তাঁর স্ত্রী সেখানে শুধুমাত্র মারপিটের বিষয়টিই নয় পাশাপাশি উঠে আসা উচিত তাদের ‘স্যাডিস্ট সেক্সুয়াল প্লেজার ফ্রম হিউমুলেশান’-এর বিষয়টি।
পশ্চিমে এ ধরনের ঘটনা হরহামেশা ঘটছে বলে সেখানে এগুলোকে বিচারিক প্রক্রিয়ায় আনার ক্ষেত্রে আরো সতর্ক হয়েছে তারা। এগুলোকে নিছক মারধরের ঘটনা মনে করে ছাড় দেওয়ার ফলে আরো বাড় বেড়ে যাচ্ছে অপরাধীদের। বিশেষ করে পশ্চিমে সাধনার অংশ হিসেব নির্বিচার নিপীড়ন চালানো হয় নারী ও শিশুদের ওপর। এ ক্ষেত্রে বন্ডেজ থেকে শুরু করে গ্যাংরেপ তাদের সবচেয়ে বড় পাশবিকতার পরিচয় বহন করে। তারা যৌনতা ও অর্গাজমের মেটাফিজিক্যাল একটি তত্ত্ব হাজির করেছে। তাদের ধারণা, অর্গ্যাজমের সময় নিঃসৃত অ্যান্ড্রেনালিন হরমোনের পরিমাণ বাড়িয়ে নেওয়া সম্ভব হলে খুব সহজেই একজনের পক্ষে অনেক অসম্ভবকে জয় করা সম্ভব হবে। আর এ ধারণাকে সামনে রেখেই তারা মেতে ওঠে বিবিধ পাশবিকতায় যা আমি উল্লেখ করেছি ‘ইলুমিনাতি’ শীর্ষক গ্রন্থে (This philosophy of manifesting one’s thoughts into physical reality is nothing new, and is a popular idea in New Age circles and self-help books. The vast majority of people who practice visualisation and manifestation simply do so by meditation techniques, but it is believed that a highly guarded secret in the occult and the Illuminati is that this visualisation and manifestation technique is dramatically amplified by involving some kind of sexual rituals. This sexual technique is then amplified by involving violence at the same time. By overloading the mind with adrenaline produced from viciously raping an innocent child, the Illuminati believe that this type of sexual ritual unlocks magical and metaphysical aspects of the human mind, allowing them to literally and physically alter their experience of reality.)
বাংলাদেশে কোনো ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত হলে তারপরের চিত্র অনেকের কাছেই স্পষ্ট। সেখানে দেখা যায়, রাজনৈতিক প্রভাব কিংবা তারকাখ্যাতি কাজে লাগিয়ে একের পর এক উৎরে যাচ্ছে চিহ্নিত অপরাধীরা। এখানে শুরু থেকে শাহাদাত ও তাঁর স্ত্রীর কুকীর্তি নিয়ে যা ঘটতে দেখা গেছে সেখানে এ আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অন্তত দেশের একজন নাগরিক হিসেবে ন্যায়বিচার পাওয়াটা প্রত্যেকের অধিকার। এর আগে আরেক ক্রিকেটারের বিরুদ্ধে তাঁর লিভ টুগেদার পার্টনার অভিনেত্রী হ্যাপির করা মামলায় কিছু না হোক অন্তত আদালতের চৌকাঠে পা রাখতে হয়েছে। এমনকি জামিন অযোগ্য মামলা হওয়ার ফলে দু-একদিন চৌদ্দশিকের ভাতও খেতে হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মিডিয়ায় অনেক আলোচনা-সমালোচনার পর দেখা গেছে অখ্যাত সেই অভিনেত্রী হয়ে গেছেন অনেক বিখ্যাত এবং শেষ পর্যন্ত যোগ দিয়েছেন তাবলিগে। আর নিপীড়ন নিয়ে ওই ক্রিকেটারের সে মামলা আবেগ অনুরাগে হোক, চাপে পড়ে হোক উঠিয়েও নিয়েছেন তিনি। আর একজন ক্রিকেটার হিসেবে শাহাদাতের প্রভাব এ ক্রিকেটারের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় বলে আশঙ্কাটা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
বিশ্বের নানা দেশে তারকাদের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা হরহামেশা ঘটতে দেখা গেছে। হলিউড-বলিউড-টালিউড-কলিউডের অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী এমন অপকর্ম করে উপযুক্ত শাস্তির আওতায় এসেছেন। সঞ্জয় দত্ত, ফারদিন খান, শাইনি আহুজা, অজয় জাদেজা, দিনেশ মঙ্গিয়া, শ্রীশান্ত, বিনোদ কাম্বলির বিরুদ্ধে এমনি অভিযোগ আসায় তাঁরা শাস্তির আওতায় এসেছেন। সম্প্রতি শাস্তির মেয়াদ হয়েছে অনেক পাকিস্তানি ক্রিকেটারের। বলে রাখা ভালো ম্যাডোনা, শাকিরা, লেডি গাগা, আনা হ্যাথওয়ে, মাইলি সাইরাস কিংবা লিন্ডসে লোহানের মতো তারকারাও যেখানে অপরাধ করে ছাড় পাননি; সেখান থেকে শিক্ষা নিতে পারে বাংলাদেশ। তাই শিশু নিপীড়ন করে কিছুতেই শাহাদাত যেন ছাড় না পায় সেটাই এখন মুখ্য। অন্তত সবার আগে ভেবে দেখতে হবে তাঁর বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধের অভিযোগ রয়েছে, এই অভিযোগ হলো শিশুকে শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ। আবারও বলছি, শাহাদাতের ক্ষেত্রে যেন তারকাখ্যাতি পাপের দায়মুক্তির কারণ না হয়, এটাই সবার প্রত্যাশা।
লেখক : পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।