অভিমত
দুর্বৃত্তায়িত সমাজে চিকিৎসক অন্য গ্রহের কেউ নন
চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে রাইফা নামের এক শিশুর মৃত্যুর পরে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান ও জরিমানা এবং তার পরে মহানগরীর সব বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা বন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ৯ জুলাই হাইকোর্ট বলেছেন, দেশে ডাক্তারি পেশা দুর্বৃত্তের পেশায় পরিণত হয়েছে। এই কথায় চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা গোস্বা হয়েছেন। হওয়ারই কথা। কারণ দুর্বৃত্তায়িত হয়নি, এ রকম একটি পেশার কথাও কি আমরা এই সময়ে বলতে পারব?
মহান পেশায় ব্রত শিক্ষকরা সবাই কি ধোয়া তুলসী পাতা ? তাদের মধ্যে দুর্বৃত্ত নেই? ব্যবসায়ীদের মধ্যে দুর্বৃত্তের সংখ্যা যে বেশি, সে বিষয়ে নিশ্চয়ই কেউ দ্বিমত করবেন না। সুতরাং এ নিয়ে কথা বলে অযথা সময় নষ্ট করার মানে হয় না।
একটু ওপরের দিকে থুতু ফেলি। আমরা সাংবাদিকরা সবাই কি ধোয়া তুলসী পাতা ? এখানে দুর্বৃত্ত নেই? বছর কয়েক আগেও আর্থিক টানাপড়েনে ছিলেন; নুন আনতে পান্তা ফুরাত, কিন্তু এখন ঢাকা শহরে একাধিক ফ্ল্যাটের মালিক—এ রকম সাংবাদিক কি আমাদের পরিচিতজনের মধ্যে নেই?
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে দুর্বৃত্তের সংখ্যা কত? এই পরিসংখ্যান বের করতে গেলে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হবে। আইনজীবীদের মধ্যে কতজন নিপাট সৎ ও ভদ্র মানুষ আর কতজন দুর্বৃত্ত—সেই হিসাব বের করা সম্ভব ? সজ্জন মানুষের সাদা পোশাক পরে ঘুরে বেড়ানো হাজার হাজার মানুষ ভেতরে ভেতরে দুর্বৃত্ত।
আমাদের সমাজই পেশাজীবীদের দুর্বৃত্ত হতে উৎসাহ দেয়। বিশেষ করে আইনি সুরক্ষা আর কথিত সরল বিশ্বাসে কৃত অপরাধের মার্জনার সুযোগ নিয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটা বড় অংশই দুর্বৃত্ত। বিশেষ করে সেবাদানকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। যে জনগণের পয়সায় তাদের বেতন হয়, তাদের সেবা দিতে গিয়েই তাঁরা নির্লজ্জের মতো ঘুষ চান।
এ রকম ভদ্রলোকের সংখ্যা সরকারির অফিসে গেলে প্রতি টেবিলেই পাওয়া যাবে। সুতরাং শুধু দুর্বৃত্ত বলে চিকিৎসকদের প্রান্তিক করে ফেলার সুযোগ নেই।
সম্ভবত উচ্চ আদালত এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন প্রতীকী অর্থে। কেননা, পান থেকে চুন খসলেই চিকিৎসকদের, বিশেষ করে ইন্টার্ন ডাক্তারদের ধর্মঘটের খবর নিয়মিত সংবাদ শিরোনাম হয়। ভুল চিকিৎসায় অথবা অবহেলায় রোগীর মৃত্যু হলে তার স্বজনরা উত্তেজিত হবেন, এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তারা চিকিৎসা বন্ধ করে দেবেন। হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ছেড়ে রাস্তায় এসে মিছিল করবেন।
তবে এটা ঠিক যে, চিকিৎসকদের এই দুর্বৃত্ত হওয়ার পেছনে রাজনীতির দায়ও কম নয়। রাজনীতির নোংরা খেলা একজন চিকিৎসককে দুর্বৃত্ত হতে বাধ্য করেছে। এ রকম ঘটনা বাংলাদেশে এই প্রথম ঘটল, নিশ্চয়ই তা নয়। বরং অতীতের বিভিন্ন সরকারের আমলে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা এ রকম রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের শিকার হয়েছেন। কিন্তু অপবাদটা চেপেছে তাদের ঘাড়েই।
অন্যান্য পেশার যে দুর্বৃত্তায়ন, সেখানেও রাজনীতি তার দায় এড়াতে পারে না। একজন সিবিএ নেতা বা কর্মচারী ইউনিয়নের নেতা, যার বেতন সর্বসাকল্যে ৩০ হাজার টাকা, যখন তিনি তার মেয়ের বিয়েতে হাজার মানুষকে নিমন্ত্রণ করেন বা কোনো সিনিয়র রাজনৈতিক নেতা তার এলাকায় গেলে সোনার প্রতীক উপহার দেন—তখনো আমরা তার পয়সার উৎস জানতে চাই না। এই জানতে না চাওয়ার ফলে তিনি দুর্বৃত্ত থেকে মহাদুর্বৃত্তে পরিণত হন এবং সেই লোকই একসময় জনগণের ভোটে জনপ্রতিনিধি কিংবা আইনপ্রণেতা হয়ে জাতীয় সংসদে গিয়ে দেশ ও জনগণের ‘কল্যাণ’ করেন।
সুতরাং এই যে সিস্টেম—তার বাইরে চিকিৎসক, সাংবাদিক, শিক্ষক, সরকারি কর্মচারী কেউই বাদ নন। সবাই দুর্বৃত্তায়িত সমাজের একেকটি বিষফোঁড়া। পক্ষান্তরে, এই দুর্বৃত্তায়নের বাইরে থাকা গরিষ্ঠ জনসাধারণই এই লঘিষ্ঠ শ্রেণির দাপটে কোণঠাসা। এক হাজার দুর্বৃত্তের ধমকে এক কোটি মানুষ চুপ করে থাকে।
লেখক : সাংবাদিক।