হলি আর্টিজান চার্জশিট ও জঙ্গিবাদের অ্যান্টিবায়োটিক
ঘটনার দুই বছরের বেশি সময় পরে রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলা মামলার চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ—যেখানে আটজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। যদিও এই হামলার সঙ্গে কোনো আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন, বিশেষ করে আইএসের সম্পৃক্ততা নেই বলে পুলিশ যে দাবি করছে, তা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে এবং হবে।
স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার রাতেই আইএস ওই ঘটনার দায় স্বীকার করে এবং এর পরেও বিভিন্ন সময়ে তাদের মুখপত্রে বিষয়টি উঠে এসেছে। আন্তর্জাতিক জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ বিশ্লেষকরাও এ বিষয়ে একমত, কোনো আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর সহায়তা ছাড়া এত বড় হামলা অসম্ভব। বিশেষ করে হামলার যে ধরন বা স্টাইল, তার সঙ্গে আইএসের হামলার যথেষ্ট মিল রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এই জঙ্গি হামলার সঙ্গে ২১ জনের সম্পৃক্ততা পেলেও বিভিন্ন অভিযানে ১৩ জন নিহত হওয়ায় তাদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে ওই ঘটনায় আলোচিত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি বলেও জানিয়েছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। হলি আর্টিজান বেকারিতে নিহত বাবুর্চি সাইফুল ইসলাম চৌকিদার এবং সহকারী বাবুর্চি জাকির হোসেন শাওনের সম্পৃক্ততাও পায়নি পুলিশ। ফলে এই তিনজনের পরিবার এত দিন যে সামাজিক ও মানসিক চাপে ছিল, সেটি দূর হলো। কেননা সাইফুল ও শাওন নিহত হলেও তাদের সঙ্গে জঙ্গিদের সম্পৃক্ততা ছিল কি না, তা নিয়ে একধরনের ধোঁয়াশা ছিল।
জঙ্গিবাদের আরেক নাম সহিংস চরমপন্থা বা Violent Extremism, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইর সংজ্ঞা অনুযায়ী, রাজনৈতিক, আদর্শিক, ধর্মীয় বা অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সন্ত্রাসবাদকে উৎসাহিত করা বা সরাসরি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়াই সহিংস চরমপন্থা।
এযাবৎ বিশ্বের ৪০টি দেশে অন্তত একবার এই সহিংসতার শিকার হয়েছে। এসব দেশের সরকার চরমপন্থা নিরসন ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ফলে সৃষ্ট বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে। এমনকি সহিংস চরমপন্থা মোকাবিলা করতে গিয়ে সরকারের অন্যান্য উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বরাদ্দ কমানো হয়েছে।
একটা সময় পযন্ত এটি বিশ্বাস করা হতো যে, সহিংস চরমপন্থা মূলত ধর্মীয় বিষয়। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা, বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধানে এখন এটি প্রমাণিত যে সহিংস চরমপন্থার পরিবেশ তৈরির জন্য রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ধর্মীয় ভুল ধারণা, লিঙ্গ- সম্পর্কসহ নানাবিধ কারণ রয়েছে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপির সহিংস চরমপন্থা প্রতিরোধ সংক্রান্ত কনসেপচুয়েল ফ্রেমওয়ার্ক) এ জন্য কয়েকটি কারণকে চিহ্নিত করে। যেমন : অর্থনৈতিক বঞ্চনা ও নাগরিকদের স্বাধীনভাবে চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা; সংকুচিত নাগরিক অধিকার ও নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র যেখানে গণতান্ত্রিক কাঠামোতে নাগরিক অংশগ্রহণ প্রান্তিক পর্যায়ে অবস্থান করছে; সমাজে বৈচিত্র্য বিকাশে বাধাদান; বিচার ব্যবস্থায় অন্যায্যতা, দুর্নীতি ও নাগরিকদের বিশেষ গোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য অব্যাহত রাখা; নাগরিকদের নিরাপত্তা প্রদানে রাষ্ট্রের অনীহা বা ব্যর্থতা।
ফলে এখন প্রশ্ন হলো, দুই বছর পরে হলেও দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জঙ্গি হামলা মামলার চার্জশিট দেওয়া এবং বিভিন্ন অভিযানে শীর্ষ জঙ্গি হিসেবে পরিচিতরা নিহত হলেও যেসব কারণে একটি সমাজ ও রাষ্ট্রে জঙ্গিবাদ বিকশিত হয়, সেসব কারণ এ মুহূর্তে বিদ্যমান আছে কি না এবং যদি থাকে তাহলে তা দূর করতে রাষ্ট্র কী ব্যবস্থা নিচ্ছে? কেননা জঙ্গিবাদ বা সহিংস চরমপন্থা বিকশিত হওয়ার মতো কারণ বিদ্যমান রেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান কিংবা কতিপয় ব্যক্তির বিচারের মধ্য দিয়ে একটি রাষ্ট্রকে পুরোপুরি জঙ্গিবাদমুক্ত করা অসম্ভব। বরং এসব বিচারিক প্রক্রিয়া কিংবা আইনি তৎপরতা প্যারাসিটামলের মতো সাময়িকভাবে জঙ্গিবাদের মাথাব্যথা উপশম করলেও এটি অ্যান্টিবায়োটিক নয়।
জঙ্গিবাদ নির্মূলের আরেকটি বড় হাতিয়ার সমাজে সহনশীলতা ও ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ানো। এই কাজে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। কেননা ঘরের ভেতরে একজন শিক্ষার্থী যা কিছুই করুক না কেন, সেটি অভিভাবকের নজরদারিতেই থাকে। কিন্তু দিনের একটা বড় সময় সে কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকে। বিচিত্র লোকের সঙ্গে তার বন্ধুতা ও সখ্য হয়। এখন আরেকটি বড় ‘বিপদ’ ইন্টারনেট। হাতে স্মার্টফোন থাকায় কে কখন ইন্টারনেটে ঢুকে কোন জগতে খেয়ালে-বেখেয়ালে পা রাখছে, তা বলা মুশকিল। ফলে শিক্ষা কারিকুলামেই এখন গণতন্ত্র, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা, জীবনকে ভালোবাসা, অন্যের ধর্ম-মত ও বিশ্বাসকে সম্মান করতে শেখানোর অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। কোনো শিক্ষাব্যবস্থা চরমপন্থাকে উসকে দিচ্ছে কি না বা অন্য ধর্ম-মত ও বিশ্বাসের প্রতি অশ্রদ্ধার জন্ম দেয় কি না, তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রেরই।
শুধু ‘জঙ্গিবাদকে না বলুন…জঙ্গিবাদ হারাম…মানুষ হত্যা মহাপাপ’—এ জাতীয় স্লোগান লেখা ব্যানার প্ল্যাকার্ড বা পোস্টার জঙ্গিবাদ নির্মূলে খুব একটা কাজে আসবে বলে মনে হয় না। বরং একজন ব্যক্তির মনোজগতে কখন কীভাবে কোন পরিস্থিতিতে সহিংসতার বীজ রোপিত হয়, তা জানা কঠিন। খুব সামান্য কোনো ঘটনাও একজন মানুষকে সহিংস করে তুলতে পারে। কোনো একটি অন্যায্যতা বা অবিচারের ঘটনাও পুরো সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি মানুষের অশ্রদ্ধা তৈরি করতে পারে এবং ভেতরে ভেতরে সে সহিংস উঠতে পারে। ফলে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও আইনি লড়াইয়ের চেয়েও আদর্শিক লড়াই অনেক বেশি কার্যকর, শক্তিশালী ও প্রয়োজনীয়।
কীভাবে এই সহিংস চরমপন্থা প্রতিরোধ করা যায়, তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে। তবে মোটা দাগে কিছু বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা একমত। যেমন :
১. রাষ্ট্রে আইনের শাসন ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা;
২. দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং দুর্নীতি প্রতিকারে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ;
৩. চরমপন্থার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে বেকারত্ব নিরসনে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ;
৪. নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা;
৫. সামাজিক সংলাপের মাধ্যমে ভিন্নমতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ
৬. ধর্মীয় নেতৃবৃন্দকে সম্পৃক্ত করে সংলাপ সংস্কৃতির বিকাশ;
৭. মানবাধিকার সমুন্নত করা ও সমাজে বৈচিত্র্য উৎসাহিত করা, কোনো নির্দিষ্ট অংশকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রান্তিক বা অচ্ছ্যুৎ করে না ফেলা;
৮. পরমতসহিষ্ণু সমাজ গঠন ও মানবাধিকার সুরক্ষায় গণমাধ্যমের কার্যকর ভূমিকা উৎসাহিত করা;
৯. ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে যুবসমাজকে শান্তি, সম্প্রীতি ও মানবাধিকারের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা।
হলি আর্টিজান হামলায় আন্তর্জাতিক কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দাবি করলেও দেশের ভেতরে যে বিদেশি শক্তির তৎপরতা আছে, সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। কেননা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হলি আর্টিজান হামলার আগে বিভিন্ন সময়ে অনেক লোককে গ্রেপ্তারের পরে তাকে আইএসের দেশীয় এজেন্ট, রিক্রুটার ইত্যাদি পরিচয় দিয়েছে। তা ছাড়া আইএস কোনো চেইনশপ নয় যে এখানে তার দৃশ্যমান সাইনবোর্ড সংবলিত স্থাপনা থাকবে। আইএস একটি মতবাদ বা আদর্শ। সেটি যেকোনো সময় যে কারো মধ্যে ক্রিয়াশীল হতে পারে। তা ছাড়া ইন্টারনেটে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে সিরিয়ায় ‘হিজরত’ করার মতো উদাহরণও আমাদের দেশে রয়েছে। সুতরাং হলি আর্টিজান হামলায় আইএস জড়িত কি জড়িত নয়—তার চেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশ আরো অনেক আগেই আন্তর্জাতিক জঙ্গি নেটওয়ার্কের আওতায় চলে গেছে। সুতরাং এটি অস্বীকার করে খুব একটা ফায়দা নেই। বরং এই বিপদ থেকে দেশ ও মানুষকে কীভাবে বাঁচানো যায়—তার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণই বুদ্ধিমানের কাজ।
আমীন আল রশীদ : সাংবাদিক ও লেখক।