অষ্টম বিভাগ
প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণে গতি পাক উন্নয়ন
বাংলাদেশের অষ্টম বিভাগ হিসেবে যাত্রা শুরু করছে ময়মনসিংহ। ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর ও নেত্রকোণা- এ চার জেলা নিয়ে দেশের অষ্টম বিভাগ হিসেবে ময়মনসিংহের যাত্রা শুরু। সরকারি হিসেবে এক কোটি ১৩ লাখ ৬৯ হাজার জনসংখ্যার ময়মনসিংহ বিভাগের ভৌগোলিক আয়তন হবে ১০ হাজার ৫৮৪ বর্গকিলোমিটারের মতো। সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সভায় নতুন এ প্রশাসনিক বিভাগ গঠনের চূড়ান্ত অনুমোদন বিশ্লেষক ও জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। তবে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, যানজট আর জলজটে যখন রাজধানী ঢাকায় জনজীবন বিপর্যস্ত তখন ঘোষণাটি নিঃসন্দেহে আমাদের আশাবাদী করে। অন্তত নতুন বিভাগ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হিসেবে যদি প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়টিকে নিশ্চিত করা যায়- তবে এ সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে আমাদের আশাবাদী করার মতো।
অপ্রতুল সম্পদের অপরিকল্পিত বিন্যাস ও পরিমিত সম্পদের বেহিসেবী ব্যবহারে দিনকে দিন আমাদের দেশ বসবাসের অনুপযুক্ত করে দিচ্ছে। দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে দিনের পর দিন জনসংখ্যা বেড়ে গিয়ে নাকাল করে দিচ্ছে জনজীবন। সময়ের প্রয়োজন মেটাতে মানুষ জড়ো হচ্ছে রাজধানীতে- যা সেখানকার পরিবেশকে করে দিচ্ছে অসহনীয়। ফলে একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড সরিয়ে নানা স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে উপযুক্ত বিন্যাস করার দাবি উঠেছে দীর্ঘদিন থেকে। রাজধানী ঢাকার ওপর থেকে চাপ কমাতে ময়মনসিংহ বিভাগ সৃষ্টির প্রথম প্রস্তাবনা এসেছিল। পাশাপাশি অবকাঠামোগত দিক বিচার করলে ময়মনসিংহে একটি বিভাগ হওয়ার দাবিকে যথাযথই বলা যায়।
দেশের বিখ্যাত একটি মেডিকেল কলেজের পাশাপাশি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপস্থিতি শহর হিসেবে ময়মনসিংহকে দিয়েছে অন্যরকম এক সুনাম। শহরটির পাশাপাশি নেত্রকোনা, জামালপুর ও শেরপুর নিয়ে নতুন বিভাগ গঠন অনেকাংশেই যৌক্তিক বলে মনে হচ্ছে তাই। এ ক্ষেত্রে নতুন বিভাগে সবার আগে বিভাগীয় কমিশনার ও রেঞ্জ ডিআইজি পুলিশের অফিস স্থাপন দিয়ে কাজ শুরুতে স্থানীয় জনগণের মনে দেখা গেছে খুশির আমেজ। প্রশাসনের তরফ হতে আশ্বস্ত করা হয়েছে পর্যায়ক্রমে অন্য সব কার্যালয়ও যথারীতি স্থাপিত হবে ময়মনসিংহ বিভাগে। এ ক্ষেত্রে সংবাদ থেকে জানা যায় ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর ও নেত্রকোণার সঙ্গে টাঙ্গাইল ও কিশোরগঞ্জ জেলা রেখে ময়মনসিংহ বিভাগ গঠনের প্রস্তাব গত ২৬ জানুয়ারি নীতিগত অনুমোদন দিয়েছিল মন্ত্রিসভা। কিন্তু সেটাকে স্থানীয়দের বিরোধিতায় বাস্তবায়ন করা যায়নি। জনপ্রতিনিধি ও জনগণের অসম্মতির কারণে চূড়ান্ত অনুমোদনে টাঙ্গাইল ও কিশোরগঞ্জ জেলাকে ঢাকার সঙ্গেই রাখা হয়েছে। সেদিক থেকে ধরতে গেলে ময়মনসিংহ বিভাগ হওয়ার আগ পর্যন্ত ঢাকা বিভাগে জেলা ছিল ১৭টি। এখন নতুন বিভাগ হওয়ায় ১৩ জেলা নিয়ে ঢাকা বিভাগকে নতুন করে সাজানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
নতুন বিভাগ হিসেবে ময়মনসিংহ যাত্রা শুরু করলে এর সফলতার ওপর নির্ভর করবে অনেক নতুন সিদ্ধান্ত। দিনের পর দিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়া ঢাকা মহানগরীর ওপর থেকে চাপ কমাতে এখন একমাত্র সমাধান ভাবা হচ্ছে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণকে। এ ক্ষেত্রে নতুন বিভাগ হিসেবে চারটি জেলাকে ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্তটিকে একদিক থেকে পরীক্ষামূলক বলাটাও ভুল হবে না। আর এ পরীক্ষামূলক সিদ্ধান্ত পুরোপুরি সফল হলে ঢাকা বিভাগকে ভেঙে ফরিদপুর নামে একটি বিভাগ এবং কুমিল্লা ও নোয়াখালী জেলা নিয়ে আরেকটি বিভাগ গঠনের সিদ্ধান্তও সরকারের রয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের বক্তব্য থেকে এমন আশ্বাস পাওয়া গেছে যেখানে ঢাকাকে ধীরে ধীরে অল্প পরিসরে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনার সুপারিশ ছিল স্পষ্ট।
একটি নতুন বিভাগ নিছক প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ নয়; এর সাথে জড়িত থাকে অনেক প্রশ্ন। বিশেষ করে নতুন বিভাগ আত্মপ্রকাশ করার পর এর জন্য প্রয়োজন দেখা দেয় উপযুক্ত অবকাঠামো উন্নয়ন থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগের বিষয়টি। এ ক্ষেত্রে যে বিশেষ কর্মকর্তা কিংবা কর্মচারী আগে একই সাথে ঢাকা ও ময়মনসিংহ নিয়ন্ত্রণ করতেন তাঁদের দায়িত্ব যেমন কমে গেছে, তেমনি দেখা দিয়েছে নতুন জটিলতা। এ ক্ষেত্রে নতুন করে অবকাঠামো নির্মাণ কিংবা কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দানের কাজটিও সরকারের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। নতুন পে-স্কেল প্রবর্তনের পর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন যে হারে বেড়েছে সে ক্ষেত্রে নতুন একটি কর্মকর্তা কিংবা কর্মচারী নিয়োগ দানে অবশ্যই নতুন করে ভাবতে হবে। বিশেষ করে স্বল্প পরিমাণ রাজস্ব আয় থেকে একইসাথে অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন নির্বাহ করার নিঃসন্দেহে একটি জটিল ও কষ্টসাধ্য কাজ।
আমরা জানি, একটি নতুন বিভাগ প্রস্তাবিত হলে সরকার শুরুতে আনুষ্ঠানিক আদেশ জারি করে থাকে। তারপর বিভাগীয় পর্যায়ের কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে নতুন অফিস স্থাপনের কাজ শুরু হয়। যেখানে প্রতিটি ধাপ অনেক ব্যয়বহুল ও সময়স্বাপেক্ষ। আমরা এর আগে বরিশাল, সিলেট কিংবা রংপুরের নতুন বিভাগ হিসেবে যাত্রা শুরুর ক্ষেত্রে অনেক জটিলতা সৃষ্টি হতে দেখেছি। পাশাপাশি ঢাকা সিটি করপোরেশনকে ভেঙে নতুন দুটি সিটি করপোরেশন সৃষ্টির ক্ষেত্রেও দেখা দিয়েছিল বহুবিধ জটিলতা। বেশ কয়েক বছর হয়ে গেলেও আজ অবধি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি সেসব জটিলতার অনেককাংশ। ফলে নানা উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে নতুন একটি বিভাগ যাত্রা শুরু করলেও কার্যক্ষেত্রে আস্থার সংকট থেকেই যায়।
নতুন বিভাগ হিসেবে ময়মনসিংহ যাত্রা শুরু করলে তার প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো কেমন হবে। শিক্ষা, চিকিৎসা, জনসেবা, সমাজকল্যাণ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো সেখানে কীভাবে তার কর্মকাণ্ড চালিয়ে নেবে। কিংবা পূর্বতন কেন্দ্র ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর সেগুলো কীভাবে কাজ করবে তাও একটা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিতে পারে নিঃসন্দেহে। তারপরও রাজধানী ঢাকাকে বাসযোগ্য করে তুলতে এখান থেকে অনেক প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নেওয়ার যে উদ্যোগের কথা বার বার বলা হচ্ছে সেখানে আরেকটি নতুন কেন্দ্র স্থাপনের প্রয়োজন অনুভূত হয়েছে অনেক দিন থেকেই। অন্তত শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে ময়ময়সিংহ বিভাগের প্রাণ সঞ্চার করা যেতেই পারে।
একটু খেয়াল করলে দেখা যায় হররোজ ঢাকা শহরে নানা জেলা থেকে মানুষ এসে জড়ো হচ্ছে তিন হাজারের বেশি। কিন্তু শুরু থেকে শেষ কেউ ভাবছে না এ শহর ওই বাড়তি জনসংখ্যার ভার বইবে কেমন করে? একের পর এক তৈরি করা রাস্তা আর ফ্লাইওভারের ভারে বলতে গেলে নুয়ে পড়েছে মহানগরীর প্রতিবেশ। অধিক জনসংখ্যার দুর্বিষহ চাপ আর এসব নির্মম বাস্তবতাকে আড়াল করে কি ঢাকা নগরীকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে? এ প্রশ্ন সবার হলেও উত্তরটা কারো জানা নেই। আর সে ক্ষেত্রে বহুদিন থেকে আলোচিত বিকেন্দ্রীকরণের প্রস্তাবনা আলোর মুখ দেখতে পারে নতুন বিভাগ ময়মনসিংহ থেকেই। সরকারি গুরুত্বপূর্ণ কিছু দপ্তর ধীরে ধীরে সেখানে সরিয়ে নেওয়া যেতেই পারে। আমি সেখানে প্রস্তাব করেছি শিক্ষাবিষয়ক দপ্তরগুলোকে সেখানে কিংবা রাজশাহীতে সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপরে। অন্যদিকে বিখ্যাত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি কৃষি মন্ত্রণালয়কে সেখানে নিয়ে গেলে বোধকরি আরো ভালো হবে। আর সেটা করা সম্ভব হলে একদিকে ঢাকা মহানগরীর ওপর যেমন চাপ কমবে, তেমনি শুরু থেকেই একটা জাঁকজমকের সাথে যাত্রা করতে পারে নতুন বিভাগটি। এতে অন্তত জীবিকার খোঁজে প্রতিদিন ঢাকামুখী জনস্রোতের যে ঢল তা কিছুটা হলেও লাঘব হবে। তবে প্রশ্ন থেকে যায় নতুন বিভাগ হলেও কি মন্ত্রী আর সচিব মহোদয়রা দূষিত নগরী ঢাকার মায়া ত্যাগ করতে চাইবেন? এ ক্ষেত্রে একটা জনপ্রিয় উত্তর হয়তো- না।
আমরা স্মরণ করতে পারি, এরশাদের আমলে রংপুরে হাইকোর্ট বসানো হয়েছিল তবে তার ফলাফল কোনো আশার কথা বলে না। তাই নতুন বিভাগ হিসেবে ময়মনসিংহের অগ্রযাত্রা হবে না পেছনে যাবে, সেটার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরো কিছু দিন। একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, কুপমণ্ডুক জনগোষ্ঠীর একবার হৃদয়ে যে চিন্তা বদ্ধমূল হয়ে যায় তা থেকে আর বের হতে চায় না। তারা একবার ভেবে নিয়েছে দেশের সব সমৃদ্ধির কেন্দ্র হচ্ছে ঢাকা, তাই জীবন জীবিকার উৎসভূমি শুধু এই মহানগরী। অন্তত নতুন বিভাগ সৃষ্টির মাধ্যমে ময়মনসিংহ অঞ্চলে মানুষের মন থেকে যদি ঢাকা ফ্যান্টাসি দূর করা যায়- সেটা এ উদ্যোগের সাফল্য হিসেবে কম কিসে। আর সেদিকে খেয়াল রেখে শুধু প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ নয় স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়ন ও নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমেই যুক্তিযুক্ত, বস্তুনিষ্ঠ ও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠুক নতুন বিভাগ সৃষ্টির সিদ্ধান্তটি।
লেখক : পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।