বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
মান নিয়ন্ত্রণ ও রাজস্ব আদায়ে কঠোর হতে হবে সরকারকে
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চ শিক্ষায় অন্য বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সরকারের রাজস্ব আদায়ে নানা অসহযোগিতার ফলেই শিক্ষার্থীদের ওপর কখনো কখনো নেমে আসে বাড়তি টাকার খড়গ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মালিকরা সরকারের আনুকূল্য পেয়ে আসছেন। সরাসরি ক্ষমতাসীন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত মালিকের সংখ্যাও কম নয়।
মালিকদের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের বিরাজমান এই সম্পর্কের ফলে সাম্প্রতিক ভ্যাট-বিরোধী আন্দোলনেও মালিকদের একেক সময় একেক অবস্থান নিতে দেখা গেছে। যদিও চূড়ান্ত জয় পেয়েছে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরাই। যার ফলে এখন এই খাতটিকে ঢেলে সাজাতেও তাদের কাছে প্রত্যাশা বেড়েছে সর্বমহলের।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও অন্যান্য নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের দুর্বল মনিটরিং ও ছাড় দেওয়ার মনোভাবের ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো লাভবান হয়ে এলেও চূড়ান্ত ক্ষতির মধ্যে পড়ে শিক্ষার্থীরা। যহেতু এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে এসব কারণে দেখা যায়, এক অনুষদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অন্য অনুষদের বা বিষয়ের শিক্ষার্থীদের খুব একটা যোগাযোগ থাকে না। ফলে সংগঠিত কোনো প্রতিবাদ হওয়ার সম্ভাবনা সব সময়ই কম থাকে। এই সুযোগটিও কাজে লাগান মালিকরা।
একই বিষয় ও কারিকুলামে পড়াশোনা করেও ভিন্ন ভিন্ন ফি দিতে দেখা যায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। এসব নিয়ে একটি নীতিমালা থাকা অত্যন্ত জরুরি। ইউজিসির সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি নির্ধারণের ক্ষেত্রে একক কোনো কাঠামো নেই। ব্যয় নির্ধারণের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি নির্ধারণ করে। বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে এ টিউশন ফি প্রতি সেমিস্টারে প্রতি ক্রেডিটে তিন থেকে ছয় হাজার টাকা।
ইউজিসির তথ্যানুযায়ী, দেশে অনুমোদনপ্রাপ্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে ৮৩টি। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সাড়ে চার লাখের মতো শিক্ষার্থী রয়েছেন। প্রতি বছর এসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকার মতো আয় করে; যার সিংহভাগই টিউশন ফি হিসেবে আদায় করা হয়।
এনবিআরের তথ্য মতে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলো খুব সামন্য টাকা রাজস্ব প্রদান করে আসছে। তার ওপর আবার আছে নানা আইনি জটিলতা।
১৯৯৮-৯৯ অর্থবছর থেকে চলতি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মোট রাজস্বের পরিমাণ হয়েছে ১২৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। কিন্তু তারা পরিশোধ করেছে মাত্র ৪৭ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়ে এই অনৈতিক সুবিধা নিচ্ছে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আদালতে বিচারাধীন থাকায় ব্যবস্থা নিতে পারছে না এনবিআরও।
অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, মালিকানার দ্বন্দ প্রকাশ্য হয়েছে- সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অন্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় বেশি। এসবও কিন্তু প্রশ্ন জাগায় মনে। তাহলে কী হচ্ছে শিক্ষার নামে!
ভ্যাট-বিরোধী আন্দোলনে মালিকদের গলা ফাটিয়ে বলতে দেখা গেছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় একটি অলাভজনক খাত। আইনও তাই বলে। প্রশ্ন হচ্ছে তবুও মালিকানা নিয়ে এত কাড়াকাড়ি কেন? অলাভজনক হলে কি এমন হওয়াটা স্বাভাবিক? না স্বাভাবিক নয়। সূতরাং এটা স্পষ্ট এই খাতে প্রচুর অনিয়ম হচ্ছে। এই অনিয়মের জন্য শিক্ষার্থীরা দায়ী নন। দায় মালিকদের, সরকারের। সরকারের অবহেলা অথবা ছাড় দেওয়ার মানসিকতা মালিকদের বেপোরোয়া হয়ে উঠতে সহায়তা করছে।
আবার কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কে দেখা যায় কিছু ছাত্রছাত্রী পেয়ে গেলেই নিয়মের বরখেলাপ করতে শুরু করে। কারণ তারা মনে করে সরকার শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে গুরুতর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে বিরত থাকবে। এসবের ফলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সামাজিকভাবে নানা বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষরাও পেশাটাকে কেবল চাকরি হিসেবে নিচ্ছেন। তাঁরাও চলমান সংকট থেকে উত্তরণ বা সংস্কারের কোনো প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না। যেহেতু প্রচুর খণ্ডকালীন শিক্ষক এসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠদান করেন, তাঁরা কখনোই প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের মনে করতে পারেন না। অপরদিকে তরুণ শিক্ষকদের একটি বিরাট অংশই থাকেন আরো ভালো প্রতিষ্ঠানে বা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির অপেক্ষায়।
এসব সংকট সমাধানে সরকার দ্রুত আন্তরিক না হলে ভবিষ্যতে এই খাতে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
লেখক : স্টাফ করেসপনডেন্ট, নিউ এজ