অভিমত
ভাঙনের শব্দ শুনি
প্রায় চার দশক আগে যে ঘরে নববধূ হয়ে এসেছিলেন আসিয়া বেগম, আজ চোখের সামনে দেখছেন সেই ঘর কী নির্মম নিষ্ঠুরতায় চোখের পলকে নদীতে বিলীন হয়ে গেল। দালানের একেকটি ইট যেন একেকটি শেল হয়ে বিঁধেছে এই বৃদ্ধার বুকে। কিছুই করার নেই। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে দেখেছেন, কীভাবে একটি সোনার সংসার ভেঙে তছনছ হয়ে গেল। এই বয়সে এসে এখন নতুন ঘর বানানোর যুদ্ধ। নিজের জমি নেই। অদূরে অন্যের জমিতে গিয়ে কাঠ-তক্তা জোগাড় করে কোনোমতে মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরির সে এক অন্য লড়াই।
শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলায় এ রকম মানুষের সংখ্যা অনেক। গণমাধ্যমের সংবাদ বলছে, সম্প্রতি ইতিহাসের ভয়াবহতম যে ভাঙনে কবলে পড়েছে এই উপজেলা, তাতে অন্তত সাড়ে পাঁচ হাজার বাড়িঘর পদ্মার করাল গ্রাসে চলে গেছে। এর মধ্যে শুধু গরিব মানুষের কাঠ ও টিনের ঘরই নয়, সচ্ছল মানুষের তিনতলা-চারতলা দালানও আছে। কেউ কেউ সারা জীবনের সঞ্চয় আর ধারদেনা করে যে বাড়ি বানিয়েছিলেন, চোখের সামনে দেখেছেন সেই বাড়ি কী করে ভূমিকম্পের মতো ভেঙে চুরমার হয়ে পদ্মার বুকে চলে গেছে এবং এক ঘণ্টা আগেও যে জায়গাটিতে একটি অনিন্দ্যসুন্দর বাড়ি ছিল, সেই জায়গায় পানির তীব্র স্রোত। এমন ভয়াবহ ভাঙন এই উপজেলার মানুষ স্মরণকালে দেখেনি।
নড়িয়া পৌরসভা, মুলফতগঞ্জ ইউনিয়নের কেদারপুর ইউনিয়ন, মোক্তারের চর ইউনিয়নের সতেরোশর বেশি বাড়িঘর পদ্মায় বিলীন হয়েছে গত জুলাই থেকে। বিলীন হয়েছে একটি সরকারি হাসপাতাল এবং দুটি বেসরকারি ক্লিনিক। বাঁশতলা ও সাধুরবাজারও বিলীন হয়েছে। শৈশবে একবার মামার সঙ্গে গিয়েছিলাম এই সাধুর বাজারে। এবারের ভাঙনে এই এলাকার কয়েকজন মানুষও নদীতে চলে গেছেন, যাঁদের এখন অবধি সন্ধান মেলেনি। এই বাজারের অদূরেই আমার এক নানির বাড়ি। শুনেছি, এবারের ভাঙনে তাঁদের অনেক আত্মীয়স্বজনের বাড়িঘর বিলীন হয়েছে। নদী ক্রমেই এগিয়ে আসছে তাঁদের ভিটেমাটির দিকে। দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুম হয় না।
গত আগস্ট মাসে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থার (নাসা) আর্থ অবজারভেটরি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পদ্মা নদীর ভাঙনে ১৯৬৭ সাল থেকে ৬৬ হাজার হেক্টরেরও (২৫৬ বর্গমাইল) বেশি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
প্রশ্ন হলো, পদ্মা কেন এত নিষ্ঠুর? কেন এই নদীর নামের আগে ‘সর্বনাশা’ বিশেষণ যুক্ত করা হয়? বলা হয়, নদীভাঙন একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। দ্বিতীয়ত, নদীর তীরে বড় বড় বালুচর রয়েছে, যা দ্রুতই ভেঙে যেতে পারে। তাহলে কি ভাঙনের হাত থেকে মানুষের নিস্তার নেই?
প্রকৃতি ও জলবায়ুবিষয়ক প্রতিষ্ঠান সিইজিআইএস পূর্বাভাস দিয়ে বলেছিল, এ বছর দেশের তিনটি প্রধান নদীর ২২টি পয়েন্টে স্থানে তীব্র ভাঙন হতে পারে। নদীগর্ভে চলে যেতে পারে দুই হাজার ২৭০ হেক্টর জমি। আর এই ভাঙন ১১টি জেলায় ছড়িয়ে পড়বে বলেও পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই পূর্বাভাস আমরা কতটা আমলে নিয়েছি? স্থানীয় প্রশাসন কি ওই সব এলাকার মানুষকে আগে থেকে সতর্ক করেছিল? বড় ঘূর্ণিঝড়ের আগে যেমন মাইকিং করে বা অন্য আরো অনেক উপায়ে মানুষকে সতর্ক করা হয়, স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা কি সেভাবে নদী-তীরবর্তী মানুষকে সতর্ক করেছিলেন? নাকি এই পূর্বাভাসের খবর তাদের কাছে ছিল না? নাকি তাদের কাছে নদীভাঙন এখনো ওই অর্থে কোনো দুর্যোগ নয়?
মূলত বছরের জুলাই থেকে অক্টোবর—এই তিন মাসে বেশি নদীভাঙন হয়। কয়েক বছর ধরে এই সময়কালে দেশের প্রায় ৪০টি প্রধান নদীর ভাঙন প্রায় অবধারিত। ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যানের এক সমীক্ষা বলছে, নদীভাঙনে প্রতিবছর প্রায় আট হাজার ৭০০ হেক্টর জমি বিলীন হয়ে যায়। কোনো বছর কম, কোনো বছর বেশি। আর এভাবে প্রতিবছর অন্তত ১০ লাখ মানুষ কোনো না কোনোভাবে নদীভাঙনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
গবেষকরা বলেন, বাংলাদেশের প্রায় সব নদীই সর্পিল। নদীর এই বৈশিষ্ট্যই ভাঙনের মূল কারণ। সেইসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের যে উচ্চতা বেড়েছে, তাতে উপকূলীয় এলাকা হুমকির মুখে। বিশেষ করে ভোলা, সন্দ্বীপ, হাতিয়া, কুতুবদিয়ায় নদীভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের একটি গণমাধ্যম সহায়িকায় বলা হয়েছে, প্রতিবছর ছোট-বড় সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের কারণে সমুদ্রের লবণাক্ত পানির আঘাতে ভেঙে পড়ে নদীর তীর। লবণাক্ত পানির চাপ, পর্যাপ্ত বনায়ন না থাকা, অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ ইত্যাদিও নদীভাঙনের ঝুঁকি বাড়ায়।
তাহলে নদীর এই গতিপ্রকৃতি আর আচরণের কাছে মানুষ কি শুধু হেরে যেতে থাকবে? এটা ঠিক, প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে মানুষ খুব বেশি এগোতে পারে না। কিন্তু তারপরও আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃতিকে বশে আনতে সহায়তাও করেছে, যার বড় উদাহরণ নেদারল্যান্ডস। সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচে থাকা এই দেশটি যেভাবে সমুদ্র শাসন করে বিশ্বের একটি সমৃদ্ধশালী দেশে পরিণত হয়েছে—তা নদীমাতৃক এবং সমুদ্র উপকূলীয় দেশগুলোর জন্য একটি বড় উদাহরণ। নেদারল্যান্ডসের মানুষেরা গর্ব করে বলে, ‘সৃষ্টিকর্তা পুরো পৃথিবী বানিয়েছেন, কিন্তু ডাচরা বানিয়েছে নেদারল্যান্ডস।’
তার মানে নদী ও সমুদ্রকে বশে এনে, অর্থাৎ তাকে সঠিক উপায়ে শাসন করে নদীভাঙন প্রতিরোধ করা সম্ভব। সম্প্রতি সরকার আগামী একশ বছরের জন্য যে বদ্বীপ পরিকল্পনা বা ডেল্টা প্ল্যান নিয়েছে—সেখানে নদীভাঙন প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রকল্প থাকবে বলে জানানো হয়েছে।
তবে নদীভাঙন প্রতিরোধে বহু বছর ধরে যে কাজটি করা হয়, সেখানে অনিয়ম-দুর্নীতি আর সংশ্লিষ্টদের সদিচ্ছার অভাবে এর সুফল পাওয়া যায় না। নদীভাঙন প্রতিরোধের প্রধান উপায় ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে টেকসই বাঁধ নির্মাণ। কিন্তু সারা দেশে যে বাঁধগুলো আছে, তার কয়টা আক্ষরিক অর্থেই টেকসই, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বাঁধ নির্মাণে যে বরাদ্দ থাকে, তার প্রায় অর্ধেক বা কখনো এর বেশিও লুটপাট হয় বলে শোনা যায়। কখনো জনগণের করের পয়সায়, কখনো বিদেশির ঋণ—বাঁধ নির্মাণে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই সেসব বাঁধে ধস দেখা দেয়, পানির স্রোত তীব্র হলে বাঁধের একাংশ ভেঙে পড়ে। আর নদীর স্রোত এতই বিপজ্জনক, বাঁধের কোনো একটি অংশ ভেঙে গেলে সেখান থেকে এত প্রবল বেগে পানি ঢুকে পড়ে যে তাতে অনেক সময় বন্যার সৃষ্টি হয়। আবার দ্রুত ওই ভেঙে যাওয়া অংশ মেরামত করা না হলে অন্য অংশে ভাঙন ছড়িয়ে পড়ে।
নদী-তীরবর্তী বহু এলাকার মানুষ বছরের পর বছর বাঁধ নির্মাণের দাবিতে মানববন্ধন করে—কিন্তু সমাধান হয় না। নানা উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়। কিন্তু নদী-তীরবর্তী মানুষকে রক্ষার জন্য যে বিশাল কর্মযজ্ঞ থাকার কথা, সেটি চোখে পড়ে না। আবার যেসব কাজ হয়, তার মান নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। অনেক জায়গায় সময়মতো কাজ শুরু হয় না।
সরকার গত জানুয়ারিতে শরীয়তপুরের জাজিরা থেকে কেদারপুর পর্যন্ত প্রায় ৯ কিলোমিটার এলায় পদ্মার ডান তীর রক্ষায় এক হাজার ৯৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। কিন্তু নানা জটিলতায় কাজটি শুরু হয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ড অবশ্য বলছে, তারা এই বর্ষার পরে, অর্থাৎ অক্টোবরের শেষ অথবা নভেম্বরের শুরুতে কাজ শুরু করতে চেয়েছিল। কিন্তু তার আগেই যে তীব্র ভাঙনের মুখে পড়ল এই জনপদের মানুষ—তা সারা দেশের মানুষকেই হতবিহ্বল করেছে। স্থানীয়রা মনে করেন, এই কাজটি যদি শুরু হতো এবং নদীতে ড্রেজিং করা গেলে স্রোত অন্য দিকে প্রবাহিত হতো। ফলে ভাঙনের তীব্রতা হয়তো কম হতো। এই তীব্র ভাঙনের পরে জরুরি ভিত্তিতে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। কিন্তু কোথাও কোথাও স্রোত এত বেশি যে অনেক জায়গায় বালুভর্তি এই জিও ব্যাগ খড়কুটোর মতো ভেসে গেছে।
পদ্মার সাম্প্রতিক ভাঙনে যে মানুষগুলো নিঃস্ব হলেন, তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই। সরকারি-বেসরকারি সহায়তা কে কতুটুক পাচ্ছেন, তাও নিশ্চিত নয়। হয়তো এই মানুষগুলো আবার ঘুরে দাঁড়াবেন। কেউ হয়তো সর্বস্ব হারিয়ে রাজধানী ঢাকায় এসে কোনো বস্তিতে ঠাঁই নেবেন। কোনো সচ্ছল কৃষক হয়তো ঢাকা শহরে এসে রিকশা চালাবেন। কিন্তু নদী, সে আপন বেগেই চলবে।
রূপসী বাংলার কবিখ্যাত জীবনানন্দ দাশের পূর্বপুরুষের আদিনিবাস বিক্রমপুর পরগনার গাউপাড়া গ্রামে। তাঁদের জমিদারি ছিল। কিন্তু সেই জমিজিরেতও পদ্মায় বিলীন হয়। তাঁদের বরিশালে স্থানান্তরের পেছনে এটিও একটি বড় কারণ বলে মনে করা হয়।
লেখক : সাংবাদিক।