নির্মম
‘ব্যাগবন্দি’ মানবতা
নির্মম ও আশাহত হওয়ার কথা হলেও অনেকে ভয়ে পত্রিকার পাতায় চোখ বোলাতে চান না, এই বুঝি কোনো দুঃসংবাদ এসে চোখে পড়ে। সময় বদলে গেছে অনেক, ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে গিয়ে সামান্য স্বার্থে মানুষ হারাচ্ছে হিতাহিত জ্ঞান। বেশ কিছুদিন আগে ফেসবুক টাইমলাইনে একটি ভিডিও অসংখ্য শেয়ার হতে দেখলাম। সেখানে গ্রাম্য সালিসে দুজন নারীকে বেদম মার দিচ্ছে কয়েকজন দুর্বৃত্ত। তার কিছুদিন পর লিমনের ঘটনা, তারপর সিলেট, তারপর চিংড়িঘেরের শিশু নির্যাতন আর এভাবে চলছেই। এরপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে বাংলাদেশে একসময়ের নন্দিত পেস বোলার শাহাদাত হোসেনের সস্ত্রীক বাসার ছোট কাজের মেয়ের ওপর নির্যাতন। শাহাদাত ও স্ত্রী মিলে গৃহকর্মী হ্যাপিকে যেভাবে নির্যাতন করেছেন, তাতে ঘৃণায় রিরি করে উঠেছে সারা দেশ।
একের পর এক এমনি দুঃসংবাদ দেখতে দেখতে অনেকটাই সয়ে গেছে আমাদের। বলা যায় ঠিক যেমনটা পাকিস্তান, আফগানিস্তান কিংবা ইরাকের মানুষের কাছে রাস্তার মোড়ে বোমা ফাটাটা কোনো ঘটনাই না। বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বাহিনী যখন লন্ডন শহরে বোমা নিক্ষেপ করত, তখন প্রথম প্রথম মানুষ ভয় পেত। শেষের দিকে এমন হয়েছে সারা রাত জার্মান বাহিনী বোমাবর্ষণ করত, মানুষ দিব্যি তাদের বাংকারে ঢুকে গিয়ে নাক ডেকে ঘুম দিয়েছে। তাই গত কয়েকদিন থেকে টাঙ্গাইলের দুর্ঘটনায় দেশ যখন উত্তাল তার আড়ালে আরো কতগুলো দুর্ঘটনা ঘটে গেছে তার খবর কি রেখেছে?
গত শুক্রবার ১৮ সেপ্টেম্বর বিশ্বে ঘটে যাওয়া অনেকগুলো পাশবিকতার মধ্যে একটি হয়তো ঘটেছে বাংলাদেশে, তার খবর আমরা কজনই রাখতে পারছি? টাঙ্গাইলে ছেলের সামনে মায়ের শ্লীলতাহানির ঘটনায় যখন পুরো এলাকাবাসী উত্তাল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলির মুখে তিনজনের প্রাণও গেছে। ঠিক তখনই ঢাকার পুরোনো বিমানবন্দর এলাকায় ঘটে যায় এমনি আরেক ভয়াবহতা। একটি ব্যাগের মধ্যে দূর থেকে দেখলে মনে হবে পড়ে আছে পুরোনো কোনো পুতুল। পরে সেই পুতুলটা নিয়ে কুকুরের দল জটলা করে টানা-হেঁচড়া করা শুরু করলে সেখান থেকে ভেসে আসে কান্নার শব্দ। জনৈক পথচারী সেটা দেখে এগিয়ে যান। তিনি সেখানে গিয়ে দেখতে পান সেটা কোনো পুতুল নয়, এক অভাগা মানবশিশু।
হয়তো বাবা-মা শিশুটির দায়িত্ব নিতে চায়নি, নয়তো কারো পথভ্রষ্ট্র ভালোবাসার ফসল নষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা কিংবা কারো প্রতিহিংসার শিকার হয়ে ওই ব্যাগে আশ্রয় নিয়েছে নবজাতকটি। ফেসবুকারদের অনেকে আফসোস করে লিখতে পারেননি যে এটা একটা মানবশিশু, তাঁরা আক্ষেপ নিয়ে লিখেছেন ঝোঁপের মধ্যে পাওয়া গেছে একটা খেলনা পুতুল। যাতে কুকুরের দল চাবি দেওয়াতে বেজে উঠেছে বারবার। আর তা থেকেই বোঝা গেছে এর আসল পরিচয়। শেষ পর্যন্ত উদ্যমী কিছু মানুষ বাচ্চাটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসা চলছে শিশুটির। হয়তো কিছুদিন আগে মায়ের পেটে গুলিবিদ্ধ শিশুটির মতো এই শিশুটিও বেঁচে যেতে পারে সু-চিকিৎসা পেলে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাবে অনেক।
প্রশ্ন থেকে যাবে এই শিশুটির পরিচয় নিয়ে, প্রশ্ন দেখা দেবে আমাদের সমাজ নিয়ে, প্রশ্ন উঠতে পারে এ সমাজকে যারা নিওলিবারেল ও আধুনিক বানাতে চান, কিন্তু আধুনিকতার উদ্বৃত্ত ফসলের দায় তাঁরা নেন না, দায় নেয় পুরাতন বিমানবন্দরের জঙ্গল, প্রশ্ন উঠতে পারে আমাদের প্রচলিত আইন নিয়ে। এদিকে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এ দুর্ঘটনা থেকে তাদের দায় এড়াতে পারে না। আর এতগুলো প্রশ্ন থেকেও যদি উত্তর না পাওয়া যায় তবে আমাদের প্রিয় স্বদেশে মানবতা এমনি ‘ব্যাগবন্দি’ হয়ে পড়বে। তারপর তাকে খুবলে খাবে পথের কুকুর, আমরা সাধারণ নাগরিক ধর্ষকামী মনোভাবের সেই দর্শকই রয়ে যাব। মিডিয়াকর্মীরা তাঁদের ক্যামেরা ঘুরিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে দায় শেষ করবেন, আর প্রিন্ট মিডিয়ার তরফ থেকে কেউ দুই কলম লিখে শেষ করবেন তাঁর দায়। আর মহাকালের পানে প্রশ্ন থেকে যাবে, এর শেষ কোথায় ?
লেখক : সাংবাদিক, বণিক বার্তা