অভিমত
নিশ্চিত অংশগ্রহণ, অনিশ্চিত ভোটাধিকার
জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০১৮ যতই ঘনিয়ে আসছিল অনিশ্চয়তার কালো মেঘ ততই ঘনীভূত হচ্ছিল। সরকারের একক নির্বাচনের কৌশলকে ভণ্ডুল করে দিয়ে বিরোধী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। বিশেষ করে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হলে এর অগ্রযাত্রা গতি পায়। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী ড. হোসেন সবাইকে নির্বাচনমুখী করে তোলেন। বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছিল একটি দুরূহ সিদ্ধান্ত। কারণ তাদের নেতা একজন জেলে বন্দি এবং আরেকজন দূরদেশে।
২০১৪ সালের মতো নির্বাচন আর এবার হচ্ছে না। গণতান্ত্রিক দল হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ বিএনপির জন্যও ছিল অপরিহার্য। তাদের জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন ছিল। অবশেষে সংলাপ কৌশলের মাধ্যমে তারা মৌখিক সান্ত্বনা লাভ করে। সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের আশ্বাস বাক্য তাদের বিশ্বাস করতে হয়। উত্থাপিত ৭ দফার এক দফাও মেনে না নিলেও বিএনপি তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। বিরোধী দল ও সরকারি দলের জন্য এই সিদ্ধান্তটি ছিল ইতিবাচক ও নেতিবাচক। ইতিবাচক এই জন্য যে, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ যেকোনো রাজনৈতিক দলের জন্য ভালো। সরকারের জন্য এটা ইতিবাচক এজন্য যে প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নিয়ে যে প্রশ্ন বহির্বিশ্বে জোড়ালো হচ্ছিল তার সন্তোষজনক সমাধান হলো। এখন সরকার জোর গলায় বলতে পারবে যে, সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনটি সম্পন্ন হয়েছে।
নির্বাচনী প্রক্রিয়া যদি যথাযথ না হয় তাহলে বিএনপি নির্বাচন থেকে যেকোনো সময় সরে দাঁড়াতে পারে- এ রকম ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সেক্ষেত্রে অসুবিধা হলো দোদুল্যমানতা অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। যেমন, সম্পাদকদের সাথে বৈঠকে ড. কামাল হোসেনকে বারবার জিজ্ঞাসা করা হয় যে, অবশেষে নির্বাচনী দৌড়ে শামিল থাকবেন তো? অনিশ্চয়তার অবসানে ড. কামাল হোসেন বিরোধী দলের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করেন যে তাঁরা শেষ পর্যন্ত থাকবেন নির্বাচনে। সেখানে স্পিরিটটা হলো, ‘নাথিং স্যুড গো আনচ্যালেঞ্জড’। অপরদিকে কূটনীতিকদের পক্ষ থেকে নির্বাচনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত থাকার যে আবেদন ছিল তা ড. কামাল হোসেনের ঘোষণার মধ্য দিয়ে নিশ্চিত হলো। এখন এই ঘোষণা সরকারের জন্য বড় ধরনের প্লাস পয়েন্ট বলে গৃহিত হলো।
এই অবস্থায় সরকার এখন একটি বিরাট সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। সরকারের ধরন-ধারণ ও চরিত্র বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সাধারণ মানুষও জ্ঞাত। যখন বিএনপির মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করবার জন্য প্রার্থীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ল, নতুন আশা উদ্দীপনা সৃষ্টি হলো, তখন এই আনন্দকে শুরুতেই মাটি করে দেওয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে পুলিশ দিয়ে হামলা চালানো হলো। রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহল বিশ্বাস করেন যে, এর দ্বারা তারা একই সাথে দুটো উদ্দেশ্য সাধন করতে চেয়েছে। প্রথমত, বিএনপির পথের শুরুতেই কাটা বিছিয়ে দেওয়া। দ্বিতীয়ত, এই উপলক্ষেমামলা দিয়ে আরো কয়েকশ নেতা কর্মীকে ঘায়েল করার সুযোগ গ্রহণ করা। তাদের প্রথম উদ্দেশ্য সফল হয়নি। পরে বিএনপি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আবার প্রাণের মেলা প্রাণ ফিরে পেয়েছে। কিন্তু তাদের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। একই সাথে তিনটি মামলা দিয়ে আসামি করে বিএনপি কর্মীদের বাড়ি ছাড়া করা হয়েছে। এখন পুলিশ তাদের খুঁজছে।
সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম থেকেই বিরোধী দল নির্মূল করার এবং ভিন্নমতকে দমন করার যে নীতিগত অবস্থান সরকার গ্রহণ করে তা থেকে তারা ফিরে যায়নি। সবচেয়ে কষ্টের কথা বিরোধী দলের সাথে সংলাপের এক পর্যায়ে স্বয়ং সরকার প্রধান এই নিশ্চয়তা প্রদান করেন যে, গায়েবী মামলা এবং পুলিশি হামলা আর হবে না। কিন্তু এখনো তা অব্যাহত আছে। তার মানে কি এই যে, সরকার দুমুখো নীতি অনুসরণ করছে? প্রতিদিন সংবাদপত্রে খবর আসছে যে, গ্রাম অঞ্চলে যারা বিএনপির নির্বাচনে প্রাসঙ্গিক তাদের বিরুদ্ধে পাইকারি মামলা দেওয়া হচ্ছে। গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। মামলার পর মামলা দিয়ে তাদের এলাকা থেকে এলাকা ছাড়া করা হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে পুলিশ কখনো কখনো ব্যাখ্যা দিচ্ছে যে, তাদের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল অপরাধের মামলা রয়েছে। বলাই বাহুল্য যে, আাগেই পুলিশই উদ্দেশ্যমূলকভাবে মামলা দায়ের করে রেখেছে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেছেন, পুলিশ সদর দপ্তরে আওয়ামী লীগকে জেতানোর নীল নকশা হচ্ছে।
জনগণ ভোট দিতে চায়। নিজের সম্মতির প্রমাণ দিতে চায়।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।