নির্বাচন
আরো বড় জোট বড়লোকের ভোট
নির্বাচনের কিছুদিন আগে বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পর্কে একটি বৈশ্বিক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে এ দেশের অর্থনীতির এক বিস্ময়কর প্রবণতা ফুটে ওঠে। বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম গরিব দেশ। সম্পদ সীমিত। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ক্রমশ সুবিকশিত হচ্ছে। মানুষের জীবনযাত্রার স্বচ্ছন্দ বেড়ে যাচ্ছে। এই ধীরগতির অর্থনৈতিক ক্রমবিকাশের বিপরীতে হঠাৎ করে বিগত এক দশকে ধনিক-বণিকের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। এই নব্য ধনিক শ্রেণির সমৃদ্ধি ঘটছে দীর্ঘ এবং উচ্চ লভ্য দিয়ে। অল্প সময়ের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক অসম্ভব ধনিক শ্রেণিতে পরিণত হয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা লক্ষ করেন যে এই ধনিক শ্রেণির বিকাশে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়নি। বিশ্লেষকদের মতে, এই অস্বাভাবিক এবং আকস্মিক উল্লম্ফন সাধারণত দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজেই সম্ভব। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেশের সম্পদ ও সুবিধা বণ্টনে একক কর্তৃত্ব ভোগ করে থাকে। এ জন্যই অর্থলোভী ব্যক্তিবর্গ রাজনীতিতে বেশি আগ্রহ দেখিয়ে থাকেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তালুকদার মনিরুজ্জামান এক গবেষণায় প্রমাণ করেন যে ১৯৭৩ সাল থেকে ক্রমশ জাতীয় সংসদে রাজনীতিবিদদের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। সমাগত নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের অর্থনৈতিক চিত্র বিশ্লেষণ করে সহজেই বোঝা যায় যে, রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের অবস্থান নিরঙ্কুশ হতে যাচ্ছে। মনোনয়নের সময় জমা দেওয়া সম্পদ বিবরণী দেখে এরই মধ্যে কোনো কোনো পর্যবেক্ষক আগামী সংসদে ৭৫-৮৫ ভাগ ব্যবসায়ীর উপস্থিতির আশঙ্কা করছেন। আগামী নির্বাচনে যেসব ব্যক্তি মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন, তাদের নিরঙ্কুশ অংশ বিপুল অর্থবিত্তের মালিক। তারা যে সম্পদ বিবরণী দিয়েছেন অনেক ক্ষেত্রেই সেখানে আমাদের জনচরিত্র অনুযায়ী গোপনীয়তা ও অসত্য তথ্য থাকা স্বাভাবিক। যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অনেকের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে শুধু সম্পদের অবিশ্বস্ত ও অনিশ্চিত বিবরণী দাখিল করবার জন্য। আবার অনেকে নিজের সম্পদকে স্ত্রীর কাঁধে তুলে দিয়ে অসৎ উপায়কে বৈধতা দিতে চেয়েছেন।
তাহলে সাম্প্রতিক রাজনীতির এ প্রবণতা স্পষ্ট যে, রাজনীতি আর গরিব মানুষের নাগালের মধ্যে নেই। এমনকি তা রাজনীতিবিদদের হাতেও নেই। এই কিছুদিন আগেই আজীবন রাজনীতিবিদ প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতছাড়া হওয়ায় উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। অথচ এই দেশে একসময়ে রাজনীতি করতেন নিবেদিতপ্রাণ মানুষেরা। তাদের অর্থবিত্ত ও প্রাচুর্যের চাহিদা কখনো ছিল না। আমাদের মহান পূর্বপুরুষ শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হক একরকম বিত্তহীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিঃস্ব অবস্থায় বিদেশে মৃত্যুবরণ করেন। মওলানা ভাসানী আসলেই একজন সর্বহারা ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কখনো অর্থবিত্তের লোভে কিছু করেছেন—এমন প্রমাণ আজও পাওয়া যায়নি। তিনি নিজে সম্পদ ও সুবিধের লোভ না করতে মানুষকে উপদেশ দিয়েছেন। জিয়াউর রহমানের সততা ও সহজ-সরল জীবনযাপনের আদর্শ রেখে গেছেন। তিনি নেতাকর্মীদের খাইখাই মনোভাবের নিন্দা করেছেন। অথচ আজকে আমাদের রাজনীতিবিদদের লক্ষ্য শুধু অগাধ অর্থ উপার্জন। তারা রাজনীতিকে অর্থ উপার্জনের বাহন হিসেবে গ্রহণ করেছে।
আজকাল রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন পেতে কোটি কোটি টাকা খরচ করতে হয় বলে জানা যায়। বিশেষ করে প্রধান দুটো জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন বিক্রি হওয়ার বদনাম প্রতিষ্ঠিত। এটা এখন ওপেন সিক্রেট। প্রধান রাজনৈতিক দল দুটো বৈশিষ্ট্যধারীদের মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে, তার প্রথমটি অর্থ এবং দ্বিতীয়টি মাস্তানি। যে ব্যক্তি মনোনয়ন ক্রয় থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠান পর্যন্ত কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেন তারা কি এমনিতেই এটা করেন? নিশ্চয়ই তাদের লাভ-লোকসানের হিসাব-নিকাশ রয়েছে। যা তিনি ব্যয় করেন তার পাঁচ গুণ উশুল করে নেন, এটাই স্বাভাবিক। টাকার বিনিময়ে যে মনোনয়ন ক্রয়-বিক্রয় হয় তার একটি তরতাজা উদাহারণ জাতীয় পার্টির সদ্য ক্ষমতাচ্যুত মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার। প্রার্থীরা তাকে কত কোটি টাকা কে দিয়েছেন, তার হিসাব সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনীতির যে অর্থলোলুপ মানসিকতার দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে তার আরেকটি বড় প্রমাণ অপেক্ষমাণ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যক প্রার্থীর অংশগ্রহণ। বিগত কোনো নির্বাচনে এত বিপুল সংখ্যক প্রর্থী মনোনয়ন পেতে চাননি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন বিগত দশকের রাজনৈতিক সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে লাফ দিয়ে দিয়ে যে কোটিপতি শ্রেণীর সৃষ্টি হয়েছে তারাই নির্বাচনে বেশি উৎসাহী। দেশে নিবন্ধনকৃত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৩৯ হলেও মূল দল চার থেকে পাঁচটি। এতে প্রার্থীর সংখ্যা ৩ হাজার ৬৫, এত হওয়ার কথা নয়। প্রধান দুটি দল আওয়ামীলীগ ও বিএনপি- যাদের ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তাদের কাছেই প্রার্থীদের বিপুল সমাবেশ। এক্ষেত্রে চহিদার দিক থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা এগিয়ে আছেন। তারা কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে জোর লবিং করেছেন। আওয়ামী প্রার্থীদের ধারণা মনোনয়ন মানেই ২০১৪ সালের স্টাইলে জয়লাভ। এ বাণিজ্যে লোকসানের ঝুঁকি কম। বিএনপি বিগত বারো বছরে ক্ষমতার বাইরে রয়েছে। তাদের প্রার্থী সংখ্যা আওয়ামী লীগের চেয়ে বেশি হওয়ার কারণ অতীতে নির্বাচনের সুযোগ না পাওয়া। এটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় যে সমাজের সৎ, যোগ্য ও নিষ্ঠাবান লোকেরা নির্বাচন থেকে দূরে থাকছেন। তারা অর্থ ও শক্তির প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছে না। দেশের আদর্শবাদী রাজনৈতিক দলগুলোতে কমিউনিস্ট এবং ইসলামী প্রার্থীর সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে অনেক কম।
অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশের রাজনীতি-অর্থনীতিতে একটি স্থায়ী দুষ্টচক্রের উদ্ভব হয়েছে। দল ও গোষ্ঠী নির্বিশেষে তাদের অবস্থান। তারা রাজনৈতিক এলিটদের সাথে একটি পারস্পারিক সমঝোতা বা আপসের মাধ্যমে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ অব্যাহত রাখেন। ক্ষমতায় যারা আছেন তারা বড় পার্টনার এবং যারা ক্ষমতার বাইরে আছেন তারা ছোট পার্টনার হিসাবে ব্যবসায়-বাণিজ্য, সবক্ষেত্রে তাদের অংশিদারিত্ব বজায় রাখেন। স্থায়ী স্বার্থের এই তাবেদার শ্রেণীকে কায়েমী স্বার্থগোষ্ঠী হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। সরকারের পরিবর্তনের সাথে সাথে তারা অতি দ্রুত খোলস পাল্টে ফেলে। এমন দেখা যায় যে একই পরিবারের সদস্যরা ভাগাভাগি করে সরকার ও প্রভাবশালী বিরোধী দলে একই সময়ে অবস্থান করছে। তারা গাছেরটা খায়, তলারটাও কুড়ায়।
একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তির মনোনয়ন নেওয়ার উদাহারণ এবারও রয়েছে অনেক। আমাদের শাসক পরিবারতন্ত্রের কথা না হয় নাই বললাম। যারা সমাজে তাদের অপকর্মের জন্য তাদের অর্থলিপ্সার জন্য নিন্দিত তারা রাজনৈতিক দলের কাছে সম্ভবত সম্পদ হিসেবেই পরিচিত। এবারের নির্বাচন থেকে এরকম উদাহারণ হচ্ছে মাদক ব্যবসার জন্য কুখ্যাত আবদুর রহমান বদি, ক্রেস্টের বদলে প্রকাশ্যে টাকা চাওয়া চিফ হুইপ আসম ফিরোজ, ঠাকুরগাঁওয়ের ভূমিখোর দুবেরুল ইসলাম, রাজশাহীর মাদক ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষক ওমর ফারুখ চৌধুরী প্রমুখ। প্রার্থীর তালিকা দেখে সাধারণ মানুষ হতাশ। বড় বড় ধনীদের সাথে যোগ হয়েছে বড় বড় অপরাধী। আর ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার জন্য তারা গড়ে তুলেছেন জোটের পরে জোট-মহাজোট। প্রকাশ্যেই তাদের কেউ কেউ সবাই মিলে লুটেপুটে খাওয়ার কথা বলছে।
পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত আগত নির্বাচন প্রার্থীদের অর্থনৈতিক চরিত্র বোঝানোর জন্য প্রকাশিত কয়েকটি সংবাদ উল্লেখ করছি, এক. এইচ এম এরশাদ, মন্ত্রী মোশারফ হোসেন, সালমান এফ রহমান, মির্জা আব্বাস, শাহরিয়ার আলম, বি এইচ হারুন, রহুল আমিন হাওলাদার এবং হাজি মো. সেলিম সকলেই শেয়ার বাজারের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বলে দাবি করেছেন। দুই. জনাব সালমান এফ রহমান সমাজের বিপুল বিত্ত এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক কিন্তু তার প্রধান বিনিয়োগ শেয়ার বাজারের। তার প্রদর্শিত বিনিয়োগ ২৫০ কোটি ৮৪ লাখ। গ. প্রার্থীদের কাছে নগদ টাকার ছড়াছড়ি। যেমন এরশাদ প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী তিনি তার স্ত্রী রওশন এরশাদের কাছে ২৬ কোটি টাকা নগদ রেখেছেন। সাংসদ তাপসের হাতে নগদই আছে সাড়ে ৬ কোটি টাকা। মির্জা আজমের নগদ টাকা বেড়েছে সাড়ে ৩৩ গুণ। ঘ. প্রদত্ত হলফনামায় এমন কাউকে দেখা বিরল যার সম্পদ ও নগদ অর্থ গত পাঁচ বছরে বাড়েনি। বরং হুহু করে তাদের অর্থবিত্ত বেড়েছে অনেক গুণ। ওবায়দুল কাদেরের সম্পদ বেড়েছে ৫ গুণ।
এভাবে যদি সকল মনোনয়ন প্রার্থীর সম্পদের বিবরণ নেওয়া যায় তাহলে দেখা যাবে, ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়। সকলেই হয়তো কোটি কোটি টাকার মালিক। সম্পদধারীদের সাধারণ প্রবণতা এই যে তারা আরো সম্পদের মালিক হতে চায়। আমাদের সংসদীয় রেকর্ড বলে যে, কোরাম সংকটে কার্যক্রমের ভাটা আসে যারা নির্বাচিত হয় তারা সাংসদীয় দায়িত্বের চেয়ে বাণিজ্যিক দায়িত্ব বেশি পালন করে। দেশের উন্নয়ন প্রকল্প ও বিবিধ সরকারি ত্রাণ থেকে তারা নির্দিষ্ট অংকের মাশোয়ারা নেয়। ফলে সামগ্রিক অর্থে প্রশাসন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সুতরাং নির্বাচনকে যদি কালো টাকা ও পেশিশক্তি মুক্ত করা না যায় তাহলে নির্বাচনের ফলাফল দেশের সাধারণ মানুষের অনুকূলে আসবে না। এই লক্ষ্য অর্জন সহজসাধ্য নয়। প্রচলিত ধনিক-বণিক শ্রেণি যারা বর্তমান শাসক-শোসকদের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে শুধু কলাগাছ নয়, বটগাছ হয়ে গেছে তাদেরকে যদি নিয়ন্ত্রণ ও পরিবর্তন না করা যায় তাহলে ভবিষ্যৎ এরকম অন্ধকারেই আচ্ছন্ন থাকবে। প্রতিটি নাগরিকের উচিত সৎ ও সুশাসন কায়েমের জন্য নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করে যাওয়া।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।