শিক্ষা
মেডিকেল ভর্তীচ্ছুদের ওপর দমননীতি নিয়ে কিছু কথা
সম্প্রতি বাংলাদেশে যেসব চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটছে তার সর্বশেষ সংযোজন হলো মেডিকেল ভর্তীচ্ছুদের আন্দোলনে পুলিশের লাঠিচার্জ, অহেতুক মারধর এবং অসংখ্য প্রতিবাদীকে আটক করার ঘটনা। প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে এমনি সর্বজন স্বীকৃত অপরাধের বিচার চাওয়ার পাশাপাশি, নিজেদের অধিকার আদায়ে আন্দোলন চলছে কয়েকদিন ধরেই। এ ক্ষেত্রে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ফল বাতিল করে, নতুন করে পরীক্ষা নেওয়ার দাবিতে শিক্ষার্থীরা গত বুধবার সমবেত হয় রাজধানীর কয়েকটি পয়েন্টে। সকালের দিকে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে থেকে মিছিল বের করে শাহবাগের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু শাহবাগ পর্যন্ত যাওয়া আর হয়নি তাদের। এদিকে পুলিশ তাদের আটক করে শাহবাগ থানায় নিয়ে যায়। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনলাইন দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের বন্দুকের বাট দিয়ে বেদম মারছে পুলিশ। এদিকে টেনেহিঁচড়ে এক ছাত্রীর পোশাক ছিঁড়ে ফেলারও অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রশ্ন ফাঁসের জঘন্য এক নজির সৃষ্টির পর শান্তিপ্রিয় প্রতিবাদকারীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর এমনি চড়াও হওয়ার ঘটনা কখনোই কাঙ্ক্ষিত নয়।
বেশ কয়েকবার সময় পাল্টে বিতর্কিত এ মেডিকেল কলেজ ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়। এ ক্ষেত্রে পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস থেকে শুরু করে আরো কিছু গুরুতর অভিযোগ ওঠে শুরু থেকেই। তারপর ফল প্রকাশ হলে দেখা যায় ঘটেছে বিপর্যয়। মেধাবীরা সেখানে স্থান পায়নি, জায়গা পেয়েছে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পাওয়া শিক্ষার্থীরা। এতে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে অভিভাবকরা রাস্তায় নামেন বাধ্য হয়ে। অন্তত চিকিৎসার মতো একটি পেশা কিছুতেই কলুষিত হওয়ার বিষয়টি মানতে চাননি কেউ। তাই শুরু থেকে কিছুটা অসংগঠিত হলেও টানা ১২ দিন ধরে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ চলছে। কিন্তু বিধি বাম; এবার অবাক বিস্ময়ে সংবাদকর্মীরা দেখলেন প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের মিছিলটি শাহবাগ থানার কাছাকাছি পৌঁছাতেই অবিশ্বাস্যভাবে লাঠিপেটা করল পুলিশ। এমনকি ১৬ জনকে আটকও করা হলো। এঁরা কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে যুক্ত নয়, বরং প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় আটক হতে হলো তাদের।
বিভিন্ন দৈনিকের পাশাপাশি এনটিভি অনলাইনে প্রকাশিত ছবি থেকে স্পষ্ট হয় এদিনের আসল চিত্র। কোনো ছবিতে দেখা গেছে টেনে-হিঁচড়ে আন্দোলনকারীদের কাউকে শাহবাগ থানায় নিচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা। একটি জনপ্রিয় পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে এসেছে, ‘মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করে নতুন করে পরীক্ষা নেওয়ার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা আজ (বুধবার) সকাল ১০টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে বিক্ষোভ করেন। পরে তাঁরা মিছিল নিয়ে বেলা ১১টার দিকে শাহবাগ মোড়ের দিকে যান। এ সময় পুলিশ জাদুঘরের সামনের বাধা তুলে দেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জাদুঘর পেরিয়ে এলে পুলিশ তাঁদের বন্দুকের বাট দিয়ে মারধর করে। টেনে-হিঁচড়ে এক ছাত্রীর পোশাক ছিঁড়ে ফেলে। এ সময় মিছিল থেকে ১৬ জনকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। অন্য শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেন। পুলিশ গিয়ে তাঁদের তাড়িয়ে থানায় নিয়ে যায়। এদিকে ধরপাকড়ের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শাহবাগের দিকে যায় সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের কর্মীরা। তখন তাদের সঙ্গে পুলিশের ধস্তাধস্তি শুরু হয়।’
আমরা জানি, গত ১৮ সেপ্টেম্বর দেশজুড়ে একযোগে অনুষ্ঠিত সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজগুলোতে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। অনেক শিক্ষার্থী এক বুক স্বপ্ন নিয়ে এ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে শুধু দুর্নীতি ও প্রশ্নফাঁসের অনৈতিকতার কাছে নতি স্বীকারে বাধ্য হয়। এ নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু হয় বাংলাদেশের প্রায় ১০টি জেলায়। প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে সরকারি বাহিনী আটকও করে কয়েকজনকে। তারপরও সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন।
একটু খেয়াল করলে দেখা যায় এ বছর সেপ্টেম্বর মাস আমাদের জন্য বয়ে এনেছে এক অশনি সংকেত। অদ্ভুতভাবে বেতন বৃদ্ধির এক বাজেট পাস, অবাঞ্ছিত করারোপ আর শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরুর পর থেকে আর শান্ত হয়নি দেশ। সর্বশেষ প্রশ্ন ফাঁসের বিরুদ্ধে রাজপথে অবস্থান নিয়েছে আন্দোলনকারীরা। নিরুত্তাপ অবস্থানকারীদের ওপর পুলিশী আক্রমণ নিঃসন্দেহে কোনো আশার কথা বলে না। অন্তত এসব মানুষ নিজ অধিকার আদায়ের জন্য শুধু সমবেত হয়েছে। তবে তারা সুসংগঠিত নয়। আর সে সুযোগে পুলিশ চড়াও হয়ে প্রথম রাতেই বিড়াল মারতে চাইছে, কিন্তু বাস্তবে তার ফলাফল হতে পারে ভয়াবহ।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি না করে যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করার অধিকার মানুষের আছে এবং অবশ্যই এ আন্দোলনে বাধা দেওয়ার নৈতিক অধিকার কারো নেই। সেদিক থেকে চিন্তা করলে পুলিশ তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেনি, নিজ নামের প্রতি অবিচার করে প্রবৃত্ত হয়েছে জঘন্য জিঘাংসায়।
প্রশ্ন ফাঁসের এই ঘটনা একদিকে আমাদের চিকিৎসা সেবার ভবিষ্যৎ যেমন অন্ধকার করে দিচ্ছে, তেমনি উচ্চশিক্ষার জন্যও উপস্থিত করেছে এক অশনি সংকেত। তাই যতদ্রুত সম্ভব এ ক্ষেত্রে সুষ্ঠু তদন্তের ব্যবস্থা করা উচিত। শুধুই নামমাত্র তদন্ত কমিটি গঠন নয়, এর পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের উপযুক্ত শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব না হলে এ অপকর্ম লাগাতার চলতেই থাকবে। আর চিকিৎসার মতো ক্ষেত্র এভাবে কলুষিত হতে থাকলে তার ভবিষ্যৎ যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মেডিকেল ভর্তীচ্ছু শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন বাস্তবিক অর্থে যেকোনোভাবেই সংঘটিত হোক না কেন এখানে পুলিশের আক্রমণ বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর অহেতুক আঘাত এলে তাদের জন্য সংঘাতের পথ বেছে নেওয়ার বিকল্প থাকে না। অন্তত নেলসন ম্যান্ডেলা যেখানে বলেছেন 'When a man is denied the right to live the life he believes in, he has no choice but to become an outlaw.' সেখানে অহেতুক শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ একইসাথে চরম হতাশা ও আশঙ্কার জন্ম দেয়। অন্তত যারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ধুয়ো তুলেছেন তাঁরা এর থেকে বুঝে নিতে পারেন সিদ্ধান্তটি কত সর্বনাশা হতে পারে। অর্থাৎ একবার কোনোক্রমে প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে পুরো দেশের উচ্চশিক্ষা ধ্বসিয়ে দিয়ে একবারের পরীক্ষায় যথেষ্ঠ, যেমনটা ভুক্তভোগী হয়েছেন এবারের মেডিকেল ভর্তীচ্ছুরা। যাই হোক কখনোই অবাস্তব দমননীতি ও পুলিশী আক্রমণ নয় বরং দোষী ব্যক্তিদের উপযুক্ত শাস্তির আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি এ পরীক্ষা বাতিল করে আরেকদফা পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে এ জাতীয় সংকট থেকে উত্তরণকল্পে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকেই। নচেৎ পুরো জাতির জন্য অপেক্ষা করছে এক অনিশ্চিত, অন্ধকারময় ও দুর্ভাবনার ভবিষ্যৎ।
লেখক : পি এইচ ডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।