নেপাল সংকট
নতুন সংবিধানে অন্য নেপালের গল্প
কাহিনী অনেক প্রাচীন, গল্পের ভঙ্গিটাও একটু অন্য রকম। আর বিষয়বস্তুর বদলে বর্ণনাক্রমে বদলেছে কুশীলব। এবার সবগুলো গল্প নেপালের, একান্তই তাদের গল্প। জনৈক নরেং-এর টুইট এমনি বার্তা দিচ্ছে প্রতাপশালী ভারতের বিরুদ্ধে তিনি কোনো ভূমিকা না রেখে, ভণিতা না করে দুর্জয় সাহসে ভর করে লিখে বসেছেন ‘নরেন্দ্র মোদি মাই পিপল, মাই মাদেশ, মাই তেরাই, মাই প্রবলেম, মাই নেপাল, মাই কনস্টিটিউশন, মাই প্রাইড। ইউ #ব্যাকঅফইন্ডিয়া। জনৈক সুস্মিতার টুইটে আবার অন্য সুর। তিনি বলতে চাইছেন নেপাল ভারতের জনগণের বিরুদ্ধে নয়, বরং ভারতের দমননীতির বিরুদ্ধে নেপালিদের এই প্রতিবাদ। স্বেচ্ছা নামে আরেক তরুণী বলতে চাইছেন, নরেন্দ্র মোদি আমাদের তুচ্ছজ্ঞান করবেন না, আমরা ছোট হতে পারি অক্ষম নই। এ ক্ষেত্রে তারা নতুন সংবিধানে যেমন এক অন্য নেপালকে পেয়েছেন তার ওপর আর যাই হোক অন্তত ভারতীয় হস্তক্ষেপ কখনোই মেনে নিতে চান না তাঁরা। এদিকে প্রতিবাদের দিক থেকে আরেক কাঠি সরেস নেপালের ক্যাবল অপারেটররা। তারা প্রতিবাদের অংশ হিসেবে বন্ধ করে দিয়েছে সব ধরনের ভারতীয় চ্যানেলের প্রচারণা। এ ক্ষেত্রে তাদের অভিযোগ, এসব ভারতীয় চ্যানেল বৃহত্তর নেপালি জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে, তারা প্রচার করছে নেপালের স্বার্থবিরোধী নানা সংবাদ।
সামান্য কয়েকটি টুইটারের হ্যাশট্যাগ কিংবা ক্যাবল অপারেটরদের লাইন কানেকশন কেটে দেওয়ায় নেপালের বৈপ্লবিক পরিস্থিতি বুঝে নেওয়া সম্ভব নয়। বিশ্ব গণমাধ্যম এখন অনেক কারণে উত্তপ্ত। স্নায়ুযুদ্ধের চরম পর্বে এসে রুশ-মার্কিন দ্বৈরথ বেশ ভয়াবহ মোড় নিয়েছে। এদিকে সিরিয়ার শরণার্থী সমস্যা, সৌদি আরবের মিনায় রাজ পরিবারের অন্যায়ের বলি হয়ে সহস্রাধিক মানুষের প্রাণহানি, হজ আয়োজনের নানা ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়ে ইরানের লাগাতার হুমকি-ধমকি, সব মিলে গণমাধ্যমে দৃষ্টি পুরোপুরি নেপালে নিবিষ্ট নয়। তবে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম, বিশেষ করে টুইটার এবং ফেসবুকে নেপালিদের পোস্টগুলো থেকে সেখানকার অবস্থা কিছুটা আঁচ করা যায়। অন্যদিকে আর যাই হোক থেমে নেই ভারতীয় গণমাধ্যমও। নানা দিক থেকে যাই হোক অন্তত ভারত চাইছে নেপালের রাজনীতিকে একটু ফোকাসে রাখতে। আর তাদের প্রচারিত সংবাদের সবখানেই এক রকম উচ্চকিত প্রতিবাদী সুর নিদান করছে, আর যাই হোক বোঝা যায় অন্য রকম এক বিপ্লবী আবহ বিরাজ করছে নেপালজুড়ে।
দীর্ঘ বিলম্বের পর নেপালের পার্লামেন্টে আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন সংবিধান গৃহীত হলে তা ভালোভাবে নিতে পারেনি তাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত। আর সংকটের শুরুটা সেখানেই। তাদের প্রভাব ও উগ্র নেপালি জাতীয়তাবাদীদের সরাসরি ভূমিকায় নেপালে দেখা দেয় ব্যাপক মতবিরোধ। নতুন এ সংবিধান সেখানে সৃষ্টি করে ভয়াবহ রকমের জটিলতা। বিবিসি বাংলা থেকে শুরু করে বেশির ভাগ দৈনিকের এশিয়া অঞ্চল নিয়ে প্রধান আলোচ্য হয়ে উঠেছে নেপালের সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া থেকে শুরু কর তার আনুষঙ্গিক নানা দিক।
নব্য প্রণীত এ সংবিধান প্রভাবশালী প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে নেপালের যে তিক্ততার সূচনা করেছে, তার ভিত্তিমূল অনেক গহিনে প্রোথিত। এ সংবিধান গৃহীত হওয়ার বিষয়টি থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে সমর্থন মেলেনি ভারতে তরফ থেকে। কারণ শুরু থেকে ভারত বুঝতে পেরেছে নেপাল নতুন দিনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে ভারতে সমর্থন নয় নেপালি জাতীয়তাবাদ, কৃষ্টি-কালচার ও আঞ্চলিক বাস্তবতা গুরুত্ব পাবে অনেক বেশি। আর শেষে সেখানে ঘটেছেও তাই। দেখা যাচ্ছে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর দেশ নেপাল নতুন সংবিধান অনুযায়ী আর আগের অবস্থানে নেই। তারা এখন পুরোদস্তুর ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্র; যেখানে রাজাদের দাপট কমে গেছে অনেক। বলতে গেলে আংশিক হলেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রজাতান্ত্রিক শাসন কাঠানো। তাদের কেন্দ্রশাসিত সাতটি প্রদেশে বিভক্ত প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো নতুন করে দেশ গড়ার প্রত্যয় নিচ্ছে এরই মধ্যে।
নেপালের নতুন নতুন সংবিধানে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা নিয়ে যে অনুচ্ছেদ যুক্ত হয়েছে তা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের প্রভাবকে প্রান্তিক ও গৌণ করে তুলতে পারে বলে শুরু থেকেই অভিযোগ ছিল বিশেষজ্ঞদের তরফ থেকে। সেখানে প্রাচীন যুগ থেকে প্রচলিত ধর্ম ও সংস্কৃতির সুরক্ষা থেকে শুরু করে ধর্মান্তরকরণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে নতুন সংবিধান। পাশাপাশি সেখানে ধর্মীয় ও লৈঙ্গিক সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যের ওপর নিষেধাজ্ঞাও যুক্ত হয়েছে বেশ গুরুত্ব সহকারে। ফলে সেখানে অবস্থানরত সংখ্যালঘু মুসলিম ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর মৌলবাদী হিন্দুদের জুলুম-পীড়নও কমে আসবে অনেকাংশে। এটা গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক ভালো নজির হলেও হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের পক্ষে তা সহজে মেনে নেওয়ার কথা নয়। খুব সম্ভবত নেপালের সংবিধান নিয়ে মতানৈক্যের শুরুটা এখানেই।
নেপালের রাজনৈতিক বদল থেকে শুরু করে সেখানে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করার ব্যাপারে বিগত কয়েক দশক ধরে সক্রিয় আছে ভারত। কিন্তু দেশটির নতুন সংবিধান প্রণয়নের সঙ্গে সঙ্গে তাতে বাগড়া দিয়ে বসেছে ভারত। তারা বলতে চাইছে এটা একদিকে যেমন ব্যাপকভিত্তিক হয়নি, অন্যদিকে উগ্র জাতীয়তাবাদের দোষে দুষ্ট। এর পাশাপাশি সেখানে সব মানুষ এই সংবিধান মেনে নেবে না। ফলে এদিক থেকেও ভারত উদ্বিগ্ন যে সংবিধানকে কেন্দ্র করে দেশটিতে যে সহিংসতা ছড়াবে, তার উত্তাপ স্পর্শ করবে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকেও।
নেপালের নতুন সংবিধান নিয়ে ভারতের উদ্বেগ অমূলক নয় বরং একদিক থেকে ধরতে গেলে যৌক্তিকই বটে। বিগত কিছুদিনের ঘটনাপ্রবাহে একদিকে ভারতের প্রতিক্রিয়া যেমন উল্লেখ করার মতো। তেমনি সহিংস নেপাল দ্রুত কোনো স্থির অবস্থানে যাবে বলে মনে হচ্ছে না। বিশেষ করে নতুন সংবিধান আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হওয়ার কয়েক দিন আগেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পররাষ্ট্রসচিব এস জয়শঙ্করকে নেপালে পাঠান। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, জয়শঙ্কর নেপাল সরকারকে পার্লামেন্টে সংবিধান অনুমোদনের বিষয়টি বিলম্বিত করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে সংবিধানের বিরোধিতাকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসারও আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি যেখানে নেপাল শুরু থেকেই একাত্ম হতে পারেনি। বরং নেপাল তাদের ইচ্ছেখুশি সংবিধান প্রণয়ন করে তাদের প্রয়োজন বাস্তবায়নের পথ করে নিয়েছে বলে মনে করছেন সবাই।
অনেকগুলো ভারতীয় গণমাধ্যম প্রচার করেছে কাঠমান্ডুতে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত নেপালের পার্লামেন্টে সংবিধান গৃহীত হওয়াকে নানাভাবে প্রভাবিত করতে চেষ্টা করেছেন। অন্তত এর কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালার সঙ্গে। কিন্তু সংবিধান গৃহীত হওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে নয়াদিল্লির অসন্তুষ্টির কথা প্রধানমন্ত্রী কৈরালাকে জানিয়েও বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি ভারতের ওই রাষ্ট্রদূত। তাই তো সংবিধান প্রণয়নের স্বল্প সময়ের ব্যবধানে প্রতিক্রিয়া আসে ভারতের তরফ থেকে। সেখানে ভারতের সীমান্তসংলগ্ন নেপালের কিছু এলাকা সহিংস হয়ে ওঠার ইঙ্গিত ছিল স্পষ্ট। তাই নেপালে চলমান সহিংসতা কমার ক্ষেত্রে ভারতের উদ্যোগ নেতিবাচক বলেই মনে করছেন অধিকাংশ নেপালি।
নেপাল-ভারত সীমান্তসংলগ্ন তেরাই এলাকায় নতুন সংবিধান নিয়ে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে। মদেশি ও থারু সংখ্যালঘুরা শুরু থেকেই তেমন কোনো অধিকার লাভ করেনি। তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভারতের সাহায্যের ওপর নির্ভর করতেন। পাশাপাশি আরো অনেক কারণেই তারা এবারের নতুন সংবিধান নিয়ে উদ্বিগ্ন। তারা এমনিতেই দুর্বল অবকাঠামো নিয়ে টিকে আছেন তাই এখন তাদের আশঙ্কা, প্রদেশে ভাগ হয়ে গেলে রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক হয়ে পড়া তাদের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দেবে। তবে মদেশি ও থারু মিলে নেপালের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ যাদের সংখ্যাগত দিক থেকে অবহেলা করার সুযোগ নেই। অন্তত মদেশিদের সঙ্গে ভারতের কিছু মানুষের জাতিগত ঘনিষ্ঠতার সূত্রে তারা কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় নেপালিদের চেয়েও শক্তিশালী। তাই নতুন সংবিধান প্রণয়নের পর তারা যে সহিংসতা করছে, সেখানে ভারতের সমর্থন থাকার বিষয়টিকে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই।
নতুন সংবিধান নেপালিদের অনেকগুলো স্বপ্ন দেখালেও তা বাস্তবায়নের পথ যে অনেক বন্ধুর, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্তত ভারত তাদের অধিকার ও ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাই হোক সেটাকে মেনে নেবে না। পাশাপাশি নেপালের ভেতরে অবস্থানরত ভারতীয় সমর্থকদের অধিকারে টান পড়ে এমন বিষয়ও বেশ সতর্ক নজরে রাখছে ভারত সরকার। বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগোষ্ঠীর দেশ নেপালে একটি সেকুলার প্রজাতান্ত্রিক কাঠামোর বিকাশ ঘটুক এটা হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা কিছুতেই চাইবে না। আর সে ক্ষেত্রে সংবিধান যাই বলুক, তারা পাশে পাবে খোদ ভারত সরকার ও তাদের সমর্থকদের। এই সমর্থন কাজে লাগিয়ে তারা অধিকার আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন করে পুরো সহিংস করে তুলবে নেপালের রাজপথ। সব মিলিয়ে নতুন সংবিধান নেপালকে রঙিন স্বপ্ন দেখাচ্ছে ঠিকই, তাই বলে এর বাস্তবায়ন অতটা সহজ নয়। কারণ এ সংবিধানে যুক্ত হয়েছে অনেকগুলো বিষয়, তাই প্রশ্নও রয়ে গেছে দেদার। আর সবগুলো প্রশ্নের উত্তর এ অবস্থায় ঠিক দুয়ে দুয়ে চার পর্যায়ে মিলিয়ে নেওয়া যেমন সম্ভব নয়, তেমনি নেপাল প্রশ্নে কোনো উপযুক্ত সমাধান হাজির করা এ মুহূর্তে সম্ভবও নয়। এ জন্য সরাসরি কোনো মন্তব্য না করে অন্তত একটি অশান্ত পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করার দুর্ভাবনা নিয়েই আরো কয়েকদিন অপেক্ষা করাটাই শ্রেয়। আর ঠিক তখনই উত্তর মিলবে নতুন সংবিধান কী দিতে পেরেছে? একটি সুখী সমৃদ্ধ নেপাল নাকি সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও সহিংসতার বিষে দগ্ধ অরাজক দুর্ভাবনার দেশ।
লেখক : পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।