নির্বাচন
ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহার কেমন হলো?
প্রবীণ রাজনীতিবিদ, সংবিধানপ্রণেতা, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কর্ণধার ড. কামাল হোসেন এই মর্মে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন, তাঁর দল তথা জোট ক্ষমতায় গেলে ‘রাষ্ট্রের মালিকানা’ জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেবেন। বর্ষীয়ান এই নেতা ১৭ ডিসেম্বর তার দল ও জোটের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করতে গিয়ে এই অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। তাঁর ঘোষিত ইশতেহারে নির্বাচনকালীন সরকারসহ ১৪টি প্রতিশ্রুতি ও ৩৫টি অঙ্গীকার রয়েছে। ঘোষিত ইশতেহারে আরো একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য।
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সমাজের উদ্ভূত সংকটের জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতাকে চিহ্নিত করে থাকেন। ২০০৭-০৮ সালের সামরিক সমর্থিত সরকারের সময় এই ভারসাম্যের বিষয়টি বহুল আলোচিত হয়। কিন্তু সামরিক বাহিনীর সিদ্ধান্তহীনতা এবং যথার্থ প্রাতিষ্ঠানিকতার অভাবে বিষয়টি মীমাংসিত হয়নি। এ ছাড়া ড. কামাল যেসব পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার মধ্যে রয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল, বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ এবং প্রতিহিংসার রাজনীতির অবসান। ড. কামাল আরো প্রতিশ্রুতি দেন যে জাতীয় ঐক্যই তাঁদের লক্ষ্য। তিনি আরো যেসব প্রতিশ্রুতি দেন তার মধ্যে রয়েছে ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা, নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ। তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে কর্মসংস্থান থেকে প্রাধান্য দিয়ে একটি শিক্ষা কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেন।
এ ছাড়া জাতির ভবিষ্যৎ যোগ্য নেতৃত্ব বিকাশের পথকে সুগম করার লক্ষ্যে প্রথম বছরই ডাকসুসহ সব প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করা হবে। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, ক্ষমতায় গেলে পিইসি এবং জেএসসির মতো অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা বাতিল করা হবে। এ ছাড়া তাদের ইশতেহারে আরো যেসব বিষয়ে বক্তব্য দেওয়া হয় তার মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্য, খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংস্কার, বিচার বিভাগের পৃথককরণ, কৃষি ও কৃষকের সমৃদ্ধি, দ্রুত শিল্পায়ন, শ্রমিক কল্যাণ সাধন, ব্যাংক খাত শেয়ারবাজার ও বাজেট সংস্কার।
এককালের বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির অনুসরণের প্রতিশ্রুতি দেন। পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়—নীতি অনুসৃত হবে। সার্কসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক জোটসমূহ আরো শক্তিশালী করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সমতার ভিত্তিতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে আরো পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সব ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো জোরদার করা হবে। নিকটতম অন্যতম প্রতিবেশী মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডের যেসব প্রকল্প দেশের জন্য লাভজনক বিবেচিত হবে, সেগুলোতে বাংলাদেশ যুক্ত হবে। মুসলিম দেশসমূহসহ বিভিন্ন অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে আলাদা নীতির ভিত্তিতে সম্পর্ক উন্নয়ন করা হবে। তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন, রোহিঙ্গা সমস্যাসহ সকল দ্বিপক্ষীয় সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হবে।
ড. কামাল হোসেন তাঁর প্রতিরক্ষা পরিকল্পনায় বলেন, রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে একটি জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন করা হবে। সকল বিতর্ক এবং রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে রেখে সশস্ত্র বাহিনীকে গড়ে তোলা হবে। শুধু প্রতিরক্ষা বিষয়ে ডিজিএফআইর কর্মকাণ্ড সীমিত থাকবে। রাষ্ট্রীয় কোনো নিরাপত্তা সংস্থা কোনোরকম রাজনৈতিক বিষয়ে যুক্ত হবে না কিংবা হস্তক্ষেপ করবে না। প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয় যুদ্ধাস্ত্র এবং অন্যান্য সরঞ্জাম অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কেনা হবে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে সশস্ত্র বাহিনীর অংশগ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো হবে।
এসবের ভিত্তিতে প্রমাণ করা যায়, ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহার একটি যুগান্তকারী প্রতিশ্রুতি। আমরা আশা করি, দেশ ও জাতির স্বার্থে নির্বাচনটি নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হবে।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।