সাদা চোখে
এমন পাশবিকতার শেষ কোথায়?
খাসির মাংস খেয়েও নিষিদ্ধ অঞ্চলে গরুর মাংস খাওয়ার সন্দেহ কিংবা বৃদ্ধ দলিতের পূজা পাঠ! দাদরি থেকে নয়ডা, নাশকতা কয়টা? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সত্যি অনেক কঠিন হয়ে যাবে যে কারো জন্যই। শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে হতবিহ্বল হয়ে ফিরছে প্রশ্নকর্তা, উত্তরদাতারা নির্বিকার; নৃশংস আদিমতা অবস্থানে সমুন্নত। বিশ্বব্যাপী সংখ্যালঘু অধিকার নিয়ে যত প্রশ্ন, যত আলোচনা আর আইনকানুন হোক না কেন, আমাদের প্রতিবেশী দেশটি যেন এক ভিন্ন পথের যাত্রী। এখানে ধর্ম কিংবা বিশ্বাসের গণ্ডি নয়, সামাজিক শ্রেণি হয়ে উঠেছে নিষ্পেষণের মূলমন্ত্র। কয়েক দিন আগে প্যাটেল সম্প্রদায়ের নিরঙ্কুশ কোটা নিশ্চিত করার আন্দোলনে যেমন পুরো বিশ্ব হতবাক হয়েছিল, তার রেশ কাটতে না কাটতেই ঘটে গেছে পাশবিক কিছু হত্যাকাণ্ড। ফ্রিজে খাসির মাংস রাখার পরও গরু খাওয়ার অপরাধে ৫০ বছরের বৃদ্ধ আখলাককে হত্যার পর সপ্তাহ পেরোতে পারেনি, এবার খুন হয়েছেন খোদ সনাতন ধর্মীয় নাগরিক।
বিভিন্ন দৈনিকে প্রচারিত সংবাদ থেকে জানা গেছে, মন্দিরে ঢোকার অপরাধে ৯০ বছর বয়সী দলিত বৃদ্ধ চিম্মাকে হত্যা করা হয়েছে। দেশটির উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের হামিরপুরা জেলায় গত বুধবার এ পাশবিক ঘটনা ঘটেছে। প্রথম দিকে প্রভাবশালীর চাপে ঘটনাটি চেপে গেলেও দুদিন পর গত শুক্রবার প্রকাশ পায় সে নির্মমতার সংবাদ। আক্রমণের ভয়ে সাধারণ মানুষ নয়, ঘটনাটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছে উত্তরপ্রদেশের পুলিশই। তাদের বিবৃতি থেকে হিন্দুস্তান টাইমস যে সংবাদ প্রচার করেছে সেখানে দেখা যায়, উত্তরপ্রদেশের কানপুর থেকে ১৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হামিরপুরা গ্রাম। সেখানে গত বুধবার সন্ধ্যায় চিম্মা নামের দলিত শ্রেণির বৃদ্ধ স্থানীয় এক বাবার মন্দিরে পূজা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু এই পূজাপাঠ যে তাঁর ভবলীলা সাঙ্গের কারণ হবে, সেটা কে ভেবেছিল।
বর্ণভেদের চরমে থাকা উত্তরপ্রদেশে চিম্মার মতো মানুষ কতটা অবহেলিত-পদদলিত, তা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। চিম্মা মন্দিরে ঢুকতে গেলে সঞ্জয় তিওয়ারি নামের উচ্চবর্ণের এক হিন্দুই তাঁকে বাধা দিয়েছে। নিম্ন শ্রেণির সর্বংসহা চরিত্র হিসেবে এটাকে স্বাভাবিক মেনে মন্দির থেকে বের হয়ে যান চিনা। তার পর অনেক অপেক্ষা শেষে এই দলিত বৃদ্ধ তাঁর স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে ঢুকেছিলেন মন্দিরে, যা সঞ্জয় তিওয়ারির দৃষ্টি এড়ায়নি। প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ সঞ্জয় ও তাঁর সঙ্গীরা প্রথম চিম্মাকে কুঠার দিয়ে পাশবিক উন্মত্ততায় কুপিয়েছে। তাতেও ক্ষান্ত দিতে পারেনি সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্ত সঞ্জয়ের সাঙ্গপাঙ্গোরা। এর পর মৃত্যু নিশ্চিত করতে মন্দির চত্বরে রাখা আগুনে জীবন্ত ফেলে দেওয়া হয় চিম্মাকে। এ সময় ওই দলিত বৃদ্ধের স্ত্রী শান্তি ও ছেলে দুর্জনও সঞ্জয়ের চেলাদের মারধর ও কোপ থেকে রক্ষা পাননি। এ ক্ষেত্রে তাঁদেরও হত্যার চেষ্টা চলে বলে জানিয়েছে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ।
ঘটনার পর জালালপুর থানার পুলিশ কর্মকর্তা রামাশ্রয় যাদব যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা অপরাধের যোগ্য শাস্তি কতটুকু নিশ্চিত করতে পারবে তা নিয়ে সংশয় রয়েই গেছে। তবে এ ঘটনার মূল অভিযুক্ত সঞ্জয়সহ আরো তিনজনকে গ্রেফতার এবং তাদের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ গঠন করাটা নিশ্চিত করা হয়েছে পুলিশের তরফ থেকে। নিহত দলিত বৃদ্ধ চিম্মার ছেলে দুর্জনের বরাত দিয়ে ভারতের দৈনিকগুলো বর্ণনা দিতে চেষ্টা করেছে এ পশুত্বের। তারা জানিয়েছে, এ দুর্ঘটনার দিন দুর্জন ও তাঁর বাবা-মা উপোস থেকে বিশেষ ব্রত পালন করছিলেন। আর তার অংশ হিসেবেই মন্দিরে ঢুকতে গিয়ে সঞ্জয়ের নৃশংস আচরণের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁর বাবাকে। প্রথমবারের বাধার পর তাঁরা দীর্ঘক্ষণ মন্দিরের বাইরে অপেক্ষা পর্যন্ত করেছিলেন; কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। এদিকে, সন্ধ্যায় সঞ্জয় ও তার সাঙ্গপাঙ্গোরা মন্দিরের বাইরে যাওয়ার পর তাঁরা তিনজন পূজা করতে মন্দিরে ঢুকলেই সংবাদ পেয়ে ফিরে আসে সঞ্জয়। প্রকাশ্যে ওই মন্দির চত্বরেই তিনজনকে কুপিয়ে জখম করে। তার বর্বর উন্মত্ততা দেখে অবশ্য কেউ ওই বৃদ্ধকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসতে পারেনি। বিভিন্ন দৈনিক বলছে, সবার চোখের সামনে বৃদ্ধ চিম্মাকে আগুনে ঠেলেই শান্ত হয়নি সঞ্জয়, বরং তাঁর পোড়া শরীরের ওপর কেরোসিন ঢেলে দিয়েছে সে। সেখানকার পুলিশ কর্মকর্তা এ কে সঞ্জয়ের নেশাগ্রস্ত হয়ে থাকার কারণে ঘটা দুর্ঘটনা বলে দাবি করলেও সবাই এখন বিশ্বাস করে, উচ্চবর্ণের ব্যক্তি সঞ্জয়কে জনরোষ থেকে বাঁচাতেই এ দাবি।
একইভাবে বলা যেতে পারে সেই আখলাকের কথা। এই উত্তরপ্রদেশেরই ছোট শহর দাদরির মানুষটিকে গরুর মাংস খাওয়ার অপরাধে নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তরা। তবে ফরেনসিক ল্যাবের পরীক্ষা প্রতিবেদনে বেরিয়ে এসেছে নির্মম সত্য। প্রতিবেদন বলছে, মোহাম্মদ আখলাকের বাড়িতে যে মাংস ছিল, তা গরুর নয়, বরং খাসির মাংস ছিল। আর সূত্রটি নিয়ে সংবাদ ছেপেছে খোদ ইন্ডিয়া টাইমস। তবুও মানুষজন তাঁর বাড়িতে হামলা করে সে গরুর মাংস খায় এবং ফ্রিজে রেখে দিয়েছে, এই অপরাধে। শুধু সন্দেহের বশে তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করে তারা। এ জন্য শুধু মোহাম্মদ আখলাকই নন, তাঁর ২২ বছর বয়সী ছেলে দানিশকেও বেধড়ক পিটিয়েছে বিক্ষুব্ধ গো-ভক্তরা, যার পর সংবাদ প্রকাশ হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে।
উত্তরপ্রদেশ অঞ্চলে গো-হত্যা নিষিদ্ধ হলেও সেখানকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন সোচ্চার এ পাশবিক মৌলবাদের বিরুদ্ধে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এখন সক্রিয় হতে চাইছে ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলতে। তবে অতিসম্প্রতি হয়ে শেষ হওয়া প্যাটেলদের বর্ণবাদী আন্দোলন ও নানা আনুষঙ্গিকতা থেকে কোনো শুভ সংবাদ মিলছে না; বরং এ নির্মম হত্যাকাণ্ড থেকে মিলেছে বড় রকমের অনেক দুর্ঘটনার অশনিসংকেত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িকতাবিষয়ক চিন্তাধারার গণ্ডি খুব বেশিদূর এগোতে পারেনি। কতিপয় প্রতিষ্ঠিত বয়ানে এর কাঠামোকৃত একটি ব্যাখ্যা দিয়ে শেষ করার প্রবণতা তাত্ত্বিকদের মধ্যে যেমন, তেমনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরাও এর বিচার করা থেকে এড়িয়ে যেতেই বেশি সোচ্চার। তাই ঐতিহাসিক সরলীকরণ যেমন সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিচারকে বাধাগ্রস্ত করছে, তেমনি প্রান্তিক অবস্থান থেকে আরো দূরে ঠেলে দিচ্ছে সংখ্যালঘু অধিকার ও তাদের স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার সহজ দাবিকে। অন্যদিকে রাজনৈতিক মদদে শ্রেণিকৃত সাম্প্রদায়িকতার সত্যতা থাকলেও তার বিচারের ক্ষেত্রে একই দুরবস্থা। সেখানে ধর্ম, সমাজ, সম্মান কিংবা বসতি থেকে প্রতিপত্তি ও রাজনৈতিক সমর্থন মুখ্য হয়ে ওঠে আর্থিক অবস্থান বিবেচনায়। তাই তত্ত্বকথা, প্রচলিত আইন কিংবা সামাজিক প্রথায় যা-ই থাক না কেন, সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের পাগলা ঘোড়ার লাগাম টানে সাধ্য কার। প্রশ্ন একটাই, এ সংঘাত এমনি পাশবিকতার শেষটা কোথায়, কবে মুক্তি মিলবে সংখ্যালঘু দলিতের?
লেখক : পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।