স্বাধীনতা
বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে মহত্তম শিরোপা
হাজার বছর ধরে শোষণে জর্জরিত বাঙালির অবিনাশী মুক্তির মহত্তম অর্জনের নাম স্বাধীনতা। মার্চ হলো সেই স্বাধীনতার সুবর্ণ সোপানে পা রাখার অবিস্মরণীয় মাস। একাত্তরের এই মাসের ৭ তারিখে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডাক দিয়েছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই ঘোষণার পথ বেয়ে ২৩ বছরের পাকিস্তানি জঞ্জাল সাফ করার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে ২৬ মার্চ। ওই দিনটিই আমাদের স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস।
মার্চ এলেই বাঙালিকে পেয়ে বসে যুগপৎ নিদারুণ দুঃখ ও সুখের নস্টালজিয়া। ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে নিরীহ ও নিরস্ত্র বাঙালির ওপর প্রবল আক্রোশে হানাদার বাহিনীর ঝাঁপিয়ে পড়া এবং হাজার মায়ের বুক খালি করার ট্র্যাজেডি ভুলে যেতে পারবেন না কেউই। পাশাপাশি স্বাধীনতা ঘোষণা করার অমূল্য স্মৃতিও মানুষের মনোজগতে আজীবন দোলা দিয়ে যাবে। যে ঘোষণার মধ্য দিয়ে লাখো মানুষের রক্তগঙ্গা ও লাখো মা-বোনের সম্ভ্রমের কারুণ্য বাজি রেখে এসেছিল পরম সুখকর ১৬ ডিসেম্বর। যেই দিনটিকে আমরা বিজয় দিবসের বরমাল্যে বরণ করে নিয়েছি। বাঙালি মুক্তির অনিমেষ প্রশান্তি পেয়েছিল সেদিন। স্বাধীন ভূখণ্ডের তকমা নিয়ে বিশ্ববাসীর বিস্ময় জাগিয়েছিল আমাদের প্রাণের বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে মুক্তিকামী বাঙালিকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান বাঙালি-অবাঙালি যারা আছে, তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের ওপরে। আমাদের যেন বদনাম না হয়।’ স্বাধীনতার পরে সংবিধানে আদর্শ মূলনীতি হিসেবে উৎকীর্ণ করে দিয়েছিলেন জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ‘এই সংবিধান শহীদের রক্তে লিখিত, এ সংবিধান সমগ্র জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকবে।’
২০২১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করবে। কিন্তু এই ৫০ বছরেই বাংলাদেশে বড় বাঁকবদল ঘটে গেছে। সমাজতন্ত্র বা ধর্মনিরপেক্ষতা বলে এখন আর কিছু নেই। গণতন্ত্রও এক ধরনের সংকোচনের মধ্য দিয়ে তার কষ্টকর পথ পরিক্রমণ করছে। বাহাত্তরের সংবিধানের সর্বমানুষের সমান অধিকার সমুন্নত করার যে প্রত্যয় স্বাধীনতার অবিসংবাদিত নেতারা দেখেছিলেন, সেখান থেকে অতি ধর্মাচারি বাঙালি এক বিশেষ ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখে চলেছে। ভিন্ন ধর্মাবলম্বী কিংবা ভিন্নমতকে আমলে নেওয়ার মানসিকতা কারোরই আর অবশিষ্ট নেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ বুলালেই সংখ্যাগুরু ধর্মাচারি নেটিজেনদের মনোজগৎ পড়া যায়। তারা এখন প্রভাতফেরিতে শহীদ মিনারে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ বা স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন পছন্দ করেন না। তাদের ভাষায় এসব নাকি ক্ষমার অযোগ্য পাপ। শহীদদের স্বর্গবাসের জন্য প্রার্থনালয়ে মোনাজাতই একমাত্র কর্তব্য। যদিও দেশের কোনো ভাষাশহীদ বা মুক্তিযোদ্ধাই পারলৌকিক স্বর্গলাভের আশায় দেশমাতৃকার জন্য জীবন উৎসর্গ করেননি। দেশ ও মানুষের মুক্তিই ছিল তাদের আত্মত্যাগের মূলমন্ত্র।
বহুমাত্রিক নৈতিকতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে সুশিক্ষার ভিতটা বিশেষ ধর্মের অনুবর্তী করে ফেলা এবং ক্রমাগত অস্থিতিশীল নিরীক্ষার মধ্যে ফেলে দেওয়ায় কারো মধ্যেই এখন আর মানবিক বোধ জাগানো যাচ্ছে না। বিশ্বব্যাংক তাদের এ বছরের ‘ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট’-এ বলে দিয়েছে, শিক্ষায় দুর্বল মানের কারণে বাংলাদেশের একজন শিশুর ১১ বছরের স্কুলজীবনের সাড়ে চার বছরই নষ্ট হয়। শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতার পেছনে চারটি বড় কারণ চিহ্নিত করেছে বিশ্বব্যাংক। শৈশব জীবনের মানোন্নয়ন কর্মসূচিগুলোর দুর্বলতা, নিম্নমানের পাঠদান, দুর্বল স্কুল ব্যবস্থাপনা এবং শিক্ষা খাতে সরকারি বিনিয়োগ কম। স্কুল ব্যবস্থাপনার প্রধান অনুষঙ্গ যোগ্যতম শিক্ষক। সেবার মানসিকতায় ভালোবেসে জ্ঞানচর্চার প্রত্যয় নিয়ে নয়, কর্মসংকটের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে দায়ে পড়ে বাছবিচারহীন মানুষ গণহারে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছে। এমন বাস্তবতায় মানুষের সভ্যতার ভিত গড়ে দিতে পারে এমন কেউ কি কোথাও থাকছে? কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘শিক্ষাবিধি’তে বলেছেন, ‘ঘুরিয়া ফিরিয়া যেমন করিয়াই চলি না কেন শেষকালে এই অলঙ্ঘ্য সত্যে আসিয়া ঠেকিতেই হয় যে, শিক্ষকের দ্বারাই শিক্ষাবিধান হয়, প্রণালীর দ্বারা হয় না।’ দৃশ্যমান প্রণালির অভাব নেই, কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখন আর মানবিকতা শিক্ষা দেয় না। শিক্ষকরাও আর অসাম্প্রদায়িক মনোভাব পোষণ করেন না। সুতরাং আমাদের আরাধ্য সর্বমানবের জন্য উপযোগী বিজ্ঞানভিত্তিক সভ্যসমাজ হয়তো অধরাই থেকে যাবে। তবে কি অজ্ঞানতার দাসত্বেই আমরা বন্দি থাকব? স্বাধীনতার মাসে এটাই বড় আশাভঙ্গের জায়গা। কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘স্বাধীনতা হীনতায়’ তাই এখনো বড় প্রাসঙ্গিক :
স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে,
কে বাঁচিতে চায়?
দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে,
কে পরিবে পায়।।
অস্বীকার করার উপায় নেই স্বাধীনতা অর্জনের প্রায় পঞ্চাশ বছরের প্রান্তে এসে অনেক অর্জনে আমাদের শির বিশ্বসভায় অনেক উঁচু। সামাজিক ও অর্থনৈতিক অনেক সূচকই বেশ আশা-জাগানিয়া। তারপরও দুর্নীতির লাগাম যদি টেনে ধরা যেত, বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকা যদি বিদেশে পাচার না হতো, মানবাধিকার ও আইনের শাসন যদি নিশ্চিত করা যেত, তবে আমাদের অবস্থান নিশ্চিতই আরো সুদৃঢ় হতো। কিন্তু আমাদের বোধ এখন পুরোদস্তুর আড়ষ্ট। বিবেক রাজদণ্ড কর্তৃক অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। বিচার-বিবেচনা লোভের অতলান্তিকে নিমজ্জিত। বিজ্ঞান ও সাহিত্যরহিত হালের এই বঙ্গে রবীন্দ্র ও নজরুল চর্চার বদলে একমাত্র ধর্মপুস্তকই স্থান পাকাপোক্ত করতে চলেছে। পিতৃতান্ত্রিক এই সমাজে নারীরাও ধর্মের আশ্রয়ে দিন দিন নিজেদের অবগুণ্ঠিত করবার প্রয়াস পাচ্ছে। তবু আশাবাদী আমরা, এখনো কবি শামসুর রাহমানের কবিতাতেই আমাদের শ্রেষ্ঠতম অর্জন স্বাধীনতার সুখ খুঁজি :
স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা—
স্বাধীনতা তুমি
রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।