রম্য
পাতালে হাসপাতাল
অনেক দিন আগে হাসপাতালে যাওয়ার রাস্তা খুঁজছিলেন এক ভদ্রলোক। তিন রাস্তার মোড়। ফলে বিপাকে পড়ে আরেক পথচারীকে জিজ্ঞেস করলেন—ভাই, এই রাস্তাটা কি হাসপাতালে গেছে? পথচারী কী বলেছিলেন? থাক, এখনই বলছি না।
আমার মতো অনেকেরই হাসপাতাল-ভীতি হয়তো আছে। হাসপাতাল নামটি শুনলেই কেমন যেন হাঁসফাঁস অবস্থা তৈরি হয়। তার পরও প্রয়োজনের তাগিদে হাসপাতালে যাই। কখনো নিজের প্রাণ ওষ্ঠাগত হলে তা ঠেলে ভেতরে পাঠাতে হাসপাতালে গিয়ে নগদ খরচ করে চিকিৎসকদের হাতে-পায়ে ধরতে হয়। অথবা কোনো স্বজন-পরিজনকে শেষ দেখা দিতে, নয়তো শরীরের তাজা রক্ত ঢেলে দিতেও হাসপাতালে যাতায়াতের দুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্য দুটোই আমার হয়েছে। তবে বলে রাখি, কোনো প্রয়োজনেই আমি হাসপাতালে যেতে চাই না। মানে সরল করে বললে, আমি হাসপাতালে ভর্তি হতে চাই না। আমি না চাইলে কী হবে, হাজার হাজার মানুষ আছে, যারা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার জন্য আন্দোলন করছে। অবশ্য তারা আমার মতো রোগী হিসেবে নয়, হাসপাতালে ভর্তি হতে চায় ছাত্রছাত্রী হিসেবে।
রোগী ভর্তি আর ছাত্রছাত্রী ভর্তির মাঝে বিস্তর ফারাক। রোগীকে ভর্তি হওয়ার জন্য কোনো পরীক্ষা দিতে হয় না; পরীক্ষা করাতে হয়। মূত্র থেকেই সাধারণত হাসপাতালে ভর্তি প্রক্রিয়ার সূত্রপাত হয়। যে রোগই আপনার হোক, প্রথম দফাতেই চিকিৎসক মূত্রের কয়েকটি সূত্র পরীক্ষা করিয়ে নেন। তার পর আসে রক্তপাতের পালা। হাসপাতালে রোগী হিসেবে ভর্তি হয়ে একই রক্তের পরীক্ষা একাধিকবার করাননি এমন মানুষ কমই পাওয়া যাবে। হাসপাতালগুলো রক্তের পরীক্ষা বারবার করিয়ে হয়তো এ কথাটিই মনে মনে বলে—রক্ত যখন নিয়েছি, রক্ত আরো নেব। অবশ্য তারা শুধু রক্তই নেয় না, পরীক্ষার নামে রক্তের চেয়ে বেশি দামি জিনিসও তারা পকেট থেকে বের করে নেয়। সেই দামি জিনিসটি কী, তা আর মুখে বলছি না।
একবার কেউ রোগী হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে, তিনি সারা জীবনের জন্য রোগী হয়ে যান। মৃত্যু ছাড়া হাসপাতাল থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় থাকে না। হাসপাতালগুলোও চায় না, আপনি সুস্থ হোন। তারা ভান করে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার লম্বা ফর্দ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, এগুলোর রিপোর্ট পেলেই রোগ ধরা পড়বে। আর একবার রোগটি ধরা পড়লে তা না সারিয়ে ছাড়ছি না। আহ, শুনেই শান্তি লাগে। অবশ্য রোগ ধরার আগে হাসপাতালগুলো ধরার চেষ্টা করে—রোগী বিত্তবান, নাকি বিত্তহীন। তার পর টেস্টের মাধ্যমে রোগ ধরা পড়ার পর রোগীসহ আত্মীয়স্বজনও হাসপাতালের কাছ ধরা পড়ে যান। ডাক্তার সাহেব চশমার ফাঁক দিয়ে চোখ দুটোকে ঝুলিয়ে দিয়ে যখন স্বজনদের বলেন, ‘ওষুধগুলো কন্টিনিউ করান। বাসায় নিয়ে যেতে পারেন, কিন্তু রিস্ক আপনাকেই নিতে হবে। সময়মতো অ্যাম্বুলেন্স না পেলে হাসপাতালে আসার পথেই যদি কিছু হয়ে যায়, তখন আবার আমাকে দোষ দিতে পারবেন না। এমনিতেই তো আমাদের দোষের শেষ নেই।’ ডাক্তারের এমন কথার পর স্বয়ং যমদূতও তার স্বজন-পরিজনকে হাসপাতাল থেকে যমালয়ে (নিজ বাড়িতে অর্থে) নিতে সাহস পাবেন না।
তার পরও ওই সব ছেলেমেয়ে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হতে চায়। ওরা প্রশ্ন ফাঁসের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। শহীদ মিনার থেকে শপথ নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দিকে যেতে চায়। মেডিকেলে ভর্তি হতে না পারলে যেন ওদের জীবন তেজপাতা হয়ে যাবে। ওদের এমন আচরণ দেখে মনে হয়, ছেলেমেয়েরা মানুষ না হয়ে ডাক্তার হতে চায়, এটা দুর্ভাগ্যজনক।
আমার মতো অনেকেই এখনো বিশ্বাস করে, মেডিকেল আর বুয়েটে যারা পড়ে, তারাই সবচেয়ে মেধাবী। হয়তো কথাটি সত্য। আবার নাও হতে পারে। যদি তা-ই হবে, তাহলে মেধা খাটিয়ে প্রশ্ন ফাঁস করার যোগ্যতা যাদের নেই, তারা মেডিকেলে ভর্তির জন্য আন্দোলন করে কীভাবে। ফাঁস করতে পারার যোগ্যতাই তো বড় যোগ্যতা। শুধু পড়াশোনায় ট্যালেন্ট হলে তো হবে না, তোমার আউট নলেজও থাকতে হবে। ছোটবেলায় এই কথা কে শোনেননি বলেন! পাঠ্যপুস্তকের বাইরে, পেপার-পত্রিকা-অনলাইন-টিভি দেখে, নয়তো ভ্রমণ করে আউট নলেজ অর্জন করা যায়। কিন্তু এখন আউট নলেজ মানে প্রশ্ন আউটের নলেজ থাকাকে মিন করা হয়।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বারবার দাবি করছেন, যাঁরা ভর্তি হয়েছেন, তাঁদের কোনো আউট নলেজ নেই, মানে প্রশ্ন ফাঁস হয়নি। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করছে না। তার পরও তিনি বলে যাচ্ছেন। এর আগে শিক্ষামন্ত্রীও প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা প্রশ্নসহ সব প্রশ্ন ফাঁসের পরই একইভাবে, একই সুরে বলেছিলেন—প্রশ্ন ফাঁস হয়নি। তাঁরা যখন টিভিতে চরম আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেন, প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ সঠিক নয়, কিছু কুচক্রীমহল এসব ছড়াচ্ছে, তখন আমার তা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। কোটি কোটি দর্শকের সামনে মন্ত্রীরা ভুল বলতে পারেন, এটা আমি বিশ্বাস করি না। আমার ভোটে নির্বাচিত এমপি-মন্ত্রীরা ভুল বলতে পারেন না, যদি ভুল বলেন, তবে ধরে নিতে হবে আমার ভোটও ভুল মানুষকেই দিয়েছি।
যাক, মন্ত্রীর মতো উঁচু পদের মানুষদের নিয়ে আমার মুখে কথা বলা মানায় না। আমি বরং কীভাবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের হাসপাতালে ভর্তি করা যায়, সেই বিহিত করি। প্রথম কথা হলো, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া, প্রশ্ন ফাঁসের যোগ্যতা না থাকায় তারা শিক্ষার্থী হিসেবে যদি ভর্তি হতে না পারে, তবে তারা রোগী হিসেবে হতে পারেন। এ ক্ষেত্রে তারা নিজেরা যদি রোগী হতে না পারেন, তবে কারো সাহায্য চাইতে পারেন। সাধারণ মানুষকে সাহায্য করা যাদের দায়িত্ব, সেই পুলিশ ভাইদের গিয়ে যদি তারা বলেন—আমরা মেডিকেলে ভর্তি হতে চাই, সাহায্য করেন। সেবা করার সুযোগ পেয়ে পুলিশ গুলি খরচ না করে লাঠি দিয়ে মৃদু প্রহার করেও সাহায্য করতে পারে। তাদের ওপর এটুকু ভরসা তো আমরা রাখতেই পারি!
রোগী হিসেবে ভর্তি হওয়া আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা হাসপাতালের বেডে যদি মেডিকেলের সিলেবাস আর বইখাতা নিয়ে বসে পড়েন, তখন কি শিক্ষক-চিকিৎসকরা তাদের না পড়িয়ে পারবেন? রোগী বলে কথা। রোগীই হাসপাতালের লক্ষ্মী! তাদের প্রথম দিকের ক্লাসগুলো ইন্টার্ন ডাক্তাররাও নিতে পারেন। ডাক্তারি পড়তেও তো লাখ লাখ টাকা খরচ করতে হয়, সেই খরচের টাকা হাসপাতালে দিয়ে দিলেই হলো—রোগী/শিক্ষার্থী যে রূপেই হোক। হাসপাতাল পেল টাকা, আন্দোলনরত শিক্ষার্থী পেল ভর্তির সুযোগ, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কথাও ঠিক থাকল। ব্যস, কী সুন্দর সমাধান দিয়ে দিলাম।
সেই পথিকের উত্তরটি নিশ্চয়ই আপনারা খুঁজে পেয়েছেন এতক্ষণে। তার পরও উত্তরটি বলছি, পথের কি ডায়রিয়া হয়েছে যে হাসপাতালে যাবে? এখন যদি কেউ প্রশ্ন করেন—ভাই, এই রাস্তা কি হাসপাতালে গেছে? জবাব হবে—না, পাতালে গেছে।
লেখক : সাংবাদিক, মাছরাঙা টেলিভিশন।