অর্থনীতি
ডেটন কি নোবেল পাওয়ার যোগ্য?
সব অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে এবার অর্থনীতিতে নোবেল জিতে নিলেন ইঙ্গো-মার্কিন অর্থনীতিবিদ অ্যানগাস ডেটন (Angus Deaton) । দ্য রয়েল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেসের হিসেবে ভোগ, দারিদ্র্য ও জনকল্যাণ নিয়ে মৌলিক গবেষণা রয়েছে তাঁর। যার স্বীকৃতিস্বরূপ এ বছর অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার গেছে তাঁর ঝুলিতে। দেশের প্রধান বাংলা বাণিজ্য দৈনিকে কাজ করার সুবাদে এ নোবেল জয়ের অনেক আগে থেকেই অন্তত নামটা জানার সুযোগ হয়েছিল ডেটনের। বিশেষ করে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে ২০১৩ সালের দিকে বের হওয়া ডেটনের ‘দি গ্রেট এস্কেপ : হেলথ, ওয়েলথ অ্যান্ড দি অরিজিন অব ইনইকুয়্যালিটি’ বইটি দীর্ঘদিন থেকেই আমার আইপ্যাডে রয়েছে। এর প্রথম দিকের কয়েকটি চ্যাপ্টার বেশ আগ্রহ নিয়ে পড়েও দেখেছি, কিন্তু তারপর আর এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে হয়নি। জানি না দোষটা তাঁর কেমব্রিজের শিক্ষায় নাকি প্রিন্সটনের অধ্যাপনায়; অদ্ভুত হলেও সত্য এ ইঙ্গো-মার্কিন অর্থনীতিবিদ কোনো উন্নয়নশীল দেশকে অনুদান দিতে বিরোধিতা করে আসছেন শুরু থেকেই।
সেই ১৯৭৫ সালের ঘটনা বেশ আলোড়ন তুলেছিল তাঁর বিখ্যাত অভিসন্দর্ভ (Models of consumer demand and their application to the United Kingdom)। তবে কোনো একদিন তিনি যে নোবেল জিততে যাচ্ছেন এটা ছিল অনেকের কাছেই কল্পনাতীত। ১২ অক্টোবর ২০১৫ সোমবার সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে দ্য রয়েল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেস সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেওয়ার সাথে সাথে অনেক বিষয় সামনে উঠে এসেছে। বিশেষ করে প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে লেখা বিশেষ নিবন্ধে তাঁর চিন্তার সারমর্ম তুলে ধরলেন ডেটন নিজেই- “Much of Africa and Asia, states lack the capacity to raise taxes or deliver services. The contract between government and governed – imperfect in rich countries – is often altogether absent in poor countries. যদিও পুরস্কার ঘোষণাকালে নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘ডেটনের গবেষণা ব্যাষ্টিক; সামষ্টিক উন্নয়ন অর্থনীতিতে অবদান রেখেছে এটা নিয়ে চিন্তার অবকাশ রয়েছে।’
আমাদের বাংলাদেশ কিংবা ভারতের মতো দেশগুলো নিয়েও ডেটনের ভাবনা রয়েছে সেগুলোকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশের নানা বিষয়কে তিনি দেখতে চেয়েছেন একান্ত নিজের মতো করে আর সমস্যাগুলো সেখানেই। তিনি ভোক্তাদের নানা প্রাসঙ্গিকতাকে সামনে আনতে চেয়েছেন যেখানে বর্ণনার মারপ্যাঁচে ঠুনকো হয়ে উঠেছে ক্রেতার অধিকার। তবে আফ্রো-এশিয়া নিয়ে তাঁর চিন্তাটা বেশ অদ্ভুত যেখানে তিনি বলতে চেয়েছেন রাষ্ট্র চাইলেই করবৃদ্ধি করে মানুষের কাঙ্ক্ষিত সেবা নিশ্চিত করতে পারে না। তিনি মনে করেন উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নানা সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা থাকলেও তারা অন্তত চেষ্টা করে উপযুক্ত কর আদায় করে তার থেকে নাগরিক সুবিধা প্রদান করতে। কিন্তু অনুন্নত ও দরিদ্র দেশগুলোর পক্ষে ন্যূনতম মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা ঠিক ততটাই চ্যালেঞ্জিং ঠিক যেমনটা অসম্ভব বলে প্রতীয়মান হয় কর আদায়ের বিষয়টি।
প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে প্রকাশিত নাতিদীর্ঘ নিবন্ধে ডেটনের উক্তিটিতে(In much of Africa and Asia, states lack the capacity to raise taxes or deliver services. The contract between government and governed – imperfect in rich countries – is often altogether absent in poor countries. The New York cop was little more than impolite (and busy providing a service); in much of the world, police prey on the people they are supposed to protect, shaking them down for money or persecuting them on behalf of powerful patrons. Even in a middle-income country like India, public schools and public clinics face mass (unpunished) absenteeism. Private doctors give people what (they think) they want – injections, intravenous drips, and antibiotics – but the state does not regulate them, and many practitioners are entirely unqualified. Throughout the developing world, children die because they are born in the wrong place – not of exotic, incurable diseases, but of the commonplace childhood illnesses that we have known how to treat for almost a century. Without a state that is capable of delivering routine maternal and child health care, these children will continue to die.) ফুটে উঠেছে এমনি নানা অস্বস্তিকর বিশ্লেষণ যা অনেকাংশেই বাস্তবতা থেকে যোজন যোজন দূরের প্রসঙ্গ। অন্তত আমরা জানি মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হোক আর নাই হোক, আমাদের দেশে কীভাবে করারোপ করা হয়েছে এবং তা আদায়ে সরকার কীভাবে সফলতার মুখ দেখেছে। যাইহোক আমাদের দেশে জনগণের বিনা বাক্যব্যয়ে কর প্রদানের যে রীতি তা একাংশে ডেটনের চিন্তাধারাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে।
ছেলে ও মেয়ে শিশুর প্রতিপালনে পারিবারিক বৈষম্য, অপুষ্টি, জীবনযাত্রার ধরন থেকে শুরু করে আরো নানা বিষয় ঠাঁই পেয়েছে ডেটনের নানা বক্তব্যে। সেখানে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার দিকে ইঙ্গিত করলেও শেষ পর্যন্ত উপযুক্ত সমাধান অনুপস্থিত থাকতেই দেখা গেছে কার্যত। অন্তত এবারের নোবেল জয়ের পর তিনি ইউরোপের রিফিউজি ক্রাইসিস নিয়ে যে বক্তব্য রেখেছেন সেখানেও রয়েছে অদ্ভুতুড়ে মতদ্বৈততা। তিনি কোনো প্রশ্নের উত্তর কিংবা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা না করে সরাসরি বক্তব্য দেন যুদ্ধ ও দারিদ্র্যকে উদ্ধৃত করে (What we're seeing now is the result of hundreds of years of unequal development in the rich world, which has left a lot of the world behind) যা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক। তবে পুরো বিশ্বের দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে তিনি যেখানে একমাত্র বিশ্বব্যাংক বাদে আর কোনো সমাধান পাচ্ছেন না, সেখানে সমালোচকরা বলতেই পারেন তাঁর নোবেল প্রাপ্তির হেতু কী?
সবাই যেখানে দারিদ্র্যবিমোচনে একের পর এক নতুন চিন্তার দ্বার উন্মুক্ত করতে ব্যস্ত সেখানে বদলায়নি ডেটনের একঘেঁয়ে আদি সামন্তবাদী ভাবনাগুলো।(Certainly, the immediate effects are likely to be better, especially in countries where little government-to-government aid actually reaches the poor. And it would take an astonishingly small sum of money – about 15 US cents a day from each adult in the rich world – to bring everyone up to at least the destitution line of a dollar a day. Yet this is no solution. Poor people need government to lead better lives; taking government out of the loop might improve things in the short run, but it would leave unsolved the underlying problem.)তিনি দারিদ্র্যবিমোচনের চেয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিয়েছেন সামষ্টিক রাষ্ট্রীয় উন্নয়নকে। তিনি মনে করেন রাষ্ট্রজুড়ে শত সহস্র মানুষ বাস করে যাদের সার্বিক জীবনযাত্রার মান নিয়ে ভাবা উচিত রাষ্ট্রের। নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবার অবস্থা নিয়ে চিন্তা করাটা নিছক বোকামি এবং তা রাষ্ট্রীয় উন্নয়নকে ব্যাহত করতে পারে। তাইতো ডেটনের হিসাবে- For many, many people in the world, things are very bad indeed. বিশেষ একটি কারণেই পৃথিবীর আর্থ-রাজনৈতিক পরিসর এখনো বদলাচ্ছে না; যা অনেকটা আজগুবিও মনে হতে পারে অনেকের কাছে।
গবেষক জীবনের শুরুতে ডেটন অর্থনীতির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। তিনি প্রশ্ন রেখেছিলেন, মানুষের দিনানুদৈনিক ব্যয়ের হ্রাস-বৃদ্ধি কীভাবে সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিসরে প্রভাব বিস্তার করে। বিশেষ ক্ষেত্রে দ্রব্যমূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধি মানুষের আয়বিশেষে সামাজিকভাবে প্রভাব বিস্তার করে, তবে এর ফলে তার জীবনযাত্রা প্রভাবিত নাও হতে পারে। আর এর ওপর ভিত্তি করেই ১৯৮০ সালের দিকে এবং ব্যষ্টিক অর্থনীতিবিদ জন মুয়েলবয়ের(John Muellbauer) একটি আইডিয়াল ডিমান্ড সিস্টেম(Ideal Demand System) তথা বিশেষ নমনীয় আর্থিক সমীকরণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। সেখানে সাফল্য কিংবা ব্যর্থতার খতিয়ান হিসাব করার আগে চিন্তা করতে হচ্ছে এবারে ডেটনের আবিষ্কার কীভাবে উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতি চিন্তার ক্ষেত্র পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। তবে উন্নয়ন, রাজস্ব আদায়, জনশক্তি উন্নয়ন থেকে শুরু করে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মতো নানা প্রসঙ্গে আধিভৌতিক কানাগলিতে ঘুরপাক খাওয়া থেকে শাপমুক্তি ঘটেনি ডেটনের চিন্তাকাঠামোর, উত্তর মেলেনি অনেক যৌক্তিক প্রশ্নের। তবুও তিনি নোবেল জয়ী, সবচেয়ে জোরের হাততালিটা বরাদ্দ থাকছে তাঁর জন্যই। সেটা মাথায় রেখেই হয়তো ক্রিশ্চিনা প্যাক্সনদের (Christina Paxson) মতো অর্থনীতিবিদরা নতুন দিগন্ত উন্মোচনের স্লোগানটা(His research helped establish the idea that you could study development economics with great integrity, with very, very, high standards.) বেশ উচ্চস্বরে উচ্চারণ করতে পারছেন।
লেখক : পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।