২৫ মার্চ
নৃশংসতম এক গণহত্যার রাত
আজ ভয়াল ২৫ মার্চ। ইতিহাসের নৃশংশতম গণতহ্যার এক ভয়াল কালরাত। পাশবিকতা, নৃশংসতা, হিংস্রতা আর জিঘাংসার এক দিন। একাত্তরের এই রাতে নরঘাতক বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী হিংস্র হায়েনার মতো রক্ত লালসায় উন্মত্ত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বাধীনতাকামী বাঙালির ওপর। রচনা করে পৃথিবীর বুকে জঘন্যতম এক গণহত্যার ইতিহাস।
রাত তখন আনুমানিক সাড়ে ১০টা কী ১১টা। সারাদিনের কর্মব্যস্ত ঢাকা শহর প্রস্তুতি নিচ্ছে ঘুমের। ঘরে ঘরে অনেকে এরই মধ্যে ঘুমিয়েও পড়েছে। ঠিক সেই সময়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে জিপ, ট্রাক বোঝাই করে নরঘাতক বর্বর, কাপুরুষ পাকিস্তানের সৈন্যরা ট্যাঙ্ক, মর্টারসহ নানা ধরনের আধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে শহরজুড়ে। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে গর্জে উঠে অত্যাধুনিক রাইফেল, মেশিনগান, মর্টার। মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণে প্রচণ্ড আঘাতে ঝাঁকি খেয়ে কেঁপে উঠে ঘুমন্ত নগরী। পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনী শান্ত, নিরস্ত্র, ঘুমন্ত বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হিংস্রতার এক চরম জিঘাংসা নিয়ে। শুরু করে বাঙালির ইতিহাসে এক বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ! ধ্বংসের এক উন্মত্ত তাণ্ডব! সামরিক ভাষায় এই নিধনযজ্ঞের নাম তারা দিয়েছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’!
দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা দুই জাতির বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ এড়িয়ে তৎকালীন পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বাঙালি হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়নের জন্য শুরু করলেন এই অপারেশন। নিজে অবশ্য সেনাবাহিনীর এক বিশেষ বিমানে চুপিচুপি পাড়ি জমালেন করাচি। হত্যাযজ্ঞ বাস্তবায়নের জন্য রেখে গেলেন জেনারেল টিক্কা খান ও রাও ফরমান আলীদের। তাদের নেতৃত্বে শুরু হলো পৃথিবীর কাপুরুষোচিত এক গণহত্যা!
হতচকিত বাঙালি ঘুম ভেঙে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঢলে পড়তে লাগল মৃত্যুর কোলে। নারী, শিশু, ভয়ার্ত মানুষের কান্না-আর্তচিৎকারে ভারি হয়ে উঠল শহরের আকাশ। একটু আগেই প্রাণোচ্ছলতায় ভরপুর ছিল যে শহর, মধ্যরাতে হঠাৎ পরিণত হলো লাশের শহরে! রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, নীলক্ষেত, নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে পাকহানাদার বাহিনী শুরু করল হত্যাযজ্ঞ! রাজধানী শহরটাজুড়ে হঠাৎ করে যেন উড়ে এসে চেপে বসল শতশত মৃত্যুর দূত! বাছবিচার ছাড়া তারা মেতে উঠল খুনের হোলি খেলায়। এই এক রাতেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী নৃশংসভাবে হত্যা করল প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক নিরস্ত্র বাঙালিকে। ইতিহাসের পাতায় রচিত হলো এক জঘন্য কালো অধ্যায়! বিশ্ববাসী যেন এই জঘন্য ধ্বংসযজ্ঞের কথা জানতে না পারে সেইজন্য এর আগেই ঢাকা থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে সকল বিদেশী সাংবাদিকদের। কোনোরকমে লুকিয়ে থাকলেন কেবল ব্রিটিশ সাংবাদিক সায়মন ড্রিংক। পরবর্তীতে তারই পাঠানো সংবাদে বিশ্বের মানুষ জানতে পারলো কী ভয়ানক নরহত্যা চালিয়েছিল পাকহানাদার বাহিনী এদিন ঢাকা শহরে। কেমন করে জীবন্ত একটি শহরকে মুহূর্তেই পরিণত করেছিল মৃত্যুর বিভীষিকায়!
মানুষ মেরেই ক্ষ্যান্ত হলো না তারা। বাংলাদেশের পক্ষে থাকা গণমাধ্যমগুলোও রেহাই পায়নি সেদিন তাদের বর্বরতা থেকে। তারা অগ্নিসংযোগ করে, মর্টার সেল ছুড়ে একে একে দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, জাতীয় প্রেসক্লাব ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে ফেলে! হত্যা করে প্রথিতযথা গণমাধ্যমকর্মীদের অনেককে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র অধ্যাপকরাও বাদ পড়েননি এই হত্যাযজ্ঞের কবল থেকে। অধ্যাপক ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, অধ্যাপক ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিভিন্ন বিভাগের নয়জন শিক্ষককে নৃশংসভাবে হত্যা করে তারা। ঢাকা শহরের ভীতসন্ত্রস্ত মানুষদের মনে হতে থাকে দেশে যেন রোজ কেয়ামত নেমে এসেছে! ইস্রাফিলের শেষ বাঁশি যেন বেজে উঠেছে! আর একটি প্রাণও বুঝি জীবিত থাকবে না এ দেশে। সব ধূলিস্মাৎ হয়ে যাবে।
মধ্যরাতের পর গ্রেপ্তার করা হয় বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু মেখ মুজিবুর রহমানকে। গ্রেপ্তারের আগেই ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে দেশের মানুষের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। ঘোষণা করেন বাঙালির বহুদিনের লালিত স্বপ্ন কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। গোপন ওয়্যারলেস বার্তায় তিনি বলেন- ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। ছাত্র-জনতা-পুলিশ-ইপিআর শত্রুর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়েছে। আমি ঘোষণা করছি আজ থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। সর্বস্তরের নাগরিকদের আমি আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারা যে যেখানে যে অবস্থাতেই থাকুন, যার যা আছে তাই নিয়ে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ না করা পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। সম্মিলিতভাবে শত্রুর মোকাবিলা করুন। এই হয়তো আপনাদের প্রতি আমার শেষ বাণী হতে পারে। আপনারা শেষ শত্রুটি দেশ থেকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যান।’
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ভেবেছিল একযোগে হামলা করে, বর্বরোচিত গণহত্যা চালিয়ে, অগ্নিসংযোগ করে, ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে প্রচণ্ড আতঙ্ক সৃষ্টি করে বাঙালির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে! তাদের সেই ভাবনা যে ঠিক কতটা ভুল ছিল তা আজ সগর্বে লেখা আছে ইতিহাসের পাতায়। বাঙালি আতঙ্কিত হয়েছিল বটে, তবে ভেঙে পড়েনি। খুন হয়েছিল বটে, তবে মরে যায়নি! ঘুরে দাঁড়িয়েছে। প্রবল বিক্রমে ঘুরে দাঁড়িয়ে গড়েছে পাল্টা সশস্ত্র প্রতিরোধ! প্রতিটি আঘাতের, প্রতিটি হত্যার সমুচিত জবাব ফিরিয়ে দিয়েছে হায়েনাদের। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের ভেতর দিয়ে ছিনিয়ে এনেছে প্রাণের পতাকা, স্বাধীন সার্বভৌম আজকের বাংলাদেশ।
লেখক : শিক্ষক, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ