ঢাকা চিড়িয়াখানা
গণ্ডারের সঙ্গী ভেড়া কেন?
সেদিন হঠাৎ করে চোখ আটকে গেল নন্দিত কথাসাহিত্যিক ঔপন্যাসিক মঈনুল আহসান সাবেরের ফেসবুক স্ট্যাটাসে। তিনি লিখেছেন, ‘পত্রিকা জানাচ্ছে, ঢাকা চিড়িয়াখানায় একটিমাত্র গণ্ডার অবশিষ্ট আছে। সেটির ছবি ছাপা হয়েছে। ছবিতে গণ্ডারের মুখোমুখি একটি ভেড়াও দেখা যাচ্ছে। ছবির ক্যাপশন বলছে, প্রাণীটির (গণ্ডার) একাকিত্ব কাটাতে সঙ্গী হিসেবে দেওয়া হয়েছে একটি ভেড়া। ছবিটি দেখে ও ক্যাপশন পড়ে প্রথমে খটকা লাগে। গণ্ডার আর ভেড়া! পরমুহূর্তে মনে হয়, ঠিকই আছে। বাংলাদেশে গণ্ডার আর ভেড়া- এই দুই প্রকার ছাড়া আর আছেই বা কি!’ সাবের সাহেবের স্ট্যাটাস পড়ে তাড়াতাড়ি পত্রিকা হাতাতে শুরু করি, সংবাদটি পেয়ে যাই; সত্যি বলতে চক্ষু ছানাবড়া হওয়ার জোগাড়।
বাংলাদেশে শিশুদের থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষকে বিশ্বের নানা দেশি জীবজন্তুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে জাতীয় উদ্যোগ বলা যায় মিরপুর চিড়িয়াখানাকে। কিন্তু মিরপুর সনি সিনেমা হল কিংবা এক নম্বর বাসস্ট্যান্ড থেকে লক্কড়মার্কা গাড়িগুলো দেখে যে হতাশার জন্ম নেয়, ঠেলেঠুলে চিড়িয়াখানা পর্যন্ত পৌঁছে গেলে সে হতাশার প্রহর আরো দীর্ঘায়িত হয় বৈ কি। বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা থেকে জানা যাচ্ছে গত সপ্তাহে ভরদুপুরে ২১ বছর বয়সী রয়েল বেঙ্গল টাইগার প্রমীলার মৃত্যু হলেও তা চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ মানতে নারাজ। এর পেছনে কী ধরনের কারণ লুকিয়ে আছে তা নিয়ে উচ্চবাচ্য করছেন না কেউই।
বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার সূত্র থেকে পাওয়া সংবাদ বিশ্লেষণ করে এবং মিরপুর চিড়িয়াখানার নিকটতম স্থানে বাস করায় লোকমুখে জেনে খুব হতাশ হয়েছি বিগত ছয় মাসে। নানাভাবে জেনেছি, অযত্ন-অবহেলায় চিড়িয়াখানায় বসবাসরত প্রাণীগুলোর যন্ত্রণা ও দুর্দশার কথা, যাদের মধ্যে অন্তত ছয়টি প্রাণী মারা গেছে গত কয়েক মাসে। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে কেনা শিম্পাঞ্জি, জিরাফ, সিংহ ও একটি জলহস্তী পটল তুলেছে এরই মধ্যে। লোকমুখে শোনা যায়, ‘বছর কয়েক আগে জনৈক সিংহমামা সুযোগ বুঝে ভেগে যায় তার খাঁচা থেকে। তারপর রেড অ্যালার্ট জারি করে মিরপুর থানাকে অবহিত করে কর্তৃপক্ষ। যতক্ষণ থানা থেকে পুলিশ ভাইয়েরা রওনা হয়েছেন, ততক্ষণে বেজায় বিরক্ত মামা ভাবল ধুরছাই আমি অন্তত ঢাকাবাসীর মতো অভাগা নই, যাই খাঁচার শাহেন শাহ আমি, সেখানেই ফিরে যাই। তাও অন্তত কালো ধোঁয়া, দূষিত পানি, যানজট আর গাড়ির লাগাতার হর্নের চেয়ে ভালো’, এগুলো প্রচলিত হাস্যরস হলেও বাস্তবতা সত্যি অনেক ভয়াবহ। নানা অব্যবস্থার বলি হয়ে তড়পাচ্ছে অনেক প্রাণী, তাদের অনেকে প্রাণ হারাচ্ছে দলে দলে, কিন্তু চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ সে সংবাদগুলো চেপে যাচ্ছে গোপনে। এদিকে পত্রিকাঅলারা ছেপে যাচ্ছেন দু-একটা, তাতেই যা জানার সুযোগ হয় আমাদের।
জানা গেছে, নিঃসঙ্গতা ও বার্ধক্যজনিত কারণে মারা গেছে একটি শিম্পাঞ্জি, যার পাশাপাশি সম্প্রতি কোনো বড় প্রাণীর মৃত্যু মেনে নিতে নারাজ কর্তৃপক্ষ। তাদের হিসেবে, রয়েল বেঙ্গল টাইগার প্রমীলা মরেছে চিকিৎসায় থাকা অবস্থায়। দৈনিক প্রথম আলোর দেওয়া সূত্রমতে, ‘চিকিৎসার জন্য প্রমীলাকে অচেতন করে হাসপাতালের প্রকোষ্ঠে আনা হয়েছিল। কিন্তু তার আর জ্ঞান ফেরেনি। আর প্রমীলার ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা বলেছেন, প্রমীলার হৃদযন্ত্র ও কিডনিতে সমস্যা ছিল। ফুসফুসেও কালো দাগ পাওয়া গেছে। পাশাপাশি জাতীয় চিড়িয়াখানা ও কেন্দ্রীয় পশুরোগ অনুসন্ধান গবেষণাগার সূত্র জানায়, গত জুন মাসে চিড়িয়াখানার একমাত্র শিম্পাঞ্জিটি মারা যায়। এই দুর্লভ ও মূল্যবান প্রাণীটি দীর্ঘদিন ধরে একাকী ছিল। এরপর জুলাই মাসে মারা যায় একটি জিরাফ ও একটি জলহস্তীর বাচ্চা। অন্য জলহস্তীর সংঘবদ্ধ আক্রমণে বাচ্চাটি মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিল। ওয়াইল্ডবিস্ট হৃদরোগে (হার্ট অ্যাটাক) আক্রান্ত হয়েছিল বলে জানা গেছে। আর সিংহটি ভুগছিল বার্ধক্যে।’
বিভিন্ন রোগে মারা যাওয়া পশুপাখির রোগ শনাক্ত করার জন্য নমুনা রাজধানীর পুরান ঢাকার কাজী আলাউদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় পশুরোগ অনুসন্ধান গবেষণাগারে পাঠানো হলেও তা থেকে উপযুক্ত তথ্য মিলছে না। পশুপাখি মৃত্যুর হার যেভাবে বাড়ছে, তাতে এই চিড়িয়াখানা শিগগিরই দর্শক হারাবে। তা ছাড়া দর্শকদের স্বাস্থ্যও হুমকির মুখে পড়তে পারে, যেহেতু পশুপাখি নানা ধরনের ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তাই। রোগাক্রান্ত পশু থেকে জীবাণু মানুষের শরীরে গিয়ে ভয়াবহ মহামারীরও জন্ম দিতে পারে। বিষয়গুলো অনেক সহজবোধ্য সত্য হলেও তা নিয়ে কর্তৃপক্ষের এসব বিষয়ে চিন্তা আছে কি? এমনকি এ বিষয়ে সঠিক কোনো তথ্যও কি আছে তাদের কাছে? বিশেষ করে পাখিদের মধ্যে দেখা গেছে জন্ম ও মৃত্যুহার প্রায় সমান। অন্যদিকে ২০১২ সালে কেনা দুটি সাদা গণ্ডারের একটি, চার হায়েনার তিনটি, তিন গ্রেটার কুদুর দুটি, একটি অরিক্স বিভিন্ন সময়ে মারা গেলেও তার উপযুক্ত কারণ অনুসন্ধান করা হয়নি।
লেখার শুরুতেই বলেছিলাম গণ্ডার ও ভেড়াকে এক সীমানার ভেতরে রাখার কথা। দুনিয়ার আর কোনো চিড়িয়াখানায় এমন কাণ্ড হয় কি না জানা নেই। এমন কাণ্ড ছাড়া আরো নানা অব্যবস্থাপনার কথা প্রায়ই উঠে আসে জাতীয় দৈনিকে। তো এসব দূর করতে যদি সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় উদ্যোগী হয় তবে সুন্দর ও সাজানো- গোছানো চিড়িয়াখানা জাতিকে উপহার দেওয়া একটু কঠিন হলেও অসম্ভব নয়।
লেখক : পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।