স্মরণ
ফাগুন, নিশ্চিত থাকিস বাবা, আমি-আমরা বসে নেই
এক.
গত একুশে মে’র ঘটনা। আজ কতদিন হয়ে গেল, তরুণ সাংবদিক ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন হত্যাকাণ্ডের তেমন কোনো দৃশ্যমান উন্নতি নেই। একজন তরুণ সাংবাদিককে, একটি সম্ভাবনাকে কি নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো। কেন দেওয়া হলো, কারা দিল, আজ অবধি আমরা অন্ধকারে। গণমাধ্যমকর্মীদের একটা বড় অংশ বিষয়টি নিয়ে তৎপর রয়েছেন জানি। তারা খবর করছেন, লিখছেন, মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন দায়িত্বশীলদের তাদের কাজের কথাটি। আমি বাবা হয়েও ভিজে যাওয়া চোখের ঝাপসা দৃষ্টি ভেদ করে লিখে চলেছি। কিন্তু কই, দৃশ্যমান কোনো উন্নতি তো দৃষ্টিগ্রাহ্য হচ্ছে না।
দু-চারজন অবশ্য বলেন, সাগর-রুনির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় পিছিয়েছে ৩৬৫ বার। আর, আপনি তো কোন ‘ছার’। হেসে বললাম, ঠিক বলেছেন, ‘ছার’। কিন্তু আমি তো ভাই ‘ছাড়’ দেওয়ার লোক নই। কচ্ছপের কামড়ের মতো কামড়ে ধরে আছি। আমি নই, অনেকেই আছেন আমার সাথে। তাদের সন্তানের কথা চিন্তা করেই আছেন। সবারই থাকা উচিত, অন্তত যাদের সন্তান আছে। অনেকে আছেন নিজ ভাইটির কথা ভেবে। এই যে ভাবনা, তাকে মেরে ফেলবেন কী করে? ফাগুনকে তো সরিয়ে দিয়েছেন। সাংবাদিকতার জগতের একটি সম্ভাবনাকে শেষ করে দিয়েছেন। কিন্তু একজন ইহসান রেজা ফাগুন কিন্তু ক্রমশ বাড়ছে। ফাগুনের সমবয়েসী একজন ইনবক্সে লিখল, ‘আমি আপনার ফাগুন হতে চাই।’ এমনি আরো অনেক কথা। এই যে ফাগুন হওয়ার চিন্তা-ইচ্ছে, একে দমাবেন কী দিয়ে?
লীনা নামে একজন কমেন্ট করলেন, ‘সে সত্যবান, তার মৃত্যুটা গর্বের আর সাহসের। আপনি ভাগ্যবান পিতা। হাসুন, দোয়া করুন! জয় সত্যের জয়, জয় ফাগুনের জয়, জয় এই দেশের!’ যারা ফাগুনকে খুন করেছেন তাদের বলি, খুব লাভ কি হলো? ফাগুন হওয়ার ইচ্ছেয় আরো শত শত ছেলেমেয়ে কি অগ্রগামী হচ্ছে না। তারা কি ফাগুনের জয়গান গাইছে না, গাইছে তো। ফাগুন তো দেশের জয়গানই গাইত।
একজন সংবাদকর্মী লিখলেন, ‘ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ ছাড়া কোনো কালেই মুক্তি আসেনি।’ এই ভাইকে বলি, এখনতক যতগুলো ঘটনা ঘটেছে, গণমাধ্যমকর্মীরা নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন, তাদের ঘরবাড়ি আক্রান্ত হয়েছে, দেখান তো একটি ঘটনাতেও ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ উঠেছে কি না। উঠেনি। না উঠার কারণ আমার-আপনার খুব অজানা নয়। উল্টো আওয়াজ যাতে না উঠে সে চেষ্টাও দৃশ্যমান হয়েছে। তবুও তো উঠছে, সাগর-রুনির মৃত্যুর কতদিন পার হলো। মেঘ বেড়ে উঠল। বিচার হয়নি, কিন্তু আওয়াজ কি থেমেছে? মৃদু হলেও, ধীরে হলেও আওয়াজ জারি রয়েছে। কে আসল, কে বলল, তা চিন্তা না করে আমার-আপনার আওয়াজটা জারি রাখতে হবে। টোকা দিতে হবে দরজায়, দরজা একদিন ঠিক খুলে যাবে।
আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুদের একজন রোমান জাহান লিখলেন, ‘শেষ পর্যন্ত কেউ না থাকলেও আমরা তোমার সাথে থাকব, তোমার জন্য।’ জানি ওরা থাকবে। ফাগুনের জন্য লিখেছেন খ্যাত সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষক মাসকাওয়াথ আহসান, লিখেছেন আমাদের নতুন সময়ের উপদেষ্টা সম্পাদক ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম, লিখেছেন সাংবাদিক লেখক তানজিল রিমন এবং আরো অনেকে। জানি ওনারাও থাকবেন। থাকবেন অন্যজনরাও। আমি আশা ছাড়ছি না, ছাড়ব না। এই নাছোড়বান্দা জেদ শুধু আমার এক ফাগুনের জন্য নয়, আরো ফাগুনকে বাঁচাতে। ওদের জন্য থাকব। থাকব প্রতিবাদে, প্রতিরোধে, লেখায়, কথায়, পথে।
দুই.
এখন আসি অন্য ফাগুনদের কথায়। গণমাধ্যম জানাল ঈদের আগের তিন দিনে মোটরবাইক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ২২ জন মানুষ, যাদের প্রায় সবাই তরুণ। এ ছাড়া সড়কে মারা গেছেন আমার জানা পর্যন্ত প্রায় শতজন। লঞ্চডুবিও রয়েছে। ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হয়েছেন, মারা গেছেন হন্তারকদের হাতে এমন খবরও পেয়েছি।
এই যে মৃত্যু, এর জন্য দায়ী কে? দায়িত্বশীলরা তো ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন বলেই খালাস। হয়তো অন্যরাও মৃত্যুর জন্য দায়ী করবেন মৃতদেরই। কেন ভিড়ের মধ্যে উঠতে গেল। কেন জোরে বাইক চালাল। চালক পটু ছিল না। সব দোষ যারা মরেছে তাদের। এ দেশে মৃত্যুর জন্য মৃতেরাই দায়ী। শুধু বেঁচে থাকা নয়, এখানে মরে যাওয়াটাও দোষের।
কিন্তু একবারও কেউ বললেন না, দেশ ডিজিটাল হয়েছে বলে এত কথা শুনি, তবে সড়কে কোথাও কোনো গতিসীমা চেক করার যন্ত্র বসানো নেই কেন। ট্রেনের ছাদে মানুষ যায় কীভাবে। বিনা টিকেটের যাত্রীরা কাদের ভরসায় বিনা টিকেটে উঠে। ৩৬ সিটের বাস কেন এই দেশে হয়ে যায় ৪৯ সিটের। তারপর ঈদের সময় মোড়ার ব্যবস্থা করা হয়। কেন বাড়ি ফেরার মাঝপথে উধাও হয়ে যায় কেউ।
জানি, এসব প্রশ্নের উত্তরে বলবেন, ‘ছোট দেশ, লোকসংখ্যা এত বেশি, সামলানো কঠিন। এর বেশি কী করার আছে।’ কিছু যে করার নেই, তা অন্তত স্বীকার করুন। দায় নিন। বলুন, এ আমাদের ব্যর্থতা, আমরা চেষ্টা করছি। চেষ্টা করছি, মানুষ অনুযায়ী পর্যাপ্ত যানবাহনের ব্যবস্থা করতে। চেষ্টা করছি রাস্তায় গতিরোধক বসাতে। চেষ্টা করছি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের যে কাজ সে কাজে ব্যবহার করতে। হাতিরঝিল, ফ্লাইওভারের কান ঝালাপালা গল্পের পুনরাবৃত্তি না করে অন্তত এসব বলুন। মানুষ একটু হলেও স্বস্তি পাক। আশা নিয়ে থাকুক, বাঁচুক। নিজেকে প্রবোধ দিক, কিছু একটা হচ্ছে বলে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।