বিশ্বকাপ ক্রিকেট
আত্মবিশ্বাস বাড়ানো, রানরেট বাড়ানো জয় চাই
এবারের বিশ্বকাপের ফরম্যাটটা মজার। ১০ দলের সবাইকে সবার সঙ্গে খেলতে হবে। তার মানে সব দলের কমপক্ষে ৯টি ম্যাচ খেলতেই হবে। যেহেতু লম্বা টুর্নামেন্ট, তাই হুটহাট দু-একটা ফ্লুক দিয়ে কারো সেমিফাইনালে চলে যাওয়ার সুযোগ নেই। সেরা চার দলই যাবে সেমিফাইনালে। এবার সেমিফাইনালিস্ট হিসেবে চার ফেভারিট ছিল ইংল্যান্ড, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড। এবার মাঝবরাবর পর্যন্ত এভাবেই আগাচ্ছিল বিশ্বকাপ। বাংলাদেশের কাছে দক্ষিণ আফ্রিকা হেরেছে, পাকিস্তান হারিয়েছে ইংল্যান্ডকে। তবুও প্রাণ পাচ্ছিল না বিশ্বকাপ। সব যদি প্রেডিকশন অনুযায়ী চলে, তাহলে আর বিশ্বকাপ আয়োজনের দরকার কী? এক নম্বর দলকে কাপ দিয়ে দিলেই হয়। কিন্তু সেই মরা বিশ্বকাপে প্রাণ সঞ্চার করল শ্রীলঙ্কা। টপ ফেভারিট ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দিয়ে শ্রীলঙ্কা প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া সেমিফাইনালের দরজা খুলে দিয়েছে। সবার জন্য খুলে দিয়েছে বলা ঠিক হবে না। আফগানিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বকাপ শেষ। কাগজে-কলমে বাকি সাত দলেরই সেমিফাইনালে যাওয়ার আছে।
বাকি দলগুলোর কী হবে না হবে, তা নিয়ে আমার ভাবনা নেই। আমার ভাবনা শুধু বাংলাদেশ নিয়ে। গত বিশ্বকাপের পর থেকে ইংল্যান্ড এমন অসাধারণ ক্রিকেট খেলছিল, সবাই ধরেই নিয়েছিলেন, বিশ্বকাপ হবে, আর প্রথমবারের মতো কাপ নিয়ে চলে যাবে। ক্রিকেটের মজাটা দেখুন, সেই ইংল্যান্ডের সামনে এখন বাদ পড়ার শঙ্কা। ইংল্যান্ডের সামনে তিনটি কঠিন ম্যাচ অস্ট্রেলিয়া, ভারত, নিউজিল্যান্ড। ইংল্যান্ড যদি তিনটিতেই হারে, আর বাংলাদেশ যদি তিনটিতেই জেতে; তাহলে কিন্তু বাংলাদেশ যাবে সেমিফাইনালে। এমনকি দুই ম্যাচ জিতলেও বাংলাদেশের সম্ভাবনা থাকবে। তবে সঙ্গে অনেকগুলো 'যদি', 'কিন্তু' থাকবে । আমি অত হিসাব-নিকাশে যেতে চাই না। আমাদের কাজ বাকি তিনটা ম্যাচ জেতা। আমরা সেই চেষ্টাটাই করতে পারি।
সেই চেষ্টার প্রথম ধাপ আজ। টুর্নামেন্টের সবচেয়ে দুর্বল দল আফগানিস্তান। ক্রিকেটে আসলে দুর্বল আর সবল বলে কিছু নেই। আফগানিস্তান কতটা দুর্বল, সেটা ভারত হাড়ে-হাড্ডিতে টের পেয়েছে। আফগানিস্তান ম্যাচের বিপদটা এখানেই। দুদিন আগে ভারতকে নাকানিচুবানি খাওয়ানোর সাহস নিয়ে আজ তারা মাঠে নামবে। টুর্নামেন্টের কাছে তাদের চাওয়ারও কিছু নেই, হারানোরও কিছু নেই। একটা অন্তত জয় নিয়ে ফিরতে চাইবে। তাই তারা নির্ভার ক্রিকেট খেলবে। আমার ভয়টা এখানেই। সাবধান থাকতে হবে। পচা শামুকে যেন পা না কাটে। সাতবারের মোকাবিলায় বাংলাদেশ চারবার জিতেছে, আফগানিস্তান তিনবার। এবার বিশ্বকাপের পারফরম্যান্স, দলীয় শক্তির বিবেচনায় বাংলাদেশই আজ ফেভারিট। তবুও সাবধানের মার নেই।
আসলে আজ বাংলাদেশকে শুধু জিতলেই হবে না, ভালো ব্যবধানে জিততে হবে, রানরেটটা যথাসম্ভব বাড়িয়ে নিতে হবে। নতুন ম্যাচের সময় নিশ্চয়ই আমরা অতীত থেকে শিক্ষা নেব। শেষ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার কাছে পরাজয় থেকেও অনেক কিছু শেখার আছে। এবারের বিশ্বকাপে আমাদের ব্যাটিং দুর্দান্ত। কিন্তু বোলিং-ফিল্ডিং যা তা। বোলিং টুর্নামেন্টের সবচেয়ে দুর্বল। এবার আমাদের কোনো স্ট্রাইক বোলার নেই। এমনকি পাকিস্তানেরও একজন আমির আছে, শ্রীলঙ্কার বুড়ো হাড় মালিঙ্গা তো একাই হারিয়ে দিলেন ইংল্যান্ডকে। এই জায়গাটায় আমাদের বড় ঘাটতি। এর মধ্যে এবারের বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি সাইফউদ্দিনকে নিয়ে নানা বিতর্ক। প্রবল প্রত্যাশা নিয়ে দলে এলেও তা মেটাতে পারেননি রুবেল। একসময় মাশরাফি ছিলেন আমাদের স্ট্রাইক বোলার। বয়স তার ধার কমিয়েছে। আমাদের মূল ভরসা স্পিন, আফগানিস্তানও তাই। তাই এখানে লড়াই হবে ইন্টারেস্টিং।
বোলিংটা আমরা রাতারাতি বদলে দিতে পারব না। যেটা পারব সেটা হলো ফিল্ডিং। এটা নিয়েই আমার আফসোস। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছাড়া আর সব ম্যাচেই আমরা বাজে ফিল্ডিং করেছি। যার খেসারত আমাদের দিতে হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে যেখানে আমাদের ৩০ ভাগ বেশি দেওয়ার কথা ছিল, সেখানে আমরা ফিল্ডিংয়ে ৩০ রান বেশি দিয়েছি। ১০ রানে ওয়ার্নারের ক্যাচ মিস করলে আপনি ম্যাচ জিতবেন কীভাবে? আমি মনে করি, অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচের পার্থক্যটা ছিল ফিল্ডিং। বোলিংয়ে ঘাটতিটুকু আমাদের ফিল্ডিং দিয়ে পোষাতে হবে। সেটা কিন্তু খুবই সম্ভব। ফিল্ডিংয়ে ব্যর্থতা আসলে অমার্জনীয়।
বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্টে ভুল করার কোনো সুযোগ নেই। দক্ষিণ আফ্রিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে আমরা পারফেক্ট ব্যাটিং করেছি। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩৮২ রানের পাহাড়ে চড়তে যে ফ্লাইং স্টার্ট দরকার ছিল, সৌম্য সরকারের ক্যাজুয়াল রানআউটে সেটা হয়নি। আমার ধারণা সাকিবের আউটের পর বাংলাদেশ আর জেতার চেষ্টা করেনি, তাতে ২৫০ রানে অলআউট হওয়ার ঝুঁকি ছিল। বাংলাদেশ বরং পুরো ৫০ ওভার খেলে রানরেটটাকে ভালো রাখতে চেয়েছে। এই কৌশলেই নিজেদের সর্বোচ্চ ৩৩৩ রান এসেছে। বাংলাদেশের পারফরম্যান্সে সবাই খুশি। কিন্তু পরাজয়ে আত্মতৃপ্তির কিছু নেই। পরাজয় মানে শূন্য পয়েন্ট। আজ দল কী হবে, জানি না। অলরাউন্ড ব্যর্থতার পর নিশ্চয়ই সাব্বিরকে আর বয়ে বেড়ানোর কোনো মানে হয় না। সুস্থ হলে নিশ্চয়ই মোসাদ্দেক দলে ফিরবেন। সাইফউদ্দিনের ইনজুরি আর রুবেলের ব্যর্থতা এই জায়গাটা দ্বিধায় রাখবে ম্যানেজমেন্টকে। অপেক্ষায় থাকা আবু জায়েদ কি আজ কোনো চমক নিয়ে আসবে?
তামিম ফর্মে ফিরছেন, তবে ম্যাচ জেতানো ইনিংস এখনো পাইনি। আগেও বলেছি, সৌম্যকে তাঁর ইনিংস বড় করতে হবে। সাকিবের কাছে আমাদের আর চাওয়ার কিছু নেই। তিনি প্রতি ম্যাচেই নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার লড়াইয়ে নামেন। গত ম্যাচে ফিফটি না পাওয়ার দুঃখ নিশ্চয়ই আজ ঘুচিয়ে দেবেন। মুশফিক, মাহমুদুল্লাহ, লিটন নিজেদের সামর্থ্য প্রমাণ করেছেন।
আজ তাই আমার কোনো ভয় নেই। ভারতকে মোকাবিলার আগে আজ শুধু জয় নয়; আত্মবিশ্বাস বাড়ানো, রানরেট বাড়ানো জয় চাই।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।