প্রতিক্রিয়া
এবারও কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা হবে
এ সময়ে দেশের রাজনীতি অর্থনীতি যেভাবে চলছিল তাতে এমন করে অন্ধকার নামার কথা নয়। তারপরও অন্ধকার গ্রাস করল। ২৪ অক্টোবর রাতের প্রথম প্রহরে শিয়া জমায়েতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরাপত্তা বেস্টনির ভেতর গ্রেনেড ছুড়ে নিরপরাধ মানুষ মেরে আহত করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল সন্ত্রাসীরা। এরপর বেপোরোয়া খুনে সন্ত্রাসীদের টার্গেটে আঘাত করতে রাতের অন্ধকার আর বেছে নিতে হয়নি। অথবা কোনো নিভৃতে, বন-জঙ্গলে নিজেদের আড়াল করে আক্রমণ শানাতে হয়নি। ব্যস্ত রাজধানীতে দিন-দুপুরকে বেছে নিতে পারছে এরা। ভর দুপুরে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের অফিস কক্ষে ঢুকে অত্যন্ত দক্ষতায় তিন তিনজন মানুষকে কুপিয়ে-গুলি করে জনারণ্যে মিশে যেতে পারছে। এখানে এমন একজনের ওপর আঘাত করেছে যিনি ফেসবুকে হত্যার হুমকি পেয়ে মোহাম্মদপুর থানায় জিডিও করেছিলেন। মানুষ তো থানায় জিডি করে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। আশা করা হয় যেহেতু জীবনের ওপর হুমকি আছে তাই পুলিশ প্রশাসন সক্রিয় হবে। গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াবে। শেষ ফলাফল দেখে এখন অসহায় মানুষ ভাবতেই পারে— এই সময়ের বাস্তবতা পুলিশের ওপর আস্থাশীল না থাকা। জিডি করা না করা এখন একই বিষয় হয়ে দেখা দিয়েছে। তিনজনের ওপর হামলা চালিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আরেকবার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে জঙ্গিরা সন্ধ্যায় ব্যস্ত শাহবাগের আজিজ মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর ফয়সাল আরেফিন দীপনকে গলা কেটে হত্যা করে সাফল্যের সাথে নিজেদের আড়াল করে ফেলে। আর আমরা কষ্ট, ক্ষোভ আর কৌতূহলের সাথে অপেক্ষা করি পুলিশ কর্তা থেকে শুরু করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত জনগণের সামনে কী ব্যাখ্যা দাঁড় করান।
শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর প্রকাশক আহমেদুর রশিদ চৌধুরী টুটুল জঙ্গি হামলায় নিহত অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশ করে জঙ্গিদের রোষানলে পড়েন। সাহায্য চেয়েও পুলিশের কাছ থেকে সাহায্য পাননি। উপর্যুপরি খুনিদের দাপুটে পদচারণায় জনগণের মধ্যে একটি বিশ্বাস জন্মেছিল যুদ্ধাপরাধী বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মুজাহিদের ফাঁসির দণ্ড বহাল থাকার পর এই ভয়ঙ্কর খুনিদের রায় কার্যকর করাকে বানচাল করার অভিপ্রায়ে খুনিদের মাঠে নামানো হবে। এ কারণে সেভাবেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সতর্ক থাকার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এর কোনো নমুনা পাওয়া যাচ্ছে না। জিডির সূত্রও গোয়েন্দা নজরদারি কাজ করেনি। প্রতি ক্ষেত্রেই খুনিরা মিশন সফল করে নিরাপদে সরে যেতে পেরেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে খুনিদের জনগণ ধরে এনে পুলিশের হাতে দিলে তখন পুলিশ বীরদর্পে এদের দুঘা বসাতে পারবে। এমন যখন কঠিন বাস্তবতা তখন মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর তাঁর পুলিশ প্রশাসনের বক্তব্য শোনার জন্য মানুষের আগ্রহ আর তেমন থাকার কথা নয়।
দুই
আমার খুব আফসোস হচ্ছে চাপাতি আর পিস্তলের ট্রেনিং পাওয়া সাধারণ্যে জঙ্গি পরিচয়ে পরিচিত এই তরুণদের জন্য। প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষায় টুটুলদের ওপর হামলা করা তিন তরুণের বয়স ২০-এর নিচে। অর্থাৎ কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যের দরজায় পা দেওয়া। কত সম্ভাবনাময় জীবন হতে পারত এঁদের। যদি লেবাসধারী স্বার্থপর কতিপয় মানুষ ধর্মের নামে এসব তরুণকে বিভ্রান্ত করে, তাহলে আমি নিশ্চিত অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়া এই তরুণরা ইসলাম ধর্মের প্রকৃত শিক্ষার সুযোগ পায়নি এবং ধর্মের সৌন্দর্য ও মহত্বকে কখনো অনুভব করতে পারেনি। স্বার্থবাদী হিংস্র মানুষগুলো এই তরুণদের ভুলভাবে ইসলামের ব্যাখ্যা করে ওদের বিভ্রান্ত করেছে। না হলে ওরা জানত কেউ যদি ধর্মবিরোধী মনোভাবও প্রকাশ করে থাকে— চরম অন্যায় কথাও বলে থাকে তাকে শাস্তি দেওয়ার অধিকার মহান আল্লাহ মানুষের হাতে ছেড়ে দেননি। ধর্মগ্রন্থের ভাষায় প্রত্যেক মানুষের জ্ঞান সীমাবদ্ধ। মানুষের প্রকাশ্য ও গোপন সব কিছু আল্লাহই একমাত্র জানেন। আমাদের সাদা চোখে যা অন্যায়, কে জানে আল্লাহ তাঁকে কীভাবে বিচার করবেন। তাই ধর্মের বিচারে এসব বিভ্রান্ত তরুণ খুনি হিসেবে মানুষের আদালত ও আল্লাহর আদালতে অপরাধী হিসেবেই বিবেচিত হবে। অন্তত ইসলামের বিধিবিধান বুঝে থাকলে এ কথা মানতে হবে।
ব্লগের লেখা আমার খুব একটা পড়া হয়ে ওঠে না। আমার ছাত্রদের মাধ্যমে দু-একটি লেখা পড়ার সুযোগ হয়েছে। কোনো কোনো লেখা পড়ে আমি আপ্লুত হয়েছি। মনে হয়েছে বিজ্ঞান মনষ্ক মুক্তচিন্তার এমন চর্চাই তো হওয়া উচিত। আবার ধর্মসংক্রান্ত কোনো কোনো অভিব্যক্তি ও বক্তব্যের ধরন আমার কাছে তেমন ভালো লাগেনি। কোনো ধর্মকে গভীর থেকে বিশ্লেষণ করা খুব সহজ নয়। আমার অতি সামান্য পড়াশোনায় আমি অন্তত এটুকু বুঝতে পেরেছি কোনো নির্দিষ্ট ধর্মকে বিশদভাবে বুঝতে হলে শুধু সেই ধর্মই যে গভীরভাবে জানতে হবে তাই নয়, অন্য ধর্মমতকেও বিস্তারিতভাবে জানতে হবে অর্থাৎ তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন করতে হবে। সেই সাথে সভ্যতার ইতিহাসের ধারাক্রম উপলব্ধির মধ্যে আনতে হবে। কিন্তু আমি দেখেছি কোনো কোনো লেখায় ধারণা ও উপলব্ধিকে অনেক অস্পষ্টতা রেখেই গুরুতর মন্তব্য করে ফেলা হয়েছে। তাই বলে এই ভিন্নমতাবলম্বীর কলম আর কণ্ঠরোধ করার জন্য আমাকে অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। ব্লগার হত্যার জন্য যে তরুণ অস্ত্র হাতে খুনি হচ্ছে— আমি নিশ্চিত সে বা তারা ব্লগের সেই লেখাটি পড়েনি বা পড়লেও উপলব্ধি করতে পারেনি। নির্দেশদাতা তাদের যে নির্দেশ দিয়েছে তারা অন্ধ দৈত্যের মতো সে হুকুম পালন করেছে।
মত-দ্বিমতের অবকাশ মানুষের মধ্যেই থাকে। কারো লেখার বিরোধিতা করতে হয় পাল্টা লেখা দিয়ে। কেবল মূর্খ-দুর্বলরা বল প্রয়োগে মুখ বন্ধ রাখতে চায়। উনিশ শতকে হিন্দু সমাজকে আধুনিক শিক্ষা ও জ্ঞান চর্চার সাথে যুক্ত করার জন্য রাজা রামমোহন রায় সংস্কার আন্দোলন শুরু করেছিলেন। তিনি একপর্যায়ে সনাতন ধর্মচারীদের মূর্তি পূজা ছেড়ে এক নিরাকার ব্রহ্মার আরাধনার কথা বললেন। তাঁর কথা প্রচার করার জন্য তিনি বাংলা, ইংরেজি, ফার্সি ভাষায় পত্রিকা প্রকাশ করলেন। হিন্দু ধর্ম বিকৃত করার অপরাধে রামমোহনকে দোষী সাব্যস্ত করলেন রক্ষণশীল ব্রাহ্মণরা। তাই বলে তাঁরা রামমোহন রায়কে মারার জন্য জঙ্গি পাঠাননি। তাঁরাও পাল্টা পত্রিকা প্রকাশ করে রামমোহনের যুক্তির পাল্টা জবাব দিতে থাকলেন। তর্ক-বিতর্ক যা হলো তা কলমের ভাষায়। অস্ত্রের ভাষায় নয়।
আমাদের দেশের এই খুনি-জঙ্গিদের গুরু যারা তারা জানে প্রকাশ্যে ধর্মের যুক্তি দিয়ে লড়াই করার ক্ষমতা তাদের নেই। পবিত্র ইসলাম ধর্ম অমন খুনকে সমর্থন করে না। তাই তারা গোপনে মানুষ খুন করে পালিয়ে যায়। হাসপাতালে আহতদের রক্ত দেওয়ার জন্য মানুষ ছুটে যায় আর জঙ্গি তরুণরা পাপী গুরুদের আদেশ শুনে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে আরেকটি খুনের সুযোগ খুঁজতে থাকে।
তিন
আমি আবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ফিরে আসব। সরাসরি মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছেই জানতে চাই নাগরিক নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব এখন কে দেবে? ৩১ অক্টোবর বিকেল সাড়ে ৫টায় এনটিভি অনলাইন থেকে অনুরোধ করল শুদ্ধস্বর অফিসে হামলাকে সামনে রেখে একটি লেখা দেওয়ার জন্য। ৬টায় আমি সবে কম্পিউটারে বসেছি। তক্ষুণি আমার স্ত্রী টিভি রুম থেকে ছুটে এসে জানালেন এই মাত্র শাহবাগে আরেক জনকে গলা কেটে খুন করা হলো। আমি স্তম্ভিত হলাম। তাহলে কোথায় বাস করছি আমরা! বেশ কিছুদিন ধরে একের পর একটি খুনের ঘটনা ঘটছে। আর দম দেওয়া পুতুলের মতো পুলিশ প্রশাসন বলছে— এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আমরা আর ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ শব্দ শুনতে চাই না। এমন নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থেকে কোনো জাতির কি কোনো অগ্রগতি হতে পারে? এর জবাব রাষ্ট্রের বিধায়করাই দেবেন।
লেখক : অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।