প্রতিক্রিয়া
দেশীয় বনাম বিদেশীয় হত্যাকাণ্ড
(গতকাল রোববার এনটিভির ‘এই সময়’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে সাম্প্রতিক খুনখারাবি ও হামলা নিয়ে কথা বলেন অধ্যাপক আফসান চৌধুরী। এখানে সেই অনুষ্ঠান থেকে তাঁর প্রতিক্রিয়ার কিছু অংশ তুলে দেওয়া হলো।)
আমি মনে করি, আমাদের রাষ্ট্রগুলো খুব একটা দায়বদ্ধ রাষ্ট্র না। যতদিনই তারা ক্ষমতায় আছেন, তারা বলেছিলেন যে আমাদের দায়িত্ব আছে, আমরা সেই দায়িত্বগুলো পালন করব। আপনি যদি নিরাপত্তাজনিত ব্যবহারের দিকে তাকান তাহলে আপনি সেটা খুঁজে পাবেন না। এখন যে ঘটনাগুলো ঘটছে এটি ইতিহাসটা তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক, কিন্তু এর পটভূমি একাত্তর সাল থেকেই হয়েছে। সেই হিসেবে আজকে যে ঘটনাগুলো ঘটছে, আমার মনে হয় নিরাপত্তাহীনতার চেয়ে, সরকার যে কোনোদিনই তার জনগণকে নিরাপদ অবস্থায় রাখতে সক্ষম হয়নি সেটা প্রমাণ করে।
এই যে সন্ত্রাসবাদ তৈরি হয়ে গেছে, আপনি যদি দেখেন গত চারটি পাঁচটি ঘটনা কোনো অবস্থাতেই কোনো ভূমিকা পালন করা সম্ভব হচ্ছে না। আমি দক্ষিণ এশীয় সন্ত্রাসবাদের ওপর যতটুকু কাজ করেছি, তখন ভারতের, শ্রীলঙ্কার, বাংলাদেশের, পাকিস্তানের মানুষদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, এরা একটা কথা বলে যে, সন্ত্রাসবাদ খুব ভয়াবহভাবে এফিশিয়েন্ট করা যায়। এতে খরচ প্রায় কিছু হয় না। এবং বাংলাদেশের যে অবস্থা তাতে দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশকে চাপ না দিলে বাংলাদেশে কোনো ঘটনা ঘটে না। তো এখন বিদেশি যখন মারা গেছে, তখন সরকার চাপ বোধ করেছে, তাই সরকার তার সমস্ত বাহিনীকে চালু করে দিয়েছে। কিন্তু ব্লগাররা, ব্লগারের প্রকাশকরা, যে কথা তাঁরা বলতে চান, স্বাধীনতা আছে তাঁদের। তাঁরা যখন হত্যার শিকার হন সরকার কিন্তু নড়ে না। এবং সরকার কিন্তু ব্লগারদের ক্ষেত্রে নড়েনি। যে সংবাদটা সরকার হত্যাকারীদের পৌঁছে দিয়েছে যে, ঠিক আছে তুমি যদি কিছু করো আমার কিছু বলার নেই। এবং এটাই হয়ে গেছে সবচেয়ে সংকট। সরকার এটাকে রাজনীতিকরণ করেছে।
আমি মনে করি, সরকারের গত দু-তিন বছরের রাজনীতি এগুলো সব মিলেমিশে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যে আমরা স্বস্তিতে নেই। সরকার শুধু নয়। বিরোধী দলের কথা যদি বলি, বিরোধী দল যখন সন্ত্রাস করেছে, যখন বোমা মেরেছে- সাধারণ মানুষের কী হচ্ছে না হচ্ছে সেদিকে তাকায়নি। এখন যে ব্লগারের বিষয়টি চলছে, আমরা অনেকেই লিখেছি যে- খুনি কিন্তু খুনিই। কে আস্তিক আর কে নাস্তিক এটা বিষয় না। কিন্তু সরকার এখানে কোনো রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েছে বলে মনে হয় না। আমি মনে করি, বিদেশি হত্যা হওয়ার পর সারা ঢাকা শহরে তোলপাড় হয়ে গেল, এখানে যাওয়া যাবে না, ওখানে যাওয়া যাবে না। বিদেশিদের বিষয়ে সরকারের এত আগ্রহ কেন? নিশ্চয়ই ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপার রয়েছে।
আর বাংলাদেশের মানুষ যখন মরে যাচ্ছে, সেই বিষয়ে সরকার কিন্তু যথেষ্ট উদ্বিগ্নতা দেখায়নি। বিদেশি হত্যাকাণ্ডের পরে বলেছে এটা বিএনপি-জামায়াত করেছে। এবারে যিনি মারা গেছেন, তিনি তো সরকারি দলের লোক না। তিনি বোধহয় বাম দলের লোক। গত একটি অনুষ্ঠানে আমি দেখলাম কী তীব্রভাবে তাঁর বন্ধুবান্ধব তাকে আঘাত করেছে। রেগে গেছে, ক্ষুব্ধ। কিন্তু কেউ বলছে না যে এটা থামবে। কেউ বলছে না যে আমাদের নিরাপত্তাটা দেওয়া হবে। আমার মনে হয় সরকার ভাবছে, তার বিপদ শুধু যাঁরা চাপ দিতে পারেন তাঁদের কাছ থেকেই, বিদেশিদের কাছ থেকেই। দেশীয়রা সরকারের কাছে এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে না খুব গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক