লেখকদের প্রতিক্রিয়া
‘আমরা মর্মাহত’
এ বছরের শুরু থেকেই একের পর এক যেভাবে লেখক, ব্লগার ও প্রকাশকদের ওপর নৃশংস হামলা চালিয়ে তাঁদের খুন করা হচ্ছে তাতে ক্ষুব্ধ হচ্ছে সমাজের সকল স্তরের মানুষ। গত শনিবার জাগৃতি প্রকাশনের মালিক ফয়সল আরেফিন দীপনকে হত্যা, অন্যদিকে শুদ্ধস্বরের প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুলসহ তিনজনকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করা হয়। এ ঘটনার পর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন লেখক ও কবিদের অনেকে। তাঁদের প্রতিক্রিয়া দেওয়া হলো নিচে।
ড. আনিসুজ্জামান
ইমেরিটাস অধ্যাপক, লেখক ও গবেষক
ব্লগার হত্যাকাণ্ডের পর এক প্রকাশককে হত্যা এবং অন্যদের ওপর আক্রমণে আমরা মর্মাহত হয়েছি। যারা এসব করছে তারা বাংলাদেশের সকল মূল্যবোধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। আমরা হতাশ যে এদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত যথেষ্ট আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। আমি মনে করি, সচেতন নাগরিকদের পক্ষ থেকে সম্মিলিতভাবে এদের প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে হবে।
সেলিনা হোসেন
কথাসাহিত্যিক
দীপন ও টুটুল আমার প্রকাশক। একজন লেখক হিসেবে প্রকাশকদের যখন আক্রমণ ও নিহত করা হয়, তখন সেটা আমার শরীরেও লাগে। আমি মনে করি প্রকাশকদের বন্ধনটাই এমনই। আমি এই দুজন প্রিয় মানুষের ওপর আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করি। পাশাপাশি এটা মনে করি যেন বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমাদের গ্রাস না করে।
আলী রীয়াজ
লেখক ও গবেষক
মর্মাহত! বাকরুদ্ধ! কে কার কাছে কিসের প্রতিবাদ করবে? কে কার কাছে কিসের বিচার চাইবে? কে চিহ্নিত করবে আততায়ীকে? রক্তের এই স্রোত, মৃত্যুর এই ধারা দেশকে কোথায় নিয়ে যাবে? কতটা অন্ধকার নামলে আমরা বুঝব যে আলো নেই? কে জেগে আছে এই রাত্রির গুহায়? জীবনের এই অপচয়, এই অপঘাত, এই মৃত্যু, এই রক্তের স্রোত কি আমাদের প্রশ্ন করতে শেখাবে আমি কী ভূমিকা পালন করেছিলাম? আজ পথে দাঁড়াবার আগে আসুন নিজের বিবেকের সামনে দাঁড়াই সবাই, আজ উচ্চকণ্ঠে ক্ষোভের আগে নিজেকে প্রশ্ন করি এই মৃত্যুর দায় আমারও কি না- প্রশ্ন করুন, আসুন আমরা সবাই প্রশ্ন করি।
আকিমুন রহমান
কথাসাহিত্যিক
খুব স্পষ্ট করে বুঝে উঠছি যে, আমাদের মাতৃভূমি বেদখল হয়ে গেছে। আমরা প্রতিজন ঘেরাও হয়ে আছি উদ্যত চাপাতি দিয়ে! কোপ নেমে আসাটা এখন কেবল সময়ের ব্যাপার।
জাকির তালুকদার
কথাসাহিত্যিক
আগের হত্যাকাণ্ডের খুনিরা ধরা পড়লে, তাদের বিচার হলে, শাস্তি নিশ্চিত হলে, কিছুটা নিরাপত্তা ফিরে আসত লেখক-প্রকাশকদের জীবনে। কিন্তু সরকার এ পর্যন্ত যা করেছেন, তা পর্যাপ্ত তো নয়ই, বরং মনে হচ্ছে সরকার এ ব্যাপারে দায়সাড়া গোছের নিষ্ক্রিয়। যদি খুনিরাই নির্ধারণ করতে থাকে লেখক-প্রকাশক-সংগঠকরা কে কতদিন বাঁচবেন, তাহলে জামায়াত-মৌলবাদ অধ্যুষিত সরকারের সঙ্গে এই সরকারের তো কোনো পার্থক্য থাকে না।
আহমাদ মোস্তফা কামাল
কথাসাহিত্যিক
একের পর এক হত্যাকাণ্ড চলছে, অথচ সরকার নির্বিকার। তাদের নীরবতা এবং নিষ্ক্রিয়তার আরেক মানে এই জঙ্গিদের লাই দিয়ে মাথায় তোলা। এর দায় সরকার এড়াতে পারে না। অধিকাংশ ব্লগার-লেখক-বুদ্ধিজীবীরাও সরকারের ভূমিকা নিয়ে নীরব-নির্বিকার। এই একই ঘটনা যদি অন্য কোনো সরকারের আমলে ঘটত, আপনারা চুপ থাকতেন প্রিয় ব্লগার-বুদ্ধিজীবীরা? সরকারকে অ্যাকশনে যেতে বাধ্য করতেন না? নিজেকে প্রশ্ন করুন, দেখুন কী উত্তর পান। তাহলে এখন মিনমিন করছেন কেন? আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে সব জায়েজ হয়ে যায়? কথা বললে চেতনা ধ্বংস হয়ে যায়? আপনাদের লজ্জা করে না? যদি বিবেক-আত্মা ইত্যাদি বলে বিন্দুমাত্র কিছু অবশিষ্ট থাকে আপনার ভেতরে, তাহলে সুস্পষ্টভাবে সরকারের কাছে দাবি তুলুন, সরকারকে অ্যাকশনে যেতে বাধ্য করুন। সরকার সেটি না করলে তাদেরকেই এসব ঘটনার জন্য দায়ী করুন।
আমি সুস্পষ্টভাবে সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, অবিলম্বে অ্যাকশনে যেতে হবে আপনাদের। জঙ্গিবাদকে সমূলে উৎপাটন করতে হবে। নইলে আপনাদের আমরা ক্ষমা করব না।
চঞ্চল আশরাফ
কবি
বাংলাদেশে যে ঘটনাগুলো ধারাবাহিকভাবে চলছে, তাতে আসলে কেউ কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত বা ধারণায় পৌঁছাতে পারছে না। পৌঁছাতে না পারার কারণ এবং পার্শ্বকারণ আছে : আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরিস্থিতি মিলিয়ে একরকম ধারণা কাজ করছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়েও একধরনের ধারণা কাজ করছে। আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে নানামুখী ধারণার ফাঁদের মধ্যে পড়ে গেছি আমরা, সমাধান নিয়ে জাতীয় সংলাপ, বড় ধরনের মতবিনিময় করার চেষ্টা কোনো মহল থেকেই দেখা যাচ্ছে না। এটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থা। একের পর এক হত্যা ঘটছে, আমরা রাস্তায় নামছি, আবার দিন চলে যাচ্ছে, সব ভুলে যাচ্ছি। রাষ্ট্রের অক্ষমতা নিয়ে কথা হচ্ছে। ১৪ ডিসেম্বরের চেয়ে খুব ভালো পরিস্থিতি যে বিরাজ করছে না, সেটা এখন সবাই বুঝতে পারছে। লেখক বুদ্ধিজীবীদের টার্গেট করে মারা হচ্ছে। এর অবসান হতে হবে।
ফারুক ওয়াসিফ
কবি
গ্রিক রাজা ইদিপাস নিজের মায়ের সঙ্গে সঙ্গম করার অনুতাপে নিজের দুই চোখ অন্ধ করেছিলেন বলে নাটকে বর্ণিত আছে। যা দেখার কথা নয়, যা ভোগ করা অনুচিত তা-ই ভোগ করে যাচ্ছেন এ দেশের ওপর তলার লেখক-সাংবাদিক সেলিব্রিটিরা। অনুতাপহীন এসব লোকেরা পুরস্কার ও কৃপা ত্যাগ করতে পারবেন না বলে এই বধিরেরা নিজেদের জবান ও বিবেককেই বোবা ও অন্ধ করে দিয়ে আরামে আছেন। এঁদের সমর্থন ছাড়া, মিথ্যাচার ও ধূর্তামি ছাড়া দেশের এই অবস্থা বানাতে পারত না শাসকরা। তারা টাকা আর দূতাবাস দ্বারা চালিত। যে দুয়েকজন এখন কিছু কথা বলছেন, তাদের অবশ্যই অতীতের কৃতকর্মের ও বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। নইলে তাদের বিশ্বাস করে আবার ঠকতে হবে।’
দেশে জান ও জবানের স্বাধীনতা নাই। রাষ্ট্র নাগরিকের জীবন এবং জাতীয় সম্পদ ও স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছে। জনমানুষের গণতন্ত্র ছাড়া, নাগরিকের সকল অধিকার ফিরিয়ে আনার সংগ্রাম ছাড়া জীবনের অধিকার ফিরে আসবে না এই দেশে। বিচার নেই বলে দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক কোনো বিচার চান না। এই কথাটা রাষ্ট্র ও রাজনীতির আসল চেহারাটা দেখায়। এরপর তিনি বলেছেন, ‘আমরা শূন্যের মধ্যে ভালো কিছু খুঁজছি। এটা পাওয়া সম্ভব না। আগে এটা আদর্শগত ও রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে।’
এই সমাধান তাদের দিয়ে হবে না যারা সমস্যাটা তৈরি করেছে। এই রাজনীতি, তাদের উমেদার বুদ্ধিজীবী এবং সুবিধাখোরদের প্রগতি, জাতীয়তাবাদ, ইসলাম প্রগতিও না জাতীয়তাবাদও না ইসলামও না। বিষকে আর ওষুধ ভাববেন না। যে জাগরণ আর যে বাম ক্ষমতাগোষ্ঠীর লেজুড়, এদের মতো ও পথ দেশটার ধীরমৃত্যুকে বেগবান করছে। শাসক নেতা ও মন্ত্রীরা কবর খুঁড়ছেন। অধ্যাপক আহমেদ কামালের ভাষায় সেই কবরে যে লাশ তা দেশ ও জনগণের।
সাখাওয়াত টিপু
কবি
আমরা তোমাকে ভালোবাসি প্রিয় বাংলাদেশ। আমাদের নির্ভয়ে বাঁচতে দাও। আমাদের স্বাভাবিক জীবন দাও। আমাদের উদ্বেগহীন সমাজ দাও। আমাদের স্বাভাবিকভাবে মরতে দাও। প্রিয় দেশ আমার, তোমার রক্তাক্ত মুখ দেখতে চাই না আর।
স্বকৃত নোমান
লেখক
শুদ্ধস্বর কার্যালয়ে আহমেদুর রশীদসহ যে দুজনের ওপর হামলা হলো এবং জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যাকাণ্ড একই সূত্রে গাঁথা। এভাবে চলতে পারে না, চলতে দেওয়া যায় না। একাত্তরে যেভাবে বুদ্ধিজীবীদের ধরে ধরে হত্যা করা হয়েছিল, স্বাধীনতার এত বছর পর ঠিক একই কায়দায় এখন আবার বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হচ্ছে। অথচ দেশে এখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায়। সরকার একজন অপরাধীকেও গ্রেপ্তার করতে পারছে না। আর কতজন লেখক-প্রকাশক নিহত হলে সরকারের বোধধয় হবে? এর প্রতিকারে লেখকদেরই রাস্তায় নামতে হবে।