প্রতিক্রিয়া
কেউ খুন হয়ে গেলে আর অবাক হই না
আজিজ সুপার মার্কেটে নিজের কার্যালয়ে বীভৎস খুনের শিকার হলেন জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক ফয়সল আরেফিন দীপন। নির্মম-পৈশাচিকতার ধারাবাহিকতার নতুন বলি। এবার সঙ্গে যুক্ত হলো ‘কার্যালয়’ এবং ‘পিস্তলের গুলি’ নামের দুটি ভীতিজাগানিয়া নতুন উপসর্গও।
এসব ঘটনায় ব্যক্তিগতভাবে আমি যারপরনাই শোকাহত, মর্মাহত। তবে অবাক হইনি। কারণ, বিভিন্ন সরকারের আমলেই দেখেছি, একটি খুনের ঘটনা ঘটে গেলে সঙ্গে সঙ্গেই সরকারি তরফে বলে দেওয়া হয় অমুক দল বা সংগঠনের লোকেরা খুনের সঙ্গে জড়িত। তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই এমন আরো নানা অসংলগ্ন বক্তব্য-ঝড় চলতে থাকে কিছুদিন। আর এসব বক্তব্যের পর ঘটনার তদন্তকারী কর্মকর্তারাও বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। তাঁরা না পারেন কিছু বলতে না পারেন সইতে। ফলে খুনিরা এই ফাঁকে আরো উৎসাহী হয়ে ওঠে। এভাবে যে রাষ্ট্র খুনিদের উৎসাহ জোগায়, সে রাষ্ট্রে তখন খুনোখুনি স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। রাষ্ট্রযন্ত্রও তখন তার স্বাভাবিকতা হারায়। হয়তো এতে রাষ্ট্রপরিচালকদের লাভের লাভ কিছু হয়। না হলে তাঁরা তদন্তাধীন বিষয়ে আগবাড়িয়ে এমন মন্তব্য করতে যাবেন কেন। সবচেয়ে কটু যে বিষয়টা তখন প্রকট হয়ে দেখা দেয়, তা হলো এক শ্রেণির পেইড বুদ্ধিজীবী তখন দৃশ্যপটে হাজির হন। যেমনটা আমরা দেখি বিভিন্ন আমলে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন কিংবা রাতভর টিভি টকশোগুলোর ঝলমলে মঞ্চ বা ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়াতেও।
সময়টা বড্ড খারাপ। সমাজে আজ স্ব স্ব ক্ষেত্রে ‘যোগ্য মানুষজন’ অভিমানে আড়ালে চলে যাচ্ছেন। প্রকৃত নেতা মনোনয়নই পাচ্ছেন না, ভোট তো পরের কথা। তাঁর জায়গায় ভেজালরা ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে যাচ্ছে। মেধাবী সাংবাদিককে দেওয়া হচ্ছে কাঁচাবাজারের রিপোর্ট তৈরি করতে, আর অযোগ্য-অথর্বকে দেওয়া হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ অ্যাসাইনমেন্ট। টিভি খুললেই দেখি এই চিত্র। একজন অযোগ্য রিপোর্টার কাভার করছেন গুরুত্বপূর্ণ চার-পাঁচটি ইভেন্ট। মেধাবী রিপোর্টার করছেন ডিমের দাম বাড়ল কি কমল, তার রিপোর্ট। সকল পেশার সকল ক্ষেত্রেই এই চিত্র বর্তমান। রাজনীতির ক্ষেত্রে আর গেলাম না। যদিও মিডিয়া এবং বিরোধী রাজনৈতিক দল দেশ পরিচালনায় সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করে সহযোগিতা করে। আমি নিজে এই মিডিয়া পেশার বলেই এ প্রসঙ্গতেই আমার আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখলাম। বিরোধী দল বলে যে দলটি এই সেদিনও ছিল, সে দলটি এখন তার যোগ্যতা হারিয়েছে। এদিকে মিডিয়াও তোষামোদকারীদের দখলে। সে হিসেবে সরকারের সমালোচনা করার মতো একমাত্র মাঠে আছেন সোশ্যাল মিডিয়ার কিছু শুভবুদ্ধির অ্যাক্টিভিস্টরা। এবং তাঁরাও আজ ব্যাকফুটে চলে যাচ্ছেন রহস্যময় চাপাতির কোপে।
এই সমাজে প্রকৃত বুদ্ধিজীবীদের মৃত্যু ঘটেছে আগেই। যাঁদের এই পেখম লাগিয়ে দাপিয়ে বেড়াতে দেখা যায়, তাঁরা আসলে তথাকথিত বুদ্ধিজীবী (খুবই দুঃখিত, অনেকে এভাবেই তাঁদের সম্বোধন করেন)। এদের দাপট এমনই যে, রাষ্ট্রের বিবেক হিসেবে পরিচিত জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য পদ পেতেও সাংবাদিক হতে হয় না এখন। হোটেল বয়, বায়রা কর্মচারী, বাসশ্রমিক, আনসারের চাকরিচ্যুত সদস্য ও ব্যবস্থাপনা কমিটির কর্মকর্তাদের বউ ছেলেমেয়ে ও তাঁদের মেয়ের জামাই, ছেলের বউরা অনায়াসেই বুদ্ধিজীবীদের ঐতিহ্যবাহী এ সংগঠনে সদস্যপদ নিয়ে ঢুকে যান। এবং তাঁরাই সমাজ, রাষ্ট্রপরিচালনাকারীদের সমূহ নীতি-উপদেশ দিয়ে সহযোগিতা করেন। ফলে রাষ্ট্রপরিচালকরা জানতে পারেন না সমাজের বা রাষ্ট্রদেহের কোন অঙ্গে কোন অসুখে ধরেছে, কোথায় জঙ্গি নামের ক্যানসার বাসা বেঁধেছে। কী চিকিৎসা তাকে দিতে হবে।
অসুখে আক্রান্ত একটি সমাজ বা রাষ্ট্রে প্রকৃত বুদ্ধিজীবীদের সহযোগিতা ব্যতিরেকে এমন মারাত্মক ব্যাধিসংকট কাটিয়ে ওঠা কঠিন। সমস্যার সমাধান করতে হলে তার কারণ নির্ণয় করা জরুরি। আর সেই কারণ নির্ণয় করতে হলে প্রকৃত বুদ্ধিজীবী যাঁরা আছেন, তাঁদের পরামর্শ নিতে হবে। না হলে শুধু উপসর্গের চিকিৎসা করা হলে সংকটের সাময়িক সমাধান হয়তো হবে; কিন্তু স্থায়ী সমাধান হবে না। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীরা তখন জনমত গঠন, যুদ্ধের কৌশল তৈরি, মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করা এবং নেতৃবৃন্দকে নানা পরামর্শ দিয়ে জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন। যার ফলে স্বাধীনতা অর্জন খুব দ্রুততায় সম্ভব হয়েছিল। আর হানাদাররা এটা বুঝতে পেরে স্বাধীনতালাভের আগমুহূর্তে বুদ্ধিজীবী নিধনে মেতেছিল।
আজকে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের দাপটে প্রকৃত বুদ্ধিজীবীরা যখন পেছনের বেঞ্চে চলে যান, বা কেউ দৃশ্যপট থেকে অভিমানে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন, তখন সামনে আর আলো দেখানোর কেউ থাকে না। এ অবস্থায় দীপন বা অন্য কেউ খুন হয়ে গেলে আমি শুধু মর্মাহতই হই, অবাক হই না।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন ।