খুনখারাবি
গডফাদারদের কেন বিচার হবে না?
১.
খুলনার এরশাদ শিকদারকে ২০০৪ সালের ১০ মে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যাঁরা এরশাদ শিকদারকে তৈরি করেছিলেন, তাঁদের খুঁজে বের করা হয়নি। এরশাদ শিকদার বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন জাতীয় পার্টি, বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে ধারাবাহিক খুনগুলো করেছিলেন। মাদক ব্যবসা করে সম্পদের পাহাড় গড়েছিলেন।
রাষ্ট্র তখন সেই ঘটনার নেপথ্য খলনায়কদের খুঁজে বের করেনি। ক্ষয়ে যাওয়া সমাজের কারণ শনাক্ত করেনি। ছয় বিয়ে করা এই শিকদারের স্বর্ণকমলে ৭০টিরও বেশি আগ্নেয়াস্ত্র কীভাবে থাকে, সমাজ সেটির ব্যাখ্যা পায়নি। একজন ছিঁচকে রাঙা চোর কীভাবে শতকোটি টাকার ভয়ংকর মাদকসম্রাটে পরিণত হয়, সমাজ তার সদুত্তর পায়নি। ফলে এক মাদকসম্রাট এরশাদ শিকদার গেছে, হাজারো এরশাদ শিকদার জন্ম নিয়েছে সমাজে।
২.
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে ফেরত দিয়েছে ভারত। বৃহস্পতিবার রাতে তাঁকে হস্তান্তর করেছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। এককালের বাসের হেলপার থেকে কোটিপতি বনে যাওয়া নারায়ণগঞ্জের এই ‘এরশাদ শিকদার’কে বিচারের মুখোমুখি করা হবে-এটা নিশ্চিত। এই নূর হোসেন একাই নারায়ণগঞ্জে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে পারেননি। সেক্যুলার আওয়ামী লীগ, জাতীয়তাবাদী বিএনপি কিংবা স্বৈরাচারী এরশাদের রাজনৈতিক দলের নেতারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন। কে বা কারা তাঁকে ব্যবহার করেছেন, সেটিও এখন খুঁজে বের করতে হবে। নূর হোসেন মূল রোগ নন; তিনি উপসর্গ মাত্র।
আমরা চাই এখানেও যাতে রোগ রেখে উপসর্গের চিকিৎসা দেওয়া না হয়।
৩.
ঐশীর ফাঁসির রায় হয়েছে। ইয়াবায় আসক্ত নাবালিকা ঐশীর উচ্ছৃঙ্খলতাকে বাধা দেওয়ার কারণে তারই পরিকল্পনায় রোমহর্ষক ও মর্মান্তিকভাবে খুনের শিকার হন বাবা পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান (৪৮) ও গর্ভধারিণী মা স্বপ্না রহমান (৪২)। মাদকের নীল ছোবল একটি সাজানো গোছানো সংসারকে কীভাবে মুহূর্তেই নিশ্চিহ্ন করে দেয়, ঐশীদের সংসারটি তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আমি ঠিক জানি না, ঐশীর প্রয়াত বাবা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে সমাজে মাদকের বিস্তার ঠেকানোর ব্যাপারে কতটা তৎপর ছিলেন। তবে এটা তো বলাই যায়, সার্বিকভাবে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা ছিল বা এখনো আছে। নইলে রাজধানী থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লায় কীভাবে ইয়াবাসহ ভয়ংকর মাদকগুলোর স্রোত সুনামির মতো আছড়ে পড়ে? শুধু রাষ্ট্র বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই নয়, প্রত্যেক নাগরিককেই বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বিধ্বংসকারী মাদকের এই বিস্তার ঠেকাতে সোচ্চার হতে হবে। গডফাদারদের বিরুদ্ধে স্লোগান তুলতে হবে। এটা নিজেদের স্বার্থেই করতে হবে। এই দেশকে নবজাতকের বাসযোগ্য করে যেতে হলে-এ স্লোগান তোলা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। আর যদি এটা না করতে পারি, তবে তা হবে আমাদের আজন্ম পাপ। যে পাপ কাল থেকে কালান্তরে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের অভিশাপের ছোবলে জর্জরিত করতে থাকবে।
ঐশী কীভাবে ইয়াবা হাতে পেল? কীভাবে সহজলভ্য হলো এই ইয়ুথ কিলিং মেশিন? কারা আনে এই মাদকপণ্য? শুধু ক্রেতার কেন বিচার হবে? বিক্রেতা গডফাদারদের কেন বিচার হবে না?
দৃশ্যগুলো তো এমনও হতে পারত
চলুন একবার টাইম মেশিনে চড়ে সুন্দর নিষ্পাপ সেই অতীতে ফিরে যাই। মনে করি, বর্তমানে যে দুর্বিষহ ঘটনাগুলো ঘটে চলেছে, তা আসলে কখনো ঘটেইনি। আমরা দুঃস্বপ্ন দেখেছি মাত্র। যে দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠে দেখব, আমরা সুন্দর সেই অতীতেই আছি।
* দেখতে পাব সিরিয়াল কিলার এরশাদ শিকদার নন; একজন পরিশ্রমী রাঙ্গা মিয়া দিনভর পরিশ্রম করছেন। এভাবে একদিন তিনি একটি চিংড়িঘেরের মালিক হয়েছেন। কোটি টাকার স্বর্ণকমল নয়, একটি টিনশেড দালানে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখের সংসার পেতেছেন। কোনো রাজনৈতিক দলের গডফাদারদের প্রলোভনের ফাঁদে তিনি পা বাড়াননি।
*নূর হোসেন বাসের হেলপারি করে নিজেই একটি বাসের মালিক হয়েছেন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে তাঁর গোছানো ছিমছাম সংসার। মানুষ হত্যা তো দূরের কথা, সুন্দরবনের হরিণ শিকারের বিরুদ্ধে গঠন করা নারায়ণগঞ্জ কমিটির সভাপতি হয়ে তিনি রাত-দিন প্রচার চালাচ্ছেন।
*সুন্দর স্নিগ্ধ আলোয় রাঙা একটি ভোরে ঐশী তার মা-বাবাকে ডেকে বলছে, ‘আর কত ঘুমাবে তোমরা? টেবিলে নাশতা সাজিয়ে রেখেছি। আজকের নাশতাটা চেখে দেখো, একদম ডিফরেন্ট হয়েছে। পত্রিকার রেসিপি দেখে দেখে এই প্রথম আমি নাশতা বানালাম।’ ঐশীর মা-বাবা সন্তানের এমন কীর্তি দেখে তখন আনন্দাশ্রুতে চোখ ভেজাবেন। দেখাদেখি ঐশীর চোখও ভিজে উঠবে।
আমরা আর কষ্টের অশ্রু দেখতে চাই না। ঐশীদের চোখে তার বাবা-মায়ের নাশতার টেবিলের দৃশ্যের মতো আনন্দাশ্রু দেখতে চাই।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।