বিশ্লেষণ
৯/১১ থেকে প্যারিস, বিপন্ন বিশ্ব
জিন-ভূত কিংবা অতৃপ্ত আত্মারা নয়, বরং মানুষই পারে মানুষের জন্য নরকতুল্য অশুভের সৃষ্টি করতে। সেটা আরো একবার প্রমাণ করেছে মানুষ। প্যারিসের ওপর ওই রকম হামলা কোনো মানুষের কাজ নয়। ইসলাম এত নির্বোধ আর রক্তখেকো ধর্ম নয় যে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে মানুষের রক্ত ঝরিয়ে তার মূল্য রক্ষা করতে হবে। আজ থেকে হাজার বছর আগে সেই চেষ্টাকে ইসলাম নিজেই হারাম বা নিষিদ্ধ করেছে। কারণ, জীবনই যদি না থাকে তো কার অন্তরে ঠাঁই নেবে ধর্ম? সমস্যাটা ধর্মের নয়; বরং ধর্মের ওপর ভর করেছেন যেসব ড. জিভাগো, সমস্যাটা তাদের। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে তাদের তৈরি করা ফ্রাঙ্কেনস্টাইনরাই আজ দুনিয়ার একমাত্র অশুভ শক্তি। সিরিয়া থেকে ইরাক কিংবা লিবিয়া থেকে লেবানন; প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে বিশ্বের জনপদ থেকে জনপদে আজ জীবনবিনাশী সেসব অশুভ ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দাপট। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নাইন/ইলেভেন ট্র্যাজেডি পাল্টে দিয়েছিল বিশ্ব ইতিহাসের মোড়। ১৫ বছর পর বোধ করি আরো একবার একই রকম বিপন্ন আঁধারের মুখোমুখি বিশ্ব আর কথিত এই সভ্য-সভ্যতা।
আইএস জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ। আইন অনুযায়ী সদস্য যেকোনো দেশের যুদ্ধে আপনাআপনি জড়িয়ে পড়বে ন্যাটোভুক্ত সব বন্ধুরাষ্ট্র। তাই ফরাসি প্রেসিডেন্টের যুদ্ধ ঘোষণা মানে লড়াইটা ন্যাটোরও। আসল লড়াই শুরুর আগেই লড়াইয়ের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে শুরু করেছে মিডিয়া। ঠিক ইরাক যুদ্ধের আগে যা করেছিল পশ্চিমা গণমাধ্যম; মার্কিন টিভি চ্যানেল সিএনএনে আবারো সেই ইঙ্গিত। ইরাক যুদ্ধের পর মার্কিন টিভি চ্যানেল সিএনএনকে এমন সর্বশক্তি নিয়ে আর সংবাদের রণাঙ্গনে নামতে দেখা যায়নি। সিএনএনের স্টুডিও এখন প্যারিসের উন্মুক্ত রাজপথ। ওবামা তো বটেই, যুক্তরাষ্ট্রের পুরো রাজনৈতিক অঙ্গন এখন প্যারিস ট্র্যাজেডির ভয় থেকে বাণিজ্য কুড়িয়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে।
এমন একসময় প্যারিসে আইএস জঙ্গিদের হামলা, যখন জঙ্গিবিরোধী লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মান বাঁচানোটাকেই রীতিমতো দায় করে তুলেছিলেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। ৩০ সেপ্টেম্বর সিরিয়ার লাতাকিয়া ঘাঁটি থেকে রুশ জঙ্গিবিমানের হামলা শুরুর পর থেকে প্রায় প্রতিদিন নিত্যনতুন বিজয়ের মুখোমুখি হচ্ছিল আসাদ অনুগত সেনারা। যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন প্রায় ৭০ দেশের জোট গত দুই বছরের কথিত সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে যেই আইএস জঙ্গিদের কেশাগ্রও ছুঁতে পারছিল না; রাশিয়ার মাত্র ৩০ দিনের হামলায় জঙ্গিরা তাদের সব কেশ বিসর্জন (চুল-দাড়ি কেটে) দিয়ে রণাঙ্গন ছেড়ে পালাতে শুরু করেছিলেন। প্যারিসের এই হামলা এমন সময়, যখন আলেপ্পোর গুরুত্বপূর্ণ অনেকটা এলাকা সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর দখলে। জঙ্গিদের দখলে থাকা পালমিরায় চলছিল জোরদার অভিযান। বিশ্লেষকরাও বলছিলেন, আলেপ্পো আর পালমিরাকে আইএসমুক্ত করা মানে জঙ্গিদের দিন ফুরানো সময় মাত্র। সিরিয়ার প্রতিদিনের রণাঙ্গনের গতিপ্রকৃতিও বলে দিচ্ছিল, খুব দ্রুত রণাঙ্গন গুটিয়ে আনতে চাইছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। কারণ, তাঁর আসল উদ্দেশ্য সিরিয়ার রাজনৈতিক সমাধান। রণাঙ্গনে লড়াই জারি রেখে সেটা সম্ভব নয়। এমনকি আসাদকে ক্ষমতায় রেখেই বিদ্রোহী জোট ফ্রি সিরিয়ান আর্মি আলোচনায় রাজি, এমন ইঙ্গিতও মিলছিল।
সিরিয়ার রণাঙ্গনে যখন এমন চিত্র, তখন পুতিনের নামে স্লোগান দিয়ে রুশ বিমান হামলার দাবি জানিয়ে ইয়েমেনে-ইরাকে মিছিল করেছে হাজারও মানুষ। কারণ, এই মানুষগুলো জানে, ষড়যন্ত্রের ইঙ্গ-মার্কিন যুদ্ধে গত এক যুগে তাঁরা কী হারাচ্ছেন। তাঁরা জানেন, আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নাম করে যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপ তাঁদের সঙ্গে বঞ্চনা আর প্রতারণার কত না উদাহরণ সৃষ্টি করে চলেছে। সেই মানুষগুলো যখন দেখে, পশ্চিমা বিমান থেকে সভ্যতাবিরোধী আইএস জঙ্গিদের জন্য নামে যুদ্ধের রসদ আর রাশিয়ার বিমান থেকে নামে বোমা; তখন পুতিন তাদের জননায়কে পরিণত হবেন, সেটাই স্বাভাবিক। আইএসমুক্ত মধ্যপ্রাচ্যের বিনিময়ে পুতিন কী চান; সেই হিসাব আমলে নিয়েই রাশিয়াকে স্বাগত জানিয়েছিল মধ্যপ্রাচ্য। কারণ তারা প্রতারক সাম্রাজ্যবাদীর চেয়ে বরং অপেক্ষাকৃত একটি সৎ সাম্রাজ্যবাদের অপেক্ষায় ছিলেন। আর সেই সফলতার পেছনেই হাঁটছিলেন পুতিন। ঠিক তখনই প্যারিসে হামলা। এই হামলা নিঃসন্দেহে নাটকীয়ভাবে পাল্টে দিল ইরাক-সিরিয়ার আইএসবিরোধী লড়াইয়ে ছক। বোঝাই যাচ্ছে, আইএসবিরোধী লড়াই এবং সিরিয়ার রাজনৈতিক সমাধানে পুতিনের তৈরি করা সম্ভাব্য সমাধানের পথে বিশাল বাধা হয়ে দাঁড়াতে যাচ্ছে ন্যাটো। এবার ন্যাটোর ঘাড়ে বন্দুক রেখে সিরিয়ার দাবার ছকে নতুন রূপে হাজির হওয়ার অপেক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র।
পুতিনও কি তাহলে ন্যাটোর কাঁধে কাঁধ মেলাবেন? তাহলে আসাদকে ক্ষমতায় রেখে সিরিয়া সমস্যা সমাধানের যে রুশ পরিকল্পনা তার কী হবে? ইরান আর হেজবুল্লাহ গেরিলারাই বা কোন পক্ষ বেছে নেবে? সব মিলে এক নতুন গোলকধাঁধার মুখোমুখি সিরিয়ার রণাঙ্গন। আর এই গোলকধাঁধা যে আগামী দিনগুলোতে বহুমাত্রিক সমস্যার জন্ম দেবে, সেটা বলা বাহুল্য। রাশিয়ার হাতেই হোক কিংবা ন্যাটোর হাতে, ইরাক-সিরিয়ায় আইএস জঙ্গিদের স্বপ্নের খেলাফত হয়তো তছনছ হবে; কিন্তু তার পর? কার বিরুদ্ধে লড়বে যুক্তরাষ্ট্র? আসছে নির্বাচনে কার ভয় দেখিয়ে ভোটের মাঠ গরম করবেন মার্কিন নেতারা ? নাকি আরো কোনো নতুন ভয় তথা ফ্রাঙ্কেনস্টাইনরা পর্দার অন্তরালে প্রস্তুত?
আইএসে যোগ দেওয়া ব্রিটিশ তরুণী আকসা মাহমুদ প্রতিদিন সিরিয়ার রাক্কা থেকে টুইটারে ডায়েরি লিখতেন, যা আইএসের ডায়েরি নামে পরিচিতি পেয়েছিল। একদিনের টুইটারে আকসা লিখেছেন, ‘যদি তুমি জিহাদের রণভূমিতে যোগ দিতে না পারো, তাহলে রণাঙ্গনকেই তোমার নিজের কাছে নিয়ে যাও।’ অর্থাৎ ‘তুমি যদি গ্লাসগোতে থাকো, তাহলে সেই গ্লাসগোকেই রণাঙ্গন বানাও।’ আকসার এই আত্মকথনকে রীতিমতো classic case of conversion to extremism বলে আখ্যায়িত করেছিলেন পশ্চিমা দুনিয়ার সমাজতাত্ত্বিকরা। আকসার কথামতো ইরাক-সিরিয়ার আইএস নামের ফ্রাঙ্কেনস্টাইনরা কি তাহলে দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে ঘরে ঘরে হানা দেবে?
যে নাইন/ইলেভেনকে আশ্রয় করে পরবর্তী পুরো এক দশকে আফগানিস্তান-ইরাকে মার্কিন দখলদারিত্ব আর অস্ত্রের রমরমা বাণিজ্য; সে ঘটনায় ওয়াশিংটনের সৌদি দূতাবাস এবং তখনকার সৌদি রাষ্ট্রদূত প্রিন্স বানদারের রহস্যময় সংশ্লিষ্টতা ছিল। যা কি না নাইন/ইলেভেনের তদন্তে গঠিত কংগ্রেসের তদন্ত রিপোর্টেও উল্লেখ ছিল। বলে রাখি, সেই রিপোর্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ২৮টি পৃষ্ঠা (যে পৃষ্ঠাগুলোতে সৌদি মদদের কথা উল্লেখ আছে) তা আজো প্রকাশ করেনি যুক্তরাষ্ট্র। গোপন রাখা হয়েছে। কারণ, সেটা প্রকাশ হলে নাইন-ইলেভেন, সন্ত্রাসী আল-কায়েদা, সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ সব মিথ্যা হয়ে যায়। ইতিহাস নতুন করে লিখতে হয়। সেই দায় বয়ে নেওয়ার সৎ সাহস যুক্তরাষ্ট্রের নেই।
রম্য ম্যাগাজিন শার্লি এবদোতে হামলা থেকে শুরু করে প্যারিস ট্র্যাজেডি পর্যন্ত সময়কালে ইসরায়েলি দূতাবাস ও গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের মুভমেন্ট কী ছিল, তা নিয়ে সম্ভবত প্রশ্ন তোলার সময় এসে গেছে। কারণ, নানা ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব সেদিকেই ইঙ্গিত করছে। আর কে না জানে, মধ্যপ্রাচ্যে আইএস জঙ্গিদের অন্য বন্ধুটির নাম ইসরায়েল। প্যারিস ট্র্যাজেডিও নাইন/ইলেভেনের মতোই নিখুঁত। পরিকল্পনা থেকে শুরু করে হামলা পর্যন্ত প্রতিটি পদক্ষেপ সুপরিকল্পিত অব্যর্থ। মার্কিন বা ইসরায়েলি কমান্ডোরা যেভাবে কমান্ডো অভিযান চালায়, ঠিক সেই রকম। ২০-২২ বছরের তরুণরা কোথায় এমন প্রশিক্ষণ পেল? প্যারিসের মতো শহরে, ইউরোপের প্রাণকেন্দ্রে এত নিরাপত্তা এত সার্ভিল্যান্সের মধ্যে কীভাবে তারা নিজেদের উড়িয়ে মতো বিস্ফোরক জোগাড় করল? কালাশনিকভের মতো ভারী অস্ত্রই বা কীভাবে তাদের হাতে এলো? শোনা যায়, বেলজিয়ামে পুলিশের অভিযানে রীতিমতো রকেট লাঞ্চারও উদ্ধার হয়েছে। কীভাবে সম্ভব ?
নাইন/ইলেভেনে হামলার ঘটনায়ও জীবিত অনেককে আটক করা হয়েছিল। গুয়ানতানামো কারাগারে তাদের আটক রাখার এক যুগেও জানা যায়নি, তাদের কাছ থেকে কী জানা গেছে। এই কিছুদিন আগেও গুয়ানতানামো কারাগারে বিনা বিচারে ১৪ বছর কয়েদ থাকার পর একজনকে মুক্তি দিয়ে ওমানে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। প্যারিসে হামলার অন্যতম সন্দেহভাজন ২৬ বছর বয়সী আবদেসলামকেও খুঁজছে পুলিশ। কিন্তু প্যারিসে রহস্যময় হামলার পর তৈরি হওয়া এই প্রশ্নগুলোর জবাব কি মিলবে? ধরে নেওয়া যায়, ততটাই উত্তর প্রকাশ করা হবে যতটা কথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের মসলার জোগান দেবে; আর যতটা বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টির কাজে লাগবে।
লেখক : জ্যেষ্ঠ বার্তা সম্পাদক, একাত্তর টিভি।