মানবতাবিরোধীর ফাঁসি
ইতিহাসের দায় মোচন
সব কটা জানালা খুলে দাও না/ আমি গাইব গাইব বিজয়েরই গান/ চোখ থেকে মুছে ফেল অশ্রুটুকু/ এমন খুশির দিনে কাঁদতে নেই।
হে প্রগতির পথের অগ্রনায়ক, হে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বীর বাঙালি, হে মানবিক বিবেক বোধসম্পন্ন গণমানুষ, ধ্যানমগ্ন হয়ে নজরুল ইসলাম বাবুর লেখা প্রিয় সংগীতটি মনে মনে পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় আরেকবার গাইবে নিশ্চয়ই। মায়ের সম্ভ্রমহানি আর লাখো শহীদের আত্মার অতৃপ্তির প্রতিশোধ নিতে পারার বাঁধ ভাঙা কান্নাকে আজকের জন্য পরম মমতায় প্রশ্রয় দাও হে মুক্ত প্রাণ। মাথা উঁচু করে সটান দাঁড়িয়ে থাকো। চুয়াল্লিশ বছরের জমিয়ে রাখা দীর্ঘশ্বাস ও হাহাকার কান্নার জল হয়ে ঝরে পড়ুক বাংলাভূমে। তোমার কান্নার জলে আজ পবিত্র হোক আমাদের প্রিয় বাংলা মা।
ঊনিশশত একাত্তর থেকে দুই হাজার পনের সাল। দীর্ঘ চুয়াল্লিশ বছর ধরে সম্ভ্রম হারানো মা এবং শহীদ হওয়া মুক্তিযোদ্ধার বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদছিল। বিচার বিলম্বিত হওয়া বিচার না পাওয়ার শামিল, ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ উইলিয়াম গ্লাডস্টোনের এই আপ্তবাক্যটি বলেছিলেন। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধী কাদের মোল্লা ও কামারুজ্জামানোর ধারাবাহিকতায় আজ দুজন স্ব-স্বীকৃত মানবতাবিরোধী অপরাধী আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মধ্য দিয়ে বিলম্ব বিচার বা বিচারহীনতার সেই অন্ধকার সংস্কৃতি রহিত হলো।
মহান স্বাধীনতার এত বছর পর নিজের অপরাধ স্বীকার করে নিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমাপ্রার্থনার মধ্য দিয়ে একাত্তরের ছাত্র সংঘের সভাপতি ও আলবদর বাহিনীর প্রধান আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ প্রমাণ করলেন শতাধিক বুদ্ধিজীবী নিধনের দায় তাঁরই। আলবদর বাহিনীর নীতিনির্ধারণী অংশে আসামি মুজাহিদের অবস্থান ও আলবদরের কার্যক্রমের সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতার মাধ্যমে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২-এ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ফাঁসির দণ্ডাদেশ কার্যকর করা হলো। এর মধ্য দিয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যার ঐতিহাসিক দায় মোচনে আরেক ধাপ এগুলো মহান মুক্তিযুদ্ধে লাখো প্রাণ ও সম্ভ্রমের ত্যাগে পাওয়া বাংলাদেশ।
২০০৭ সালে ২৫ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে দম্ভভরে মুজাহিদ বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই। অতীতেও কোনো যুদ্ধাপরাধী ছিল না।’ কিন্তু ট্রাইব্যুনালের রায়ে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে ফাঁসির দণ্ডাদেশ কার্যকর এবং দোষ স্বীকার করে ক্ষমাপ্রার্থনার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করে গেলেন তিনি ছিলেন প্রকৃতই ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধী।
একাত্তরের ২৭ মার্চের পর থেকে মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজে রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প করা হয়েছিল। আলবদর বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরামর্শ ও পরিকল্পনার মাধ্যমে একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর থেকে বুদ্ধিজীবী নিধনসহ হত্যা, নির্যাতন ও বিতাড়নের মতো যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা সংঘটিত করেন। এ ছাড়া নাখালপাড়ার পুরোনো এমপি হোস্টেলে বন্দি সুরকার আলতাফ মাহমুদ, জহির উদ্দিন জালাল, বদি, শহীদজননী জাহানারা ইমামের ছেলে রুমী, জুয়েল, আজাদসহ আরো মুক্তিযোদ্ধাদের মুজাহিদের পরামর্শে অমানবিক নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়।
মুজাহিদের নির্দেশে সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন হত্যা, ফরিদপুরের বাকচরে হিন্দুদের হত্যা ও নির্যাতন এবং ফরিদপুরের রথখোলা গ্রামে রণজিৎ নাথসহ বিপুলসংখ্যক হিন্দুদের আটকে রেখে নির্যাতনের বিষয়গুলো সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। একাত্তরের ১৯ ডিসেম্বর ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের টিভি ও রেডিওর প্রতিনিধিরা মুক্তিযুদ্ধ শেষে মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজের কয়েকটি কক্ষে রক্তের স্রোত ভেসে যেতে দেখেন, সেই সঙ্গে বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্রগুলোও পড়ে থাকতে দেখা যায়। এতে বোঝা যায়, ওই কলেজটি ছিল প্রকৃতপক্ষে একটি হত্যাপুরী। এতে প্রমাণিত হয়, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর আসামি মুজাহিদ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পুণ্য রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আলবদর সদস্যদের উদ্দেশে তাঁর শেষ ভাষণ দিয়েছিলেন। আর আজকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মধ্য দিয়ে সেই বর্বরতার খেসারত দিলেন মুজাহিদ।
১৯৯২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠিত হয়। সর্বসম্মতিক্রমে এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন শহীদজননী জাহানারা ইমাম। এই কমিটি ১৯৯২ সালে ২৬ মার্চ গণ-আদালতের মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একাত্তরের নরঘাতক গোলাম আযমের ঐতিহাসিক বিচার অনুষ্ঠান করে। গণ-আদালতে দেশের গণহত্যা ও স্বাধীনতা বিরোধিতার প্রতীক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে দশটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপিত হয়। ১২ জন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত গণ-আদালতের চেয়ারম্যান জাহানারা ইমাম গোলাম আযমের ১০টি অপরাধ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য বলে ঘোষণা করেন। এ জন্য অবশ্য তৎকালীন সরকার জাহানারা ইমাম ও তাঁর কমিটির অপরাপর সদস্যের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা দায়ের করেন।
মূলত জাহানারা ইমামের এই গণ-আদালতের পথ বেয়েই আজকের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ এগিয়ে নিচ্ছে বর্তমান সরকার। জাহানারা ইমাম ছিলেন অসামান্য এক মা। যিনি নির্দ্বিধায় নিজের প্রাণাধিক প্রিয় সন্তান রুমীকে দেশমাতৃকার মুক্তিযুদ্ধে উৎসর্গ করেছিলেন। সেই জননী সাহসিকা জাহানারা ইমাম কিংবা রুমীর স্বপ্নের বাংলাদেশে আজ এক নতুন নজির স্থাপিত হলো বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল পরিকল্পকদের অন্যতম মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে।
অন্যদিকে অশ্লীলতা, ঔদ্ধত্য, ব্যঙ্গ ও বিদ্রূপের বর্বর পুরুষ বিএনপির ডাকসাইটে নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চট্টগ্রামের রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারী, বোয়ালখালী ও চট্টগ্রাম শহরে ধর্ষণ, লুটপাট, হিন্দুদের বাড়ি দখল এবং তাদের দেশান্তরে বাধ্য করার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের দেওয়া ফাঁসির দণ্ডাদেশ কার্যকর হলো।
গুড হিলস গ্যারেজ টর্চার সেলের মাস্টারমাইন্ড সাকা চৌধুরীর হাতে শহীদ রাউজানের কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক নূতন চন্দ্র সিংহ ও ঊনসত্তরপাড়ার হিন্দু বসতির গণহত্যার শিকার সবার আত্মা আজ নিশ্চয় শান্তি পাবে।
৩০ লাখ শহীদ আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমে পাওয়া আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতা। সেই মা-বোনদের নিয়েও কুৎসিত কটাক্ষ করে গেছেন সাকা চৌধুরী। তাঁর নোংরা ভাষায়, ধর্ষণ যখন নিশ্চিত, তা উপভোগ করা শ্রেয়! এখন আমরাও সমস্বরে বলি, ফাঁসি যখন নিশ্চিত, কনডেম সেলে বসে তা নিশ্চয় উপভোগ করতে পেরেছেন রাজাকার সাকা! এই ফাঁসির রায়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে অশ্লীলতার মূলোৎপাটন হলো বলে মনে করবেন সমাজের সুশীল শ্রেণির মানুষরা।
বাংলাদেশের মানুষের পরম দেশপ্রেম যখন জেগে ওঠে, মায়ের ভালোবাসায় আমাদের আবেগের ফল্গুধারা যখন উছলে উঠে, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যখন ৫৬ হাজার বর্গমাইলজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, অসাম্প্রদায়িক ভাবনার ঝড়টা যখন আরো বেগবান হয়, তখনই ভিত কেঁপে ওঠে দেশদ্রোহী, স্বাধীনতাবিরোধী শ্বাপদদের। রাজাকার ও জামায়াত-শিবির নামের হায়েনা চক্রের নোংরা শেকড় উৎখাতের সময় শুরু হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বলিয়ান হয়ে জেগে থাকবে মুক্তমনা মানুষেরা। অপশক্তি, ধর্মান্ধতা আর কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এটাই সময়।
কাদের মোল্লা ও কামারুজ্জামানের পর রাজাকার কাণ্ডের আরেক পর্বের পরিসমাপ্তি। এ এক সুশান্তিময় ইতিহাস বটে। পরম প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভৈরবী রাগের গান ‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি’র মধ্য দিয়ে সুখ খুঁজে নিক অবিনাশী মুক্ত প্রাণ।
শ্রেয়বোধের অগ্নিস্নানে পৃথিবীকে শুচি করতে ধর্ম নিয়ে অপরাজনীতি চর্চাকারীদের হীন মানবতাবিরোধী অপরাধের চুয়াল্লিশ বছরের পুঁতিগন্ধময় আবর্জনা ধুয়ে ফেলতেই হবে। তারপর সৃষ্টি হবে জাতি, ধর্ম, বর্ণ বৈষম্যবিরোধী পুরো মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক এক নতুন বাংলাদেশ। সেই সুবর্ণ সময় ও স্বপ্নিল বাংলাদেশের আশায় স্বর্গবাসী বুদ্ধিজীবী বা তরুণ মুক্তিযোদ্ধা রুমীর মতো করে তাঁদের অনুসারী আমাদের কণ্ঠেও এবার বাজুক কাজী নজরুল ইসলামের অগ্নিবীণার প্রলয়োল্লাস...
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন