বিজয়ের মাস
আকাশছোঁয়া আশাবাদ, এক সাগর হতাশা
১.
হৃদয়ের গহিনে অনেক স্বপ্ন, তার বাস্তবায়নে অনীহা। অনাকাঙ্ক্ষিত নানা বদল আর ঘাত-প্রতিঘাতের রাজনীতি আমাদের কর্মবিমুখতাকে আস্তে আস্তে স্বপ্নবিমুখতায় রূপ দিচ্ছে। জিঘাংসার ঘেরাটোপে আবদ্ধ স্বপ্নতরীর পালে দুর্ভাবনার হাওয়া লেগে তার দিশা পলে পলে বদলে গিয়ে দিকভ্রান্ত করছে আমাদের। তাই ভালো কিছু ভাবার অনেক আগেই আমরা হতাশ হই, ভয় পাই, ইচ্ছে-অনিচ্ছেয় নিজেদের আবিষ্কার করি নৈরাশ্যবাদীদের দলে। আর কাকডাকা ভোরে ঘুম ভেঙে প্রথম নজরে আসা দৈনিক পত্রিকার শিরোনামগুলোও এর অন্যথা বলে না। বারবার প্রশ্ন জাগে আমরা কি এমন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম? আমরা কী দেখার, কী দেখছি? কী শোনার কী শুনছি আর বলা উচিত ছিল কী? বলছি কী?
২.
মাত্র সাড়ে চার দশক আগের কথা। একবুক স্বপ্ন নিয়ে টগবগে যুবকরা চেয়েছিল এক চিলতে স্বাধীন সার্বভৌম ভূখণ্ডের মহাকাব্য লিখতে। যে দেশ হবে অনেক স্বপ্ন বাস্তবায়নের নামান্তর। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, আয়-বৈষম্য কিংবা আভিজাত্যের অভিশাপ স্পর্শ করবে না সে দেশের মানুষকে; যে দেশের নাম রক্ত দিয়ে লেখা। একটা লেখার শুরুতে এমনি ভর্ৎসনা চরম নৈরাশ্যবাদীর পক্ষেও শোভা পায় না। হয়তো আমিও লেখার শুরুটা এভাবে করতাম না। কিন্তু যখন মনে হয় নিজের চারদিকে কারাপ্রাচীরের মতো দেয়াল, দারিদ্র্য আমার টুটি টিপে ধরেছে, বাকস্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে যখন মুখে শক্তভাবে লেপ্টে থাকা স্কচটেপ আবিষ্কার করি তখন সত্যি আমি বাকরুদ্ধ, দিশাহীন এক অন্ধ প্রকোষ্ঠের বাসিন্দা। মনে হয় স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক পরেও নিজ দেশে পরবাসী। অন্তত টিভি রিমোট যখন হাতে নিই; একের পর এক চ্যানেল ঘোরাতে গিয়ে যখন আমার মাথা ঘোরার দশা, আবিষ্কার করি সিংহভাগ টিভি চ্যানেল আমার দেশের নয়, বাইরের কারো। সেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার জিঞ্জির ছেড়ে পাকিস্তানি শোষণের ফাঁস। তারপর একে একে কত বদল, কত রক্তক্ষয় কী লাভ হয়েছে আমার। বলতে গেলে নিজ অস্তিত্ব হারিয়ে ধুঁকছি কালান্তের দুর্বিপাকে।
৩.
যদি প্রশ্ন করি মধ্যম আয়ের দেশে মধ্যবিত্ত কোথায়? সত্যি কাঁচাবাজার থেকে শপিং মল কিংবা অভিজাত বিপণিবিতান সবখানে একই দশা। মূল্যমান যেখানে কাঞ্চনজঙ্ঘা ছুঁতে চায়, সেখানে মধ্যবিত্তের পাত্তা নেই। আর রাস্তায় নামলে যতগুলো পাবলিক বাস চোখে পড়ে, তার চেয়ে ঢের বেশি মানুষ এখন কারে চড়ে। আর যেগুলোও বা বাস আছে তার আবার শ্রেণীকরণটা বেশ। সত্যি চোখে পড়ার মতো।
মধ্যযুগের নাইটরা নেই, তবে এখনকার সিটিং বাসের যাত্রীরা আছে। ভদ্রপল্লীতে ইতরজনের প্রবেশ নিষেধ; সিটিং বাসগুলোতে আসন খালি থাকলেও তা শুধু বাইরে থেকে চেয়ে চেয়ে দেখার, সর্বজনের ভ্রমণের জন্য নয়। সত্যি যে অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে জীবন দিয়েছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষ; তাঁরা সাম্যের মর্মবাণীতে দীক্ষিত হয়ে লড়েছিলেন তা আজও অধরা। যখন আয়-বৈষম্যের পাগলা ঘোড়াকে থামায় সাধ্য কার? এ বৈষম্য সময় ছাপিয়ে ছড়িয়েছে দপ্তর থেকে দপ্তর, জনপথ থেকে রাজপথ আর কাঁচাবাজার থেকে শপিং মল। বলতে গেলে এক শ্রেণির আধিপত্য গ্রাস করে নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালের সব অর্জন। ওই পাজেরো জিপের ঠান্ডায় বসে থাকা লোকটি যেমন বোঝে না তার ধুলো ঘেমে-নেয়ে একাকার হওয়ার মানুষটির জন্য কতটা যন্ত্রণার, শপিং মলে নিয়ে বিনা বাক্য ব্যয়ে পণ্য কেনা মানুষটিও তাই বোঝে না একজন দিনমজুরের আয়ের সমাদর কীভাবে করতে হয়। তাই তো শেষ পর্যন্ত দেখা যায় উন্নয়ন আর মাথাপিছু আয় নামের কাঁচুলিতে ঢাকা যাচ্ছে না হতদরিদ্রের উন্মুক্ত বক্ষ।
৪.
রক্ত দিয়ে বাংলাদেশ নামের এক মহাকাব্য লেখা হলেও তার পরিণতিপর্ব এখনো অতিক্রম করা যায়নি। আমাদের খাদ্য-বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার ব্যবস্থা সে তো অনেক পরের কথা। আমরা নিজ জীবন বিপন্ন দেখে বলি নিরাপদ মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই। পুরো প্রতিবেশ যেখানে বিরুদ্ধ, চারপাশের বাস্তবতা যেখানে এমন হিংস্র তখন স্বস্তি নয় অহর্নিশ আতঙ্কের ঘনঘটাই আমাদের নিত্যসঙ্গী। যে ভয় আর অনিশ্চয়তা এতদিনে পৌঁছে গেছে আমাদের বিনষ্ট মগজেও। মানুষ মাত্রই জানে এমনি আহত মন, বিনষ্ট মগজ নিয়ে জীবন্মৃত হয়ে দিন পার করা মৃত্যু যন্ত্রণা থেকে ভয়ানক। যে যন্ত্রণায় অফিসের জন্য বের হয়ে আপনি বাস পাবেন না, রাস্তার মোড়ে দেখবেন কেউ কেউ মলমূত্র ত্যাগ করছে, জায়গায় জায়গায় ময়লার স্তূপ প্রলম্বিত হয়ে শেষ পর্যন্ত প্রিয় রাজধানীই একটা ভাগাড়ের নামান্তর। হালকা বর্ষণেও দেখা দেবে জলজট, কর্মদিবসের বাইরে ছুটির দিনেও নিত্যসঙ্গী হবে যানজট। প্রতিদিনের বাজারে ব্যাগ ভরে টাকা নিয়েও পণ্য পকেটে আনার ভয় দেখা দেবে।
চিন্তাবিদরা হয়তো ভাবছেন কারাপ্রকোষ্ঠের বাইরে যারা থাকবে, তাদের ঘিরে ধরবে দুর্ভাবনার হাতকড়া; যা থেকে আমি-আপনি মুক্ত নই কেউই। প্রাথমিক শিক্ষকরা দিনের পর দিন করে যাচ্ছেন অনশন, মাধ্যমিকে লেখাপড়ার চেয়ে পরীক্ষা বেশি, শিক্ষার চেয়ে বেড়ে গেছে ব্যবসার হার। আর যত বড় অপদার্থ যে, পোষ্য বুদ্ধিজীবিতার বাজারে তত দামি সে। রাজনৈতিক পরিচয়, যোগ্যতা, সামাজিকতা নির্বিশেষে দেশের শীর্ষ বিদ্যাপীঠগুলো চলে গেছে মুষ্টিমেয় কিছু জ্যেষ্ঠ শিক্ষকের দখলে। সেখানে তাঁরা রাজতন্ত্রের আদলে চালু করেছেন পরিবারতন্ত্র। তাদের সন্তানদের জন্মই হয়েছে একটি ক্যাম্পাসের শাসন করার ব্রত নিয়ে, যেখানে হাজারো যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বাকিরা ম্লেচ্ছ, অযোগ্য এবং অনাহুত। তাই তো সময়ের আবর্তে শিক্ষাদানের বদলে বড় হয়ে উঠছে মার্কস নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি।
হুমায়ুন আজাদ হয়তো এটা ভেবেই বলেছিলেন, শুধু হাহাকার জাগে; আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম? এই কি আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ, সোনার বাঙলা? আর আফসোসের শেষ সীমায় না গেলে কেউ কি বলতে পারে- ‘আমি কি ভালোবাসতে জানি না? আমার কি হৃদয় বলে কিছু নেই? আমি কি ভোরবেলায় পাখির ডাকে জেগে উঠে রোদ দেখে, কুয়াশা দেখে, ঘাস দেখে, কারো মুখ দেখে, হঠাৎ কারো কণ্ঠস্বর শুনে সুখ পাই না? আমি কি ভালোবাসি না দুঃখী এই দেশকে? এ দেশ কি আমার রক্তের সঙ্গে জড়ানো নয়? আমি কি এই দেশকে আমার জন্যে অপরিহার্য করে তুলিনি, আমি কি এমন কাজ করিনি যাতে এ দেশেই আমার নিয়তি হয়? আমি কি উদ্বাস্তু হয়ে পরবাসে গিয়ে পথে পথে ভিক্ষে করে ফিরতে চাই? এখন মাঝেমাঝে তাই মনে হয়, ইচ্ছে হয় নির্বাসিত হই, এমন কোনো দেশে গিয়ে পথে পথে ভিক্ষে করে ফিরি, উচ্ছিষ্ট খেয়ে বাঁচি, পথের পাশে পড়ে থাকি, যাতে আমার কখনো মনে না পড়ে যে আমার একটি স্বদেশ ছিল, যার নাম বাংলাদেশ, যকে আমি ভালোবাসতাম, যাকে বিশ্বাসঘাতকরা বলাৎকার করে করে ভেঙেচুরে ফেলেছে।’
৫.
বর্ষার মুখ ভার করা আকাশ যদিও শোনায় কান্নার সাত সুর; ষড়ঋতুর এই দেশে শরৎ, হেমন্ত, শীত, গ্রীষ্মে ঠিকই সূর্য ওঠে, সুরেলা কণ্ঠে বসন্তবৈরী গায় কোকিল আর আমরা নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। ভাবতে থাকি অতলান্তিক হতাশার বেড়াজাল একদিন কাটবে। আমাদের আকাশে থাকা স্বপ্নগুলোর রং ফ্যাকাশে হওয়ার আগে আরেক দফা ভাস্বর হবে রামধনুর সাতরঙে। তাই তো এত কষ্ট সয়েও গর্বভরে বলি ‘আমরা স্বাধীন’। টিভির সামনে বসে থাকি কত আশা নিয়ে। তামিম-মুশফিক-সাকিবরা যখন চার-ছক্কা মারে তখন আনন্দের সঙ্গে চিৎকার দিই; বলি ‘বেশ বেশ বেশ, সাবাস বাংলাদেশ’।
বিজ্ঞানী জাহিদ যখন ওয়েইল ফার্মিয়ন আবিষ্কার করেন, তখন আরেক দফা আপ্লুত হই, নতুন করে ভাবি আমার দেশের নাম বাংলাদেশ। ড. ইউনূস যখন নোবেল পুরস্কার লাভ করেন মনে হয় বেশ তো আছি, বেশ ভালো আছি আমি আমার বাংলাদেশকে নিয়ে। আর একে সুন্দর, নিরাপদ ও বাসযোগ্য এক স্বর্গভূমি হিসেবে গড়ে তোলার দায়টা তাই আমাদেরই। অন্তত লাখো শহীদের রক্তের ঋণে আমরা যখন দায়বদ্ধ আমাদের কাজ করতেই হবে নিজের, দেশের ও দশের জন্য।
লেখক : পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।