সোজা কথা
রেলের জায়গা কি উদ্ধার করতে পারবেন নগরপিতা?
পাক্কা পলিটিশিয়ানদের মতোই ঢাকার দুই নব্য (ছয় মাস বয়সী) মেয়র বলছেন, এত কম সময়ে তাঁদের কাজের অগ্রগতি বোঝা যাবে না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার দুই নির্বাচিত মেয়রের একটি কথা আমার খুব মনে ধরেছে। উত্তর-দক্ষিণের নগরপিতারা বলছেন, ‘এই সরকারের প্রধান ব্যক্তিটি থেকে শুরু করে মন্ত্রী-আমলা-কর্মচারী সবাই আমাদের পক্ষে আছে, আমাদের জন্য ঢাকাকে বদলে ফেলা কোনো অসম্ভব কাজ নয়।’ সত্যিই তো, যখন জনগণের ম্যান্ডেট পেয়ে কোনো জনপ্রতিনিধি ক্ষমতায় আসেন, তখন তিনি একা সব কাজ করতে পারেন না। তাঁকে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তা নিতে হয়। সারা দেশের সিটি করপোরেশনের মেয়রদের দেখলেই তো আমরা বিষয়টি বুঝতে পারি। সরকারি দলের পক্ষের যাঁরা, তাঁদের জন্য কাজ করতে অনেক সুবিধা আছে। তাঁরা চাইলেই মন্ত্রী-আমলাদের দিয়ে তাঁদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করিয়ে নিতে পারেন, তাঁদের কোনো বিল আটকে থাকে না অনুমোদনের অপেক্ষায়। আমরা যদি ঢাকার দুই মেয়রের কথায় আসি তাহলে তো পরিষ্কার দেখাই যাচ্ছে অনেক হাঁকডাক দিয়ে একাধিক মন্ত্রীকে নিয়ে তাঁরা কাজ করছেন।
ছয় মাস হলো তাঁরা দায়িত্ব পেয়েছেন। এরই মধ্যে দক্ষিণের মেয়র ধোলাইখালের অবৈধ পার্কিং দূর করেছেন। আর উত্তরের মেয়র তো বিশাল যজ্ঞই লাগিয়ে দিয়েছেন। বহু বছর ধরে তেজগাঁওয়ে রেলের জমিতে অবৈধভাবে ট্রাকস্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে, তারাই এই অবৈধ দখলদারীদের হাতে জিম্মি হয়ে যায়। উত্তরের মেয়র ঝানু ব্যবসায়ী। তিনি দেনদরবার করলেন ট্রাক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। পরিবহন শ্রমিক নেতা, নৌমন্ত্রী, যোগাযোগমন্ত্রী এবং রেলমন্ত্রীকে নিয়ে তিনি তেজগাঁও সাতরাস্তা থেকে তেজগাঁও রেলগেট পর্যন্ত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের ঘোষণা দিলেন। এর মধ্যে তিনি দফায় দফায় বসলেন ট্রাক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। তাঁদের আশ্বস্ত করলেন, রেলের সম্পত্তির মধ্যেই ৩৯ একর জায়গায় তাঁদের জন্য উন্নতমানের ট্রাকস্ট্যান্ড গড়ে দেবেন।
৭ নভেম্বরের মধ্যে অবৈধ স্থাপনা সরানোর জন্য বললেন ব্যবসায়ীদের। তাঁরা না সরায় সময় বাড়িয়ে ২৭ নভেম্বর করলেন। তাতেও কাজ না হওয়ায় ৩০ নভেম্বর দলবল নিয়ে হাজির হলেন উচ্ছেদ করতে, সঙ্গে রেলমন্ত্রী। তবে রহস্যজনকভাবে সেদিন নৌপরিবহনমন্ত্রী শ্রমিক নেতা শাহজাহান খানের থাকার কথা থাকলেও তিনি ছিলেন না। অনেক ট্রাক ব্যবসায়ীই তাঁদের ট্রাক সরিয়ে নিয়েছিলেন, অনেকে তাঁদের দোকানপাটও সরিয়ে ফেলেন। যাঁরা সরাননি, তাঁদের স্থাপনা এবং ট্রাক ভাঙার নির্দেশ দিয়েছিলেন মেয়র। এতে একপর্যায়ে শ্রমিকরা উত্তেজিত হয়ে ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করে। পুলিশ আর র্যাবের সঙ্গে সংঘর্ষ বাড়তে থাকে শ্রমিকদের মধ্যে। এ সময় মন্ত্রী ও মেয়র অবস্থান নেন বাংলাদেশ ট্রাকমালিক সমিতি ও ইউনিয়নের অফিসে। পরে রেলমন্ত্রী সেখান থেকে বেরিয়ে গেলেও মেয়র থেকে যান। এ সময়টাতে মেয়র পাক্কা রাজনীতিবিদদের মতোই আচরণ করেন। ইউনিয়নের অনেক সদস্যই যাঁরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন তাঁদের ভাষ্য হচ্ছে, উচ্ছেদ ঘটনার ১৫ দিন আগে মেয়র তাঁদের অফিসে যান। তিনি নেতাদের সঙ্গে মিটিং করেন। ওই মিটিংয়ে তেজগাঁও টার্মিনালের আশপাশের সকল অবৈধ স্থাপনার উচ্ছেদ করা হবে বলে জানানো হয়। প্রতিশ্রুতি দেন, অফিসের পেছনের রেলের সম্পত্তি ৩৯ একর জমিতে তিনি আধুনিক একটি ট্রাক টার্মিনাল করে দেবেন। তবে ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে টার্মিনালের কোনো স্থাপনা উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হয়নি। ওই বৈঠকে ইউনয়নের নেতারা মেয়রকে জানিয়েছিলেন যে একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে তাঁরা বৈঠক করে বিষয়টি জানাবেন। কিন্তু তিনি তাঁদের সিদ্ধান্ত না মেনে সকাল বেলায় স্থাপনা উচ্ছেদ করতে এলে মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
এদিকে মেয়র যখন কার্যতই অবরুদ্ধ ছিলেন ইউনিয়ন অফিসে, সে সময় ট্রাকমালিক সমিতির পক্ষ থেকে মাইকে ঘোষণা করা হয় মেয়রসাহেব তাদের দাবি মেনে নিয়েছেন, আর কোনো উচ্ছেদ হবে না। তখন শ্রমিকরা শান্ত হন। এর প্রায় আধঘণ্টা পর মেয়র বেরিয়ে এসে হ্যান্ড মাইকে শ্রমিকদের উদ্দেশে বলেন, জনগণের স্বার্থেই এই জায়গা থেকে তাদের সরতে হবে। আবারও শ্রমিকরা উত্তপ্ত হতে শুরু করলে মেয়র তাঁদের আশ্বস্ত করেন ভেতরে তাঁদের জন্য আধুনিক টার্মিনাল হবে। এরপর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
আমার কথা হচ্ছে ট্রাক শ্রমিক নেতারা যে বললেন, একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে তাঁরা বিষয়টি মীমাংসা করবেন, সেই মন্ত্রীরা তাহলে সেদিন সেখানে গেলেন না কেন? শ্রমিক নেতারা বারবার বলছেন, তাঁরা বেশির ভাগই চান অবৈধ স্থাপনা সরাতে কিন্তু কয়েকজন ব্যবসায়ীর কারণে তাঁরা পারছেন না। সেই কয়েকজন ব্যবসায়ীকে নাকি মেয়র সাহেবও ভালো করে চেনেন, তাহলে তিনি তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কাজটি আগে না করে গন্ডগোল হতে পারে জেনেও সেদিন ওখানে গিয়েছিলেন? মেয়রসাহেব নিজে একজন ব্যবসায়ী, তারপরও ব্যবসায়ীদের ওপর প্রভাব খাটাতে তিনি ব্যর্থ হচ্ছেন? মাফ করবেন মেয়র মহোদয়, আপনি একজন সুবক্তা এবং একসময়ের খুব জনপ্রিয় টিভি ব্যক্তিত্ব। আপনি যখন কোনো কথা বলেন, তখন মানুষ খুব চায় আপনাকে বিশ্বাস করতে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্য নির্বাচনকালীন প্রচারণা থেকে শুরু করে মেয়র হওয়ার পর পর্যন্ত আপনার কার্যক্রম জনগণের কাছে অনেকটা মিডিয়ায় স্টান্টবাজি হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে। সে আপনি ঝাড়ু হাতে রাস্তা পরিষ্কার করুন, আর সাইকেল চালিয়ে ভোট চেয়ে বেড়ান। কারণ রাজধানীবাসীর বিপর্যয়ের সময়ে আপনার এবং দক্ষিণের মেয়রেরও অসহায় অবস্থা দেখে আক্ষরিক অর্থেই আমরা হতাশ হয়েছি। আপনারা নগরবাসীকে জলাবদ্ধতা থেকে বাঁচাতে পারেননি, পারেননি কোরবানির বর্জ্য অপসারণে কোনো স্থায়ী সমাধান দিতে। এখন পর্যন্ত রাজধানীর যানজট নিরসনে অবৈধ পার্কিং বন্ধ করতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি।
আপনারা পলিটিশিয়ানদের মতোই দীর্ঘমেয়াদি সব পরিকল্পনার গালগল্প শোনাচ্ছেন। কিন্তু নগরবাসীর ছোট্ট ছোট্ট সব সমস্যা দূর করতে কোনো আশার আলো দেখাচ্ছেন না।
তেজগাঁও এলাকার যে বিশাল অংশজুড়ে দখলদারদের দৌরাত্ম্য, চাঁদাবাজি, মাদকের আখড়া, চুরি ছিনতাই আর অবৈধ ব্যবসার সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে তার শেকড় অনেক গভীরে। রেলের যে বিশাল জায়গা যুগের পর যুগ অবৈধ দখলদারদের কব্জায় তা উদ্ধার করতে না পারলে এই ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ সাময়িক হবে। নতুন কোনো ঘটনার ডামাডোলে আবারও ঢেকে যাবে এই উদ্ধার অভিযান।
শ্রমিকদের হাতে রাখতে আবার নতুন কোনো নাটক সামনে আসে এখন শুধু সেটাই দেখার অপেক্ষা। আমরা ভেতরের হিসাবনিকাশ জানি না। আমরা আমজনতা সাদা চোখেই দেখতে চাই দুর্ভোগ থেকে নিষ্কৃতি পেলাম কি না। আর কারওয়ান বাজারে দাঁড়িয়ে হাতিরঝিলের দিকে তাকালে, অবৈধভাবে ঝিলের মধ্যে বিজিএমইএ ভবনটার দিকে চোখ যায়, এই অবৈধ স্থাপনাটিও তো সরাতে হবে না কি?
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ