২০১৬
নতুন সূর্যের নতুন স্বপ্ন
Morning shows the day-এই প্রবাদ বাক্যটি মনে হয় পরিবর্তনের সময় এসেছে। বিশেষ করে ২০১৫ সালের দিকে তাকালেই অনেকটা তাই মনে হওয়া স্বাভাবিক। কারণ, বছরটাই শুরু হয়েছিল এক অনিশ্চয়তা আর নানা আশঙ্কার দোলাচলে। জামায়াত ইসলামের ডাকা হরতালের মধ্যে দিয়ে বছরের প্রথম সূর্যটা ম্লান হয়ে যায়।
বিএনপির লাগাতার হরতাল, সরকারের অনমনীয় প্রতিরোধে দেশের মানুষ দিশেহারা। আমজনতা যদি শুধু দিশেহারা হয়েই নিষ্কৃতি পেত তাহলে না হয় কথা ছিল। টানা অবরোধে পেট্রলবোমার আতঙ্কে ঘর থেকে বের হতেই মানুষ ভরসা পেত না। রাজনীতির বলি হয়ে কত মানুষ ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়ার প্রার্থনা করেছে সেই দৃশ্য এখনো মনে হলে গা শিউরে ওঠে।
সংসদ ভবন এলাকায় পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয় ইডেন কলেজের তিন শিক্ষার্থী। কক্সবাজার থেকে ফেরার পথে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে পেট্রল বোমা জীবন কেড়ে নেয় মেধাবী শিক্ষার্থী মাইশা নাহিয়ানের।
ঘুমন্ত ট্রাকচালক রাজনীতির প্রতিহিংসার বলি হয়ে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। অর্থ্যাৎ বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রতিটি সকাল ছিল আতঙ্কের। ঘুম থেকে চোখ মেলেই মনে আতঙ্ক কাজ করত আজ না জানি কার মৃত্যুর খবর শুনতে হয়।
ঢাকার বাইরের পরিস্থিতি ছিল আরো ভয়াবহ। একে তো পেট্রলবোমা আর সহিংসতার আতঙ্ক তার ওপর রাজনীতির সাথে জড়িত মানুষেরা নানা হামলা মামলা আর গুম আতঙ্কে ঘর ছাড়া বাড়ি ছাড়া, এলাকা ছাড়া এমনকি দেশ ছাড়াও।
কথায় আছে, শিক্ষানীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, সব নীতিই নাকি রাজনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সেই ক্ষেত্রে বলা যায়, এবারের বছরটাই রাজনীতির বছর তবে সেটা অপরাজনীতির। টানা অবরোধের কারণে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা কয়েক দফায় রুটিন পরিবর্তন করে দুই মাসে শেষ করা হয় ।এ তো গেল অপরাজনীতির কারণে সৃষ্ট নানা বিপর্যয়ের কথা।
২০১৫ সাল যে কারণে কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে তা হলো শিশু নির্যাতনের বীভৎস কয়েকটি ঘটনা। জুলাই মাসে সিলেটে শিশু রাজন হত্যার নির্মম ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়বার পর দেশের মানুষ বিস্ময়ের সাথে দেখে, কতটা নির্মম নৃশংস হয়ে উঠেছে মানুষ। এর ঠিক পরের মাসেই অগস্টে খুলনায় রাকিব নামের এক শিশুকে পৈশাচিক উপায়ে হত্যা করা হয়। কাছাকাছি সময়ে ঢাকার এক কিশোর নাজিমকে একটা কবুতর চুরির দায়ে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনাও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক মাধ্যমে। সেই ভিডিওচিত্রে দেখা যায় দিন-দুপুরে এক কিশোরকে পিটিয়ে আহত করে পানিতে ডুবিয়ে মারা হচ্ছে অসংখ্য মানুষের সামনে, সবাই দৃশ্যটি উপভোগ করছে, কেউ ছেলেটিকে বাঁচানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা করছে না। মৃত্যুর আগে ছেলেটি একটু পানি খেতে চেয়েছে তাও কারো মন গলল না। হায় রে মানুষ, হায় রে তার বিবেক!
অপরাজনীতির এক চরম দৃষ্টান্তের কথা তো বলতেই ভুলে গেছি। সেটা হলো জুলাই মাসের ২৩ তারিখ মাগুরায় ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে মায়ের পেটে থাকা শিশু গুলিবিদ্ধ হয়। এমন ভয়ঙ্কর ঘটনা স্তব্ধ করে দেয় গোটা জাতিকে।
বাঙালির প্রাণের আয়োজন বইমেলার কপালে কলঙ্কের তিলক এঁকে দেওয়া হয় ব্লগার অভিজিতকে হত্যার মধ্য দিয়ে। দুষ্কৃতকারীরা তাঁকে কুপিয়ে সবার সামনে হত্যা করে, নির্লিপ্ত থাকে মানুষ, নির্বিকার পুলিশ। এখানেই থেমে যায় না মুক্তমনা ব্লগারদের ওপর হত্যার খড়গহস্ত। একের পর এক আঘাত আসতে থাকে। কোনো ক্ষেত্রে খুনীরা সফল হয়, অনেকক্ষেত্রে আবার বিফল হয়। দেশব্যাপী মানুষ সোচ্চার হয়ে ওঠে খুনিদের বিচারের দাবিতে। হত্যার কোনো ক্লু মেলে না কিন্তু অপমৃত্যুর মিছিলে যোগ হয় বিদেশি হত্যার তালিকা। আর সবক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারি বাহিনীর সদস্যরা অনেকটাই শূন্যে হিসেব মেলাতে ব্যস্ত থাকেন বছরজুড়ে।
এখানেই শেষ নয়। ২০১৪ সালের ২৬ ডিসেম্বরের পুনরাবৃত্তি ঘটে চলতি বছরের ৮ ডিসেম্বর। এই দিনে শ্যামপুরে বিষাক্ত ম্যানহোলে পড়ে গিয়ে নির্মমভাবে মারা যায় শিশু নীরব। বছর শেষে নিথর নীরবের দেহটি যেন এক নির্মম পরিহাস। এর আগের বছর ২০১৪ সালে এই ডিসেম্বর মাসের ২৬ তারিখে শিশু জিহাদ শাহজাহানপুরে পরিত্যক্ত এক পানির পাইপে পড়ে মারা গিয়েছিল। জিহাদের মতো মরে গিয়ে নীরব যেন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল আমরা কখনো ভুল থেকে শিক্ষা নেই না। তাই যদি নিতাম নীরবকে এভাবে চলে যেতে হতো না।
এ বছরের আলোচিত ঘটনার মধ্যে সেপ্টেম্বরে বনশ্রীর ‘অদম্য বাংলাদেশ’ সংগঠনের চার সেচ্ছাসেবককে শিশু পাচারকারী অপবাদে গ্রেপ্তারের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিন্দার ঝড় উঠেছিল।
একই মাসে ঘটে ক্রিকেটার শাহাদাত ও তাঁর স্ত্রী কর্তৃক গৃহপরিচারিকা শিশু হ্যাপি নির্যাতনের ঘটনা। যা বিশ্ব মিডিয়াতেও সমালোচিত হয়। অক্টোবরের দ্বিতীয় দিনে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে চতুর্থ শ্রেণির শিশু শাহাদাতকে গুলি করেন সংসদ সদস্য লিটন।
এত রাশি রাশি দুঃখ দিয়ে গাঁথা আমাদের ২০১৫ সালটা। আমরা হারিয়েছি আমাদের কত প্রিয় স্বজনদের, কত বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের। সব হারানোর ব্যথা অবশ্য এক রকম নয়। কিছু হারানো প্রকৃতির নিয়মেই ঘটবে। কিন্তু যে দুর্ঘটনা যে অপমৃত্যুগুলো সারাবছর আমাদের কাঁদিয়েছে তার দুঃখ ভোলা কি এত সহজ?
তাই বলে কি আমাদের প্রাপ্তির খাতা একবারেই শূন্য? তা অবশ্যই নয়। প্রথমেই যেমনটা বলছিলাম। বছরের শুরুটা দেখে মনে হয়েছিল ভালো কিছু বুঝি হওয়ার নেই। আমরা এ বছরে যতটা না হারিয়েছি তার তুলনায় প্রাপ্তিও কিন্তু কম নয়। এ বছরের সেরা প্রাপ্তি যে আমাদের জন্ম ইতিহাসের সাথে জড়িত। মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত সবচেয়ে কুখ্যাত তিন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি হয়েছে এ বছর। এর মধ্যে দিয়ে আমরা জাতি হিসেবে দায়মুক্ত হয়েছি। এ বছরের নভেম্বরে রাজন ও রাকিব হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ করে দোষীদের ফাঁসির রায় দেন আদালত। এত দ্রুত সময়ে বিচার বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল।
নড়াইলের মায়ের পেটে গুলিবিদ্ধ শিশুটিকে কি অক্লান্ত চেষ্টা দিয়ে এই দেশেরই ডাক্তাররা মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিয়েছেন। কে বলে ডাক্তাররা আর মানুষ নেই? যে শিশুটির বেঁচে থাকাটাই অলৌকিক, জন্মের আগেই যে শিশুটি মানবতার চরম নির্মমতার শিকার সেই শিশুটি জীবন ফিরে পেল কত মানুষের ভালোবাসায়। সারা দেশের মানুষ রুদ্ধশ্বাসে প্রতিনিয়ত দোয়া করেছে ফিরে আসুক শিশুটি। সে ফিরে এসেছে মানবতার জয়গান গেয়ে।
বাঙালির প্রাণের উৎসব বইমেলা কিংবা পহেলা বৈশাখের ন্যক্কারজনক ঘটনায় বারবার শিউরে উঠতে হয়েছে একটা কথা ভেবে, বছরের শুরুতেই যখন বাঙালির অস্তিত্বের বিরোধিতাকারিরা উঠে পড়ে লেগেছে, তাহলে কি আর সুরের দেশ, গানের দেশ, উৎসব পাগল বাঙালি জাতি কি এভাবেই সারাবছর ম্লান হয়ে থাকবে?
আমাদের বারো মাসে তের পার্বন লেগেই থাকে কিন্তু উৎসবের ওপর একের পর এক আঘাত কি তবে সব আনন্দের আবীরে বিষাদের ধূসর রং ঢেকে দেবে? না, শেষ পর্যন্ত তা কিন্তু ঘটেনি। এটা ঠিক, দেশের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিশ্বের অনেক দেশই তার দেশের নাগরিকদের বাংলাদেশে আসতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল খেলতে আসেনি। কিন্তু এই দেশের মাটিতেই দেশ-বিদেশ থেকে বরেণ্য শিল্পীরা এসেছেন। রাতভর খোলা মাঠে বসে বাঙালি সব কষ্ট ভুলে গিয়ে প্রাণ খুলে গান শুনেছেন।
কী হয়নি এ বছর! বাউল উৎসব, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসব- যার সব কটিতে শুধু দেশের নামকরা শিল্পীরা অংশ নিয়েছেন তা নয়, বিদেশি বিখ্যাত সব শিল্পী এসেছেন, গান গেয়ে নিজেরাই এদেশের দর্শক শ্রোতার ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে সন্তুষ্ট মনে নিরাপদে দেশে ফিরে গেছেন।
কাজেই বছর শেষে বলা যায় শেষ ভালো যার, সব ভালো তার। আমরা বীরের জাতি, আবেগপ্রবণ জাতি। অনেক ভুল আমাদের, অনেক বেশি আবেগে আমরা অনেক অন্যায়কেও প্রশ্রয় দিয়েছি। হয়তো ভবিষ্যতেও দিব। কিন্তু তাই বলে এদেশে পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তানের মতো বর্বর জাতি কখনোই হব না। কারণ বাঙালি তার প্রিয় শিল্পীর গান শোনার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা শীতের রাত ছোট্ট শিশুটিকে কোলে নিয়ে খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। পথ চলতে গিয়ে প্রিয় কোনো সুর ভেসে এলে আবেগে কেঁদে ফেলতে পারে এই জাতি।
তাই ২০১৫ সালে যত জঙ্গি হামলাই হোক না কেন, এ দেশে কখনোই সুর থেমে যাবে না। শিল্পী তাঁর তুলির আঁচড়ে চিরায়ত লাল-সবুজ বাংলাকেই আঁকবে যত হুমকিই আসুক না কেন। জয়তু বাঙালি জাতি।
২০১৫ সালের সব ভুল ঝেড়ে ফেলে নতুন সূর্য আসবেই। ২০১৬ সালের নতুন সূর্য নতুন দিনের স্বপ্নই বয়ে আনবে। সবাইকে নতুন সফল বছরের অনেক শুভেচ্ছা।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ।