২০১৬
নতুন বছরের রাজনীতি-ভাবনা
এরই মধ্যে ২০১৬-কে স্বাগত জানিয়েছে পুরো বিশ্ব। একান্ত হতাশাবাদী ছাড়া দুনিয়ার তাবৎ মানুষই আসলে স্বাগত জানায় নতুন বছরকে। কামনা করে মানুষের কল্যাণের জন্য, শুভ বারতা নিয়ে আসুক আসছে বছরটি। কিন্তু নতুন বছরটির শুভ-অশুভ সৃষ্টি করার ক্ষমতা নেই। সব কল্যাণ-অকল্যাণের স্রষ্টা তো মানুষই। নতুন বছরকে কেমন দেখতে চায় আর কীভাবে সাজাতে চায়, সেটিই হচ্ছে আসল কথা। আর এ পথ পরিক্রমণে, নীতিনির্ধারণে পেছনে তো তাকাতে হবেই। চলমান রাজনীতি নিয়ে আমাদের মধ্যে রয়েছে নানা শঙ্কা ও অস্বস্তি। নতুন বছরে তাই রাজনীতি-ভাবনা আমাদের চিত্তকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
ভালো-মন্দের মিশেলে আমরা ২০১৫-কে অতিক্রম করেছি। গেল বছরটিতে আমাদের নানা ক্ষেত্রে যেমন কমবেশি ব্যর্থতা ছিল, তেমনি সম্ভাবনা ও সাফল্যের সুবাতাসও বয়েছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। বিগত বছরের সংঘাতময় রাজনীতি থেকে কিছুটা বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম আমরা। ২০১৪-এর নির্বাচন বানচাল করতে গিয়ে ভয়ানক অমানবিক আচরণে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছিল জামায়াত-বিএনপি। আর তার প্রতিক্রিয়ায় সরকারের শক্ত প্রতিরোধে কোণঠাসা হয়ে পড়ে দল দুটি। ফলে আন্দোলনের নামে রাজনৈতিক সংঘাত বিস্তারিত হওয়ার সুযোগ পায়নি। তাই এক ধরনের সরকারি দমননীতির বলয়বন্দি হয়ে রাজনীতিতে বিএনপি-জামায়াত অনেকটা কোণঠাসা অবস্থায় পড়লেও সাধারণ মানুষ কিছুটা স্থিতিশীল জীবন নির্বাহ করতে পেরেছে। এ অবস্থার সুবাতাসে সামাজিক-অর্থনৈতিক জীবনে গতি সঞ্চারিত হয়েছে। দেশের অর্থনীতিতে ঘটেছে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি। আমাদের অর্থনীতির সূচক দেশটিকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর করার পথ দেখায়। স্বাধীনতার পর এটি এক বড় অর্জন।
ফেলে আসা বছরে দুর্বল গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারায় পৌর নির্বাচন একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এবারই প্রথম দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হচ্ছে। এ নিয়ে বিতর্ক চলছিল অনেক দিন। এখন অবশ্য নির্বাচনী প্রচারে নেমে সে বিতর্ক থিতিয়ে গেছে। তবে নির্বাচনকে ঘিরে অনেক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, যার নেতিবাচক প্রতিফলন সমাজকে অনেক দিন বহন করতে হবে।
এসবের পরও আমরা নতুন বছরকে ঘিরেই প্রত্যাশার আলো জ্বালাতে চাই। এ সত্য নিশ্চয়ই সকলে মানবেন, অমিত সম্ভাবনা ছড়িয়ে আছে আমাদের চারপাশে। রয়েছে ঈর্ষণীয় মানবসম্পদ। কৃষি, শিল্প, বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনা। শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মেধাবী মানুষদের বিচরণ। শুধু সব ক্ষেত্রের সঠিক ব্যবহারে রয়েছে সংকট। এসব সংকটের অনুঘটক নষ্ট রাজনীতি। রাজনীতি অতি বেশি ক্ষমতাকেন্দ্রিক হয়ে পড়ায় কঠোর দলীয়বৃত্তে বন্দি হয়ে গেছে। ফলে দলীয় পরিচয় ছাড়া মেধাবীরা যোগ্য স্থান পান না। একটি সম্ভাবনাকে অবহেলায় নষ্ট করে দেওয়ার জন্য এর চেয়ে বড় দায় আর কিছু হতে পারে না। বাচনিক ক্ষেত্রে এ দেশ যদিও বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ধারায় চলছে বলে প্রচারিত। তবে কার্যত দ্বিদলীয় ধারায়ই যেন আটকে আছে। এর মধ্যে দুর্বল নেতৃত্ব ও কৃতকর্মের কারণে বিএনপি অনেকটা বিপন্ন দশায়। গণতান্ত্রিক গতিধারা ধরে রাখতে বা প্রতিষ্ঠা করতে এ অবস্থা ভীষণ ক্ষতিকর। নতুন বছরে বিএনপি নতুন প্রত্যয় নিয়ে যে ইতিবাচক রাজনীতির ধারায় ফিরে আসবে, সে ব্যাপারে আমরা আশাবাদী থাকতে চাই। জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে বিএনপির ক্ষতির পাল্লা যে ভারী হয়েছে, তা নেতারা বুঝতে পারছেন কি না এখনো স্পষ্ট নয়। নতুন বছরে ভারসাম্যমূলক যে রাজনীতির প্রত্যাশা আমরা করছিলাম, সে জায়গায় একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন রয়েই গেল। আশা করব, আমাদের রাজনীতি ইতিবাচক পথে হাঁটার নিশানা পেয়ে যাবে।
নতুন বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে মানুষের অনেক প্রত্যাশা। বিরোধী দলের নেতিবাচক রাজনীতি আওয়ামী লীগের হাতে সুবিধার বল এনে দিয়েছিল। এর সঙ্গে রাজনৈতিক কৌশল ব্যবহার করে সরকারি দলটি পায়ের নিচে শক্ত মাটি তৈরি করতে পেরেছে। এ অবস্থার সুবিধা ও প্রণোদনা নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার যদি নতুন বছরটিতে অন্ধ দলীয়করণ থেকে বেরিয়ে এসে সর্বজনীনতা তৈরি করতে পারে এবং উন্নয়ন কার্যক্রমে বন্ধু বাড়াতে পারে, যোগ্য মেধাবীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাতে পারে, তবে আমরা এই নতুন বছরটিকে নিয়ে অনেক বেশি আশাবাদী হতে পারি। কিন্তু আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে, বিরোধী দলকে দুর্বল করে দিয়ে আওয়ামী লীগ আরো বেশি কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠে কি না! এই একই প্রশ্নে বিএনপিকেও নতুন বছরে বাস্তবতার উঠোনে এসে দলকে আরো বেশি সংগঠিত করে তুলতে হবে। হাঁটতে হবে ইতিবাচক রাজনীতির পথে।
ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রটিকে তমসাচ্ছন্ন করে তুলছে। দলীয় দৃষ্টিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই মেধার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। শিক্ষার মানের সূচক নিম্নগামী হচ্ছে। ছাত্রলীগের উন্মত্ততাকে প্রশমিত করতে পারছে না নিয়ন্ত্রক দল। এই বাস্তবতা ক্যাম্পাসে বিরাজ করলে শিক্ষা গবেষণার ক্ষেত্র বিকাশের ধারা বারবার ব্যাহত হবে। আমরা আশা করব, নতুন বছরটিতে বিধায়কগণ এই বাস্তবতা অনুভব করবেন। এটি তো সত্য, শিক্ষা গবেষণাকে দুর্বল রেখে কোনো উন্নয়নের সূচককেই এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। রাজনীতির ময়দানে আওয়ামী লীগ সরকারের এখন যে দৃঢ় অবস্থান, তাতে ইতিবাচক রাজনীতির ধারা তৈরির জন্য সময়টিকে মোক্ষম মনে করা যেতে পারে। দলীয় রাজনীতিকে পাশে ঠেলে দিয়ে হল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ তৈরি করার মধ্য দিয়ে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির অন্ধকার অধ্যায়ের অবসান ঘটানোর একটি সুযোগ তৈরি হতে পারে। শিক্ষক রাজনীতি, উপাচার্য নিয়োগ এসব ক্ষেত্র সরকারি নিয়ন্ত্রণ বিচ্ছিন্ন করতে পারলে আবার উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে নিশ্চয় নতুন জোয়ার তৈরি হবে। এমন বিজয় হলে তা হবে রাজনীতিরই বিজয়।
আমরা আশা করব, নতুন বছরের শুরু থেকে সংশ্লিষ্টজনরা শপথ নেবেন দলীয় রাজনীতির বন্দিত্ববরণ না করে দেশকে, মানুষকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব পালন করবেন তাঁরা। নতুন বছরে আমরা চাই, পেছনের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতে। যে অতীত আমাদের সামনে এগোতে পথ দেখায় না। হতাশার ঘোর অমানিশা নামায়, সেদিকে না তাকানোই উত্তম। আমরা নতুন বছরের শুরুতে আলোকিত দিন পেতে চাই। গড়তে চাই আলোক-সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ। আর এসব সম্ভাবনাকে বাস্তব করে তুলতে পারে একমাত্র সুস্থ ও দেশপ্রেমিক রাজনীতি। নতুন বছরে আমরা আশা করব, আমাদের রাজনীতি অঞ্চলের বিধায়করা ক্ষমতান্ধ না হয়ে মানুষের জন্য রাজনীতি করার পথে হাঁটবেন।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।