ভূমিকম্প
ঘুমটা সত্যিই ভাঙুক
হয়তো এ যাত্রা বেঁচে গেছি এবং আপনিও বেঁচে গেছেন। ঘনবসতি, দূষণ, নাগরিক সুযোগ-সুবিধার অভাব আর নিরাপত্তাহীনতার বিচারে ঢাকাকে বরাবরই পৃথিবীর অন্যতম বসবাস অযোগ্য শহরের তালিকায় রাখা হয়। কিন্তু নানা দুর্যোগ-দুর্বিপাকেও যে এই নগরী অত্যন্ত ঝুঁকিতে রয়েছে, সেটি আমরা মাঝেমধ্যে ভূমিকম্প নাড়া দিয়ে গেলে টের পাই।
ঝড়-বন্যার মতো আগাম সতর্কসংকেতের ব্যবস্থা এখনো হয়নি ভূমিকম্পের বেলায়। অনেক দিন ধরেই বিজ্ঞানীরা এ নিয়ে কাজ করছেন। তবে এখনো সেই অর্থে আশার বাণী শোনানো সম্ভব হয়নি। ফলে ভূমিকম্পের মতো সর্বব্যাপী দুর্যোগ নিয়ে আপাতত ভয়ে থাকা এবং ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতা নিয়েই আমাদের চিন্তাভাবনা।
সোমবার ভোররাতে যখন ভারতের মণিপুরে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্প নাড়া দেয় আমাদের দেশেও, তখন অধিকাংশ মানুষই গভীর ঘুমে। যাঁরা ফজরের নামাজ পড়তে ওঠেন, তাঁরাও ঘুমে। কেননা, ঘটনাটি ঘটেছে ফজরের আজানেরও কিছু আগে।
তার মানে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল যদি ভারতের মণিপুর না হয়ে আমাদের দেশের কোথাও, বিশেষ করে ঢাকার কাছে মধুপুর ফল্টে হতো, তাহলে সোমবার ভোররাতের ওই ঘুম দেশের হাজার হাজার মানুষের শেষ ঘুম হতো, তাতে সন্দেহ নেই।
ভূমিকম্প-বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ঢাকার আশপাশের কোথাও যদি ৬ মাত্রাও ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল হয়, তাহলে বছরের পর বছর অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এই নগরীতে কত হাজার মানুষের প্রাণহানি হলো, তা লিপিবদ্ধ করার মতো মানুষও হয়তো এখানে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এ আশঙ্কার কারণ মানুষের লোভ, সংকীর্ণতা আর অসচেতনতা। বছরের পর বছর ধরে যেসব বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে এই মহানগরীতে, তার কত শতাংশ ভূমিকম্প ঝুঁকি মেনে, অর্থাৎ একটু বাড়তি রড ও নকশায় সঠিক প্রকৌশল জ্ঞান কাজে লাগানো হয়েছে, তা সত্যি অনুসন্ধান করলে খুব হতাশাজনক চিত্র বেরিয়ে আসবে।
ভূমিকম্প-বিশেষজ্ঞরা নানা সময়েই বলেছেন এবং এখনো বলে থাকেন যে একটি ভবন নির্মাণে যে পয়সা খরচ হয়, সেখাকে অল্প কিছু বাড়তি খরচ করলেই ভবনটিকে ভূমিকম্প-সহনীয় করে গড়ে তোলা সম্ভব। কিন্তু তার পরও বড় ভূমিকম্পে সেসব ভবন টিকে থাকবে কি না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে ঝুঁকি অনেকটা কমবে।
ঢাকার সবচেয়ে বড় ঝুঁকি তৈরি করেছেন একশ্রেণির লোভী ও অসাধু আবাসন ব্যবসায়ী, যাঁরা বালু দিয়ে জলাশয় ভরাট করে প্রয়োজনীয় পাইলিং এবং বহুতল ভবন নির্মাণে বিজ্ঞান ও প্রকৌশল উপেক্ষা করে রাতারাতি গড়ে তুলেছেন শত শত ভবন। কেননা, ওই সব ভবনে আবাসন ব্যবসায়ীরা থাকেন না। তারা ভবন খাড়া করে হয় বিক্রি করে দেন অথবা ভাড়া দেন। সুতরাং সেই ভবন চাপা পড়ে মানুষ মারা গেলে তাঁদের কিছু যায়-আসে না।
ভূমিকম্পে ঢাকার আরেকটি বড় ঝুঁকি তৈরি করেছে এই নগরীর অপ্রশস্ত আর অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট, গ্যাস ও পানির লাইনের সমন্বয়হীনতা। কেননা, বড় ভূমিকম্পের পরে প্রথমেই ত্রুটিপূর্ণ গ্যাসলাইন ফেটে যে আগুন ধরে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে, তা নেভানোর মতো সক্ষমতা ফায়ার সার্ভিসের আছে কি না, তা আমাদের জানা নেই। তা ছাড়া সরু রাস্তার ওপর অপরিকল্পিত ভবনগুলোর কংক্রিট এমনভাবে স্তূপ হয়ে পড়ে থাকবে যে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঘটনাস্থলে যেতেই পারবে না। ফলে ঢাকার আশপাশে বড় ভূমিকম্পের অর্থই হলো তিলোত্তমা এই নগরী হবে মৃত্যুপুরী।
তবে কিছুটা আশার কথা, ভূমিকম্পে চট্টগ্রাম, সিলেট ও উত্তরবঙ্গ যতটা ঝুঁকিতে, ঢাকার ঝুঁকি সে তুলনায় কম। কিন্তু প্রকৃতির খেয়াল বোঝা কঠিন। সেই খেয়ালে কখনো এই নগরীতে যদি সত্যিই এমন দুর্বিপাক নেমে আসে, তখন প্রায় দুই কোটি মানুষের এই জনপদে দুর্গতের পাশে দাঁড়ানো মানুষ খুঁজে পাওয়াই কঠিন হবে।
তাহলে আমরা কী করব?
ভূমিকম্প-বিশেষজ্ঞরা যে ধরনের নিয়ম মেনে ভবন তৈরির পরামর্শ দিয়ে আসছেন, তা ভবন মালিকরা মানছেন কি না, তা তদারকিতে নির্মোহ এবং সততার পরিচয় দিতে হবে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তাদের। যাঁরা মানছেন না, তাঁদের নিয়ম মানতে বাধ্য করতে হবে।
পয়সা খেয়ে ভবনের নকশা অনুমোদন দেওয়ার ভয়ানক অসুখ সারাতে হবে। সে ক্ষেত্রে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) দুর্নীতি যথাসম্ভব কমিয়ে আনার বিকল্প নেই।
বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে তিতাসের গ্যাসলাইন আর ওয়াসার পানির লাইনগুলো আধুনিক করে গড়ে তোলা এবং যত দ্রুত সম্ভব এগুলোকে ত্রুটিমুক্ত করা জরুরি।
ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো সংস্কারে মালিকদের বাধ্য করা এবং সেখানে যাতে কেউ না থাকেন, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি বাড়াতে হবে।
ঢাকা শহরে বড় খোলা জায়গা বলতে দু-তিনটি স্টেডিয়াম ছাড়া আর কিছু নেই। এ রকম খোলা জায়গা বা ওপেন স্পেস ক্রমে চলে যাচ্ছে বহুতল ভবনের পেটে। সুতরাং প্রতিটি এলাকায় মধ্যম আকারের কিছু খোলা জায়গা বা ওপেন স্পেস তৈরি করা যায় কি না, সে বিষয়ে সিটি মেয়ররা এলাকাভিত্তিক আলোচনা শুরু করতে পারেন এখনই। কেননা, ভূমিকম্প আঘাত হানলে এই খোলা জায়গাগুলো হতে পারে মানুষের দাঁড়ানোর জায়গা। অতএব, মণিপুরের ভূকম্পনে সোমবার ভোররাতে আমাদের আচমকা যে ঘুম ভেঙেছে, এই ঘুম এবার সত্যি সত্যি ভাঙুক।
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।