বেতন কাঠামো
কে বড়, গুরু না শিষ্য?
অষ্টম বেতন কাঠামো ঘোষণার পর থেকেই গ্রেডে মর্যাদার অবনমন এবং টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করছেন শিক্ষকরা। বেতন কাঠামো এবং পদবৈষম্য নিয়ে শিক্ষকদের দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা আন্দোলন নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলছেন। যদিও এখন আমাদের সমাজে কোনো বিষয়ে মন্তব্য করা কিংবা সমালোচনা করার বেলাতেও আগে নিজের স্বার্থের বিষয়টি সবাই মাথায় রাখে, আলোচ্য বিষয়ের সত্যিকারের গুরুত্ব নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। এখন পক্ষ একটাই, হয় তুমি আমার পক্ষে নাহলে গাদ্দার।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা তাদের পদমর্যাদা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এমন সব মন্তব্য শুনতে বাধ্য হচ্ছেন যা দেখে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কোনো ছেলেমেয়ের ইচ্ছে হবে না এই পেশাতে আসার।শিক্ষকতা পেশা সম্পর্কে যার ন্যূনতম কোনো ধারণা নেই তাঁরাও ঢালাওভাবে শিক্ষকদের নিয়ে বাজে মন্তব্য করতে ছাড়ছেন না।কিন্তু শিক্ষকদের পদমর্যাদা নিয়ে তাদের এই আন্দোলন কি আসলেই অযৌক্তিক?
সম্প্রতি সরকার বেতন কাঠামো পরিবর্তনসহ পদমর্যাদার যে বিশাল পরিবর্তন এনেছে তাতে বোঝা যায় সরকারের আমলাদের ইচ্ছের প্রতিফলনই পড়েছে সেই কাঠামোতে। ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা পদমর্যাদায় সচিবদের দুই গ্রেড নিচে থাকবেন।
স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষক সমাজের কাছে বিষয়টি অনেক বেশি মানহানিকর লেগেছে। এ নিয়ে তাঁরা অর্থমন্ত্রীর সাথে কথা বলেছেন, তাদের দাবির বিষয়টি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কর্মসূচির মাধ্যমে জানান দিচ্ছেন।যদিও অর্থমন্ত্রী শিক্ষকদের সাথে আলোচনায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সপ্তম বেতন স্কেলে বিদ্যমান সুযোগ সুবিধা না কমিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বহাল রাখা, সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত অধ্যাপকদের মধ্যে থেকে একটি অংশকে সিনিয়র সচিবদের জন্য সৃষ্ট সুপার গ্রেডে উন্নীত করা এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রারম্ভিক বেতন সপ্তম গ্রেডে সম্ভব না হলে অষ্টম গ্রেড থেকে শুরু করা।যদিও অর্থমন্ত্রী এখন তাঁর প্রতিশ্রুতির বিষয়টি ভুলে গিয়ে শিক্ষকদের আন্দোলনকে অযৌক্তিক দাবি করছেন। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন শিক্ষকদের দাবি অজ্ঞতাপ্রসূত। বেতনস্কেল পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই।এখানেই শেষ নয়।
অর্থমন্ত্রী শিক্ষকদের ৯টা ৫টা অফিস করার পরামর্শ দিয়েছেন এবং সরকারি আমলাদের মতোই শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়টি দেখা হবে বলে জানিয়েছেন। বোঝাই যাচ্ছে সরকারের বেতন কাঠামো এবং পদমর্যাদার এই যে বিশাল পরিবর্তন তাতে সরকারি আমলারা কতটা হস্তক্ষেপ করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ এই বিষয়ে মন্তব্য করেছেন এভাবে, ‘পে স্কেল নিয়ে জটিলতা সরকারের আমলাতান্ত্রিক ব্যর্থতা। ক্যাডার ও নন ক্যাডারদের মধ্যে একটি বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। বেতন কাঠামো নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই।পদবষৈম্যই মূল সংকট। আমলারা ক্যাডার স্তরে নিজেদের ঠিক রেখে ননক্যাডারদের কিছুটা নিচে রাখার চেষ্টা করেছেন। সচিব পর্যায়েই এ বৈষম্য তৈরি করতে ভূমিকা রেখেছেন।’
ইব্রাহীম খালেদের এই মন্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, সরকারি আমলাদের মারপ্যাচের হাতে বন্দী সরকার। আসলে রাজনীতিবিদরা যত জাদরেলই হোন না কেন, সরকারি আমলাদের কূটচালের হাতে তাঁরাও বন্দী। যখন যে সরকার ক্ষমতায় তার আস্থাভাজন হয়ে একজন মন্ত্রী এমপির চেয়েও বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত তাঁরা। সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে প্রশাসনে তাঁরা ঢোকেন, দলীয় রাজনীতিতে তাঁরা অংশ নিতে পারবেন না এই শপথ নিয়ে আর সারাটা জীবন তাঁদের দায়িত্ব কর্তব্য কতটুকু পালন করেন, কিন্তু এর ব্যত্যয় ঘটতে দেখা যায়।
শিক্ষকদের আন্দোলন নিয়ে সবচেয়ে বেশি তীর্যক কথার ফুলঝুরি ছড়াচ্ছেন এই আমলারাই। তাঁদের দাবি, শিক্ষকরা পেশাজীবী রাজনীতির ব্যানারে তাঁদের দায়িত্বে অবহেলা করেন বেশি। কথাটা মিথ্যা নয়। বরং বিগত সময়গুলোতে যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে তাদের পক্ষে সুযোগসুবিধাভুক্ত শিক্ষক সম্প্রদায় মাঠে নেমে পড়েছে।কিন্তু সেই গুটিকয়েক (যদিও এখন সময়ের প্রেক্ষাপটে শিক্ষকরা বাধ্য হচ্ছেন নির্দিষ্ট ব্যানারে নিজেদের তালিকাভুক্ত করতে)শিক্ষকদের জন্য তামাম শিক্ষক সম্প্রদায়কে কালিমা লেপন কি সঠিক?
তা ছাড়া কাগজে কলমেই তাঁদের পেশাজীবী রাজনীতি করার সুযোগ আছে।কারণ ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী শিক্ষকদের রাজনীতিতে বাধা নেই। আর আজ কি শুধু পেশাজীবীর ব্যানারে শিক্ষকরাই রাজনীতি করছেন? কোন্ পেশার মানুষটি আজ রাজনীতিমুক্ত?এই শিক্ষকরাই সেদিন ছাত্রদের সংগঠিত করতে পেরেছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহস জুগিয়েছিলেন। তাঁরাই অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিয়ে মুক্ত দেশের স্বপ্ন বপন করে দিয়েছিলেন হাজারো শিক্ষার্থীর অন্তরে। অবশ্যই আমরা মুক্তিযুদ্ধ সময়ের আগে এবং পরের শিক্ষক সমাজের সাথে এখানকার সময়ের রাজনীতির তুলনা করলে তাতে সেই শিক্ষকদের অপমান করা হবে। কিন্তু এখনকার শিক্ষকরা বাধ্য হয়েই রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন, সেটা স্বার্থে হোক, নিজের ইচ্ছের তাগিদেই হোক।কিন্তু তাই বলে কি সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলার সাহসী শিক্ষক আমাদের মধ্যে একেবারেই নেই? অবশ্যই তাঁরা আছেন। আর আছেন বলেই এখনো দেশ সব বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে পারছে। হাজারো প্রতিকূলতা হাজারো সীমাবদ্ধতার বেড়াজাল টপকে এই শিক্ষকদের হাত ধরেই অসংখ্য শিক্ষার্থী দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করছেন। তাঁদের ছোট করে দেখার মতো ধৃষ্টতা আসলে আমাদের না দেখানোই ভালো।
অনেকের মনেই এখন একটি প্রশ্ন, এই সচিবরা দেশের কি এমন মহান দায়িত্ব পালন করছেন, যাতে তাঁরা নিজেদের এমন সুপেরিয়র ভাবছেন? যে শিক্ষকদের হাত ধরে তাঁরা শিক্ষাজীবন পার করে আমলা হলেন কি এমন জাদুবলে তাঁরা এত বিশেষ হয়ে উঠলেন যে তাঁরা যোগ্যতায় তাঁদের গুরুকেও ছাড়িয়ে গেলেন? একেই বলে গুরুমারা বিদ্যা!
শিক্ষামন্ত্রী প্রতিবছরই বলেন, প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বাড়ানো হবে। সরকারি স্কুল কলেজগুলোর শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি বারবার দিলেও তেমন কোনো পরিবর্তন এখনো চোখে পড়েনি। বেতন বাড়ানোর দাবি নিয়ে শিক্ষকরা পথে নামলে তাদের মরিচের গুঁড়ার স্প্রে দিয়ে তাড়ানোর মতো ধৃষ্টতা দেখিয়েছে প্রশাসন। হায়রে অভাগা শিক্ষক! ঘরে ঠিকমতো চুলা জ্বলে কি না তার খবর নেওয়ার কেউ নেই। সরকারের নতুন বেতনকাঠামোর ধাক্কায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।ফলে শুধু শিক্ষকরাই নন, দেশের কোটি কোটি মানুষের ভোগান্তি নিয়ে সরকারের মধ্যে কোনো উচ্চবাচ্য নেই।
স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা একটু সম্মানজনক বেতন পান। তাঁদের জীবনযাপন অনেকটাই উন্নত। তাঁদের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ, শিক্ষকরা ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সময় দেন না, বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের কাতারে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় নাম লেখাতে পারেন না শিক্ষকদের অবহেলার কারণে। সত্যিই কি পুরো দায় শিক্ষকদের? দেশে ফিবছর বিশাল বাজেট বরাদ্দ করেন অর্থমন্ত্রী, কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে বাজেটের পরিমাণ এখনো কিন্তু নগণ্যই। শিক্ষকদের বেতন কাঠামো যদি ঠিক না করা হয়, তাহলে কোনো ভালো মেধাবী শিক্ষার্থীই আর আগ্রহ পাবেন না শিক্ষকতা পেশায় আসার।বিশেষ করে নিজেদের সম্মানের বিষয়ে শিক্ষকদের যৌক্তিক আন্দোলনকে নিয়ে যারা নোংরা রাজনীতি করছে তাদের আরো উসকে দিচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি শিক্ষকদের নিয়ে মাঝেমধ্যেই এমন সব মন্তব্য করছেন যাতে বোঝাই যাচ্ছে যতই ক্ষমতাধর হোন না কেন, শিক্ষকদের ভয় পান রাজনীতিবিদরা। তাই শিক্ষকদের পদমর্যাদা কমিয়ে তাঁদের সরকারের কর্মচারীদের মতোই রাজনীতিবিদদের হাতের পুতুল করে রাখতে চাইছেন তাঁরা।
নিশ্চয়ই সরকারের বোধোদয় হবে।শিক্ষকদের পদমর্যাদা তারা ফিরিয়ে দেবে। কাউকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করার ফল কখনো ভাল হয় না। যত তাড়াতাড়ি সরকার বিষয়টি বুঝবে ততই তাঁদের জন্য মঙ্গল।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ