বাকস্বাধীনতা
সাতান্নর পর এবার ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে ঢের কথা হয়েছে। সংবিধানের ৩৯ ধারার সঙ্গে এই ধারা সাংঘর্ষিক—এমন দাবি করে আইনটি হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জও করা হয়েছে। তার পরও সরকারের তরফে বারবারই বলা হচ্ছিল, সাইবার অপরাধ দমনে আরো একটি আইন হচ্ছে, যার নাম ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন।
আইনটির খসড়া হয়ে গেছে বেশ কিছুদিন আগেই। তবে এ খসড়ায় অপরাধের জন্য কোনো সাজার পরিমাণ নির্ধারিত ছিল না। অর্থাৎ বিচারক অপরাধের মাত্রা বিবেচনা করে সাজা নির্ধারণ করতে পারবেন—এমন বিধান ছিল। কিন্তু এটি নিয়েও নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে যে যদি অপরাধের মাত্রা বিবেচনায় নিয়ে বিচারক শাস্তি নির্ধারণ করেন, তাহলে সবার ক্ষেত্রে একই অপরাধের সাজা সমান নাও হতে পারে। এখানে বিচারকের পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ অবস্থায় ১০ জানুয়ারি এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের খসড়ায় সংশোধনী আসবে, যেখানে অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা হবে ১৪ বছর কারাদণ্ড।’ আইনমন্ত্রী আশ্বস্ত করেন, তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ নম্বরসহ কয়েকটি ধারা বাদ দিয়ে সেগুলো আরো স্পষ্ট করে নতুন এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যুক্ত করা হবে। তিনি বলেন, ‘যখন এই আইন পাস হবে, তখন হয়তো আইসিটি অ্যাক্ট থেকে ৫৪, ৫৫, ৫৬ ও ৫৭ ধারা রিপিল (বাতিল) করে এ আইনের আওতায় নিয়ে নেওয়া হবে, যাতে দ্বৈধতা সৃষ্টি না হয়।’ এমনকি নতুন আইন হওয়ার ফলে ৫৭ ধারা নিয়ে বিতর্কের অবসান হবে বলেও আশ্বস্ত করেন আনিসুল হক।
এর আগে গত বছরের ১৯ নভেম্বর জাতীয় সংসদে তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেছিলেন, ‘দেশে অর্থনৈতিক লেনদেনে ইলেকট্রনিক ট্রানজেকশন খুব দ্রুত বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে অপরাধও হচ্ছে। তাই এসব অপরাধ তদন্ত করা, তদন্ত শেষে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা এবং অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনার জন্যই ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট করা হচ্ছে।’ তিনি জানান, সরকার ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব করবে, যার মাধ্যমে অপরাধীদের শনাক্ত করা সহজ হবে।
কিন্তু আশঙ্কার বিষয় হলো, সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ তথা দমনের নামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগও আমরা সম্প্রতি দেখেছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ে কাজ করেন এমন অনেকে মনে করেন, মূলধারার গণমাধ্যম যখন রাষ্ট্রীয় নানা গণবিরোধী সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগের বিরুদ্ধে চুপ থাকে বা থাকতে বাধ্য হয়, তখন ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সোচ্চার হয়ে ওঠে; তখন প্রতিবাদের সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠে ফেসবুক। ফলে রাষ্ট্রযন্ত্র সব সময়ই এই বিকল্প মাধ্যমকে ‘ভয়’ পায় এবং সে কারণেই এই মাধ্যমকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়।
সুতরাং সাইবার অপরাধ দমনে আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য এবং সেটি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্যও জরুরি। অশুভ উদ্দেশ্যে কম্পিউটারের তথ্য নষ্ট করা, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া তথ্য পাচার করা, অন্যের কম্পিউটার ব্যবস্থায় অনধিকার প্রবেশ, অশ্লীল বা মানহানিকর তথ্য, ছবি প্রকাশ বা কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয় ইত্যাদি অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু অনেক সময়ই আইনে অপরাধের সংজ্ঞা পরিষ্কার থাকে না, যে কারণে লঘু পাপে গুরুদণ্ড পেতে হয় অনেককে। আবার বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তারের সুযোগ রাখা এবং আসামির জামিন না পাওয়ার মতো বিষয়গুলো এরই মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি আইনকে একটি ‘কালাকানুনে’পরিণত করেছে।
সুতরাং সাইবার অপরাধ দমনে যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হচ্ছে, সেখানে এই নিশ্চয়তাও থাকতে হবে যে এ আইনে নাগরিকরা হয়রানির শিকার হবে না। এ আইন বাকস্বাধীনতার কণ্ঠরোধ করবে না।
ডিজিটাল সিকিউরিটির নামে এ আইন ভিন্নমত বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হবে না।
আর এসব নিশ্চিত করার জন্য আইনটিতে রাষ্ট্রপতির সই হওয়ার পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে এর একটি বিধিমালা করতে হবে, যেখানে আইনের প্রয়োগ, অপরাধের ব্যাখ্যা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এখতিয়ার, বাকস্বাধীনতা ও তার সীমানা ইত্যাদি অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে উল্লেখ থাকবে। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার মতো যেকোনো লেখাকে কারো সম্মানহানি বা ধর্মীয় উসকানি হিসেবে চালিয়ে দিয়ে আটকের মতো ভয়াবহ পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয়, সে জন্য আইনে নাগরিকের পর্যাপ্ত রক্ষাকবচ থাকতে হবে। আইনের প্রতি মানুষের ভয় নয়, বরং যাতে শ্রদ্ধা তৈরি হয়, সেভাবে আইন করতে হবে।
নইলে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বা তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার মতো বিধানের ভয়ে নাগরিকরা তটস্থ থাকবে এবং ভেতরে ভেতরে একটা ভয়ের সংস্কৃতি জারি থাকবে, যা কোনো অর্থেই গণতান্ত্রিক এবং মুক্ত সমাজ গঠনের অনুকূল নয়।
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর