সোজা কথা
রক্ষক যেন ভক্ষক না হয়
‘জামিল সাহেব দারোগা হয়ে চাকরিতে ঢুকেছিলেন, ডিআইজি হয়ে রিটায়ার করেছেন। সারদা পুলিশ একাডেমিতে ট্রেনিং নিতে যাওয়ার আগের দিন তাঁর বাবা নবীগঞ্জ হাইস্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার জামিলকে তাঁর মায়ের কবরের কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, তুমি তোমার মায়ের কবর ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করো যে চাকরি জীবন সৎপথে কাটাবে। এমন চাকরিতে ঢুকছো যেখানে সৎ থাকা খুবই কঠিন। জামিল সাহেব প্রতিজ্ঞা করলেন। এই প্রতিজ্ঞা রিটায়ার করার দিন পর্যন্ত বহাল রেখেছেন।’ জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের গল্পে এমন সৎ পুলিশ অফিসারের কথা আমরা পড়েছি। কিন্তু বাস্তবে কি এমন পুলিশের দেখা মেলে?
জানি না, আজ হুমায়ুন আহমেদ বেঁচে থাকলে কী লিখতেন! এসআই মাসুদ, আকাশ রাসেল এঁদের দুর্ভাগ্য হুমায়ূন আহমেদ বেচেঁ নেই। তাহলে তাঁর লেখনীতে কিংবদন্তি হয়ে থাকতেন এই বীর পুলিশেরা! গত ৯ জানুয়ারি রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক গোলাম রাব্বী বাসায় ফিরছিলেন। হঠাৎ পেছন থেকে কলার ধরে রাব্বীকে পুলিশের ভ্যানে তোলেন মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মাসুদ শিকদারসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য। এরপর রাত ৩টা পর্যন্ত মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন রাস্তায় ঘুরে ঘুরে রাব্বীকে মারতে থাকে পুলিশ। তাঁকে ইয়াবা ব্যবসায়ী, সেবনকারী বানানোর ভয় দেখিয়ে পাঁচ লাখ টাকা আদায়ের চেষ্টা করে তারা। রাব্বী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, মিডিয়াকর্মী এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা এমন নানা পরিচয় পেয়ে আরো ঘাবড়ে যায় পুলিশ, তাঁকে মেরে ফেলার জন্য বেড়িবাঁধেও নিয়ে যায় তারা। রাব্বীর ভাগ্য কিংবা এসআই মাসুদ শিকদারের দুর্ভাগ্যই বলি, শেষ পর্যন্ত রাব্বী বেচেঁ গেলেন। কিন্তু রাব্বীর মনের ওপর যে নির্যাতনের ছাপ ফেললেন জনগণের সেবক পুলিশ, সেই ক্ষত সারবার নয়।
রাব্বীর ঘটনা সারা দেশের মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে, তাহলে আমরা কার কাছে যাব? মানুষ বিপদে পড়লে থানায় ছুটে যাবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু থানাই এখন বড় আতঙ্ক। রাব্বীর ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে পার পাওয়া যেত কিন্তু ১৫ জানুয়ারি ভোর ৪টার সময় মীর হাজিরবাগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা বিকাশ দাসের ঘটনার পর আর কী বলা যায়? বিকাশ তাঁর কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার পথে সাদা পোশাকধারী চার পুলিশ সদস্যের হাতে বেধড়ক মার খান। রাব্বীর মতো বিকাশও তাঁর পরিচয় দেওয়ার পরও মারের হাত থেকে বাঁচতে পারেননি। পরপর দুটি ঘটনা ঘটার পর পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হলো, এ ধরনের ঘটনায় পুরো প্রশাসনকে দোষ দেওয়া যাবে না, দায় শুধু দোষী ব্যক্তির। কিন্তু পুলিশ প্রশাসনে বড় কর্তারা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন, এ ধরনের ঘটনা তাঁদের চোখের আড়ালে ঘটছে না? রাব্বী বা বিকাশের ঘটনা ফেসবুকের কল্যাণে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় আমরা জানতে পেরেছি কিন্তু এ ধরনের ঘটনা তো প্রতিদিনই ঘটছে। কত সাধারণ মানুষ পুলিশের হাতে হেনস্তা হচ্ছেন, তার হিসাব নেই। নীরবে সব হজম করে যায় ভুক্তভোগীরা কারণ কোথায় কার কাছে নালিশ করবেন তারা? থানায় পুলিশের বিরুদ্ধে নালিশ করবেন? রাব্বীর মামলাই যেখানে পুলিশ নিতে চায়নি সেখানে সাধারণ খেটে খাওয়া আমজনতা কোন সাহসে যাবে? মজার বিষয় হলো, এখন সাধারণ মানুষ পুলিশের কাছে কিংবা সন্ত্রাসীদের কাছে হেনস্তা হলে আর থানায় যায় না, আসে সংবাদমাধ্যমগুলোর কাছে। আমার কর্মস্থল এটিএন নিউজে প্রতিদিন কত অসংখ্য মানুষ আসে, যারা হয়তো এলাকার কোনো সন্ত্রাসীর কাছে জিম্মি, কোনো প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। আমরা তাদের থানায় যাওয়ার কথা বললে তাদের একটাই কথা, থানাও এর সঙ্গে জড়িত। পুলিশ প্রশাসনের যদি এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র কোনো সন্দেহ থাকে, তবে আসুন আপনারা দেখে যান আপনারা সেবক হয়ে কতটা ত্রাস সৃষ্টি করেছেন আপনাদের জনগণের কাছে।
গণমাধ্যমের কর্মী আমরা, আমরাও আপনাদের হাতে কতভাবে নির্যাতিত হই, আপনাদের ক্ষমতার দাপট দেখি। অনেক সময়ই আমাদের করার কিছু থাকে না। বড় অসহায় লাগে নিজেদের তখন। তবে সবকিছু ছাপিয়ে একটা বিষয় খুব বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ ধরনের ঘটনায় লজ্জিত হওয়ার বদলে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টায় রত। তার ওপর এখন তো পুলিশ সদস্যদের দেশের বাড়ির কোথায় তার ওপর নির্ভর করে কে কতটা ক্ষমতাবান। দীর্ঘদিন ধরেই পুলিশ বিভাগের জবাবদিহিতায় শৈথিল্য দেখা যাচ্ছে। পুলিশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভুরি ভুরি অভিযোগ থাকলেও জনমনে আস্থা সৃষ্টি করার উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। গণমাধ্যমে কোনো ঘটনা নিয়ে হৈচৈ হলে বড়জোরে ওই পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়। এটাই সবচেয়ে বড় শাস্তি এখন পর্যন্ত। পহেলা বৈশাখে নারী নিগ্রহের ঘটনায় নিষ্ক্রিয় তিন পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল। পরে ঘটনাটি যখন অন্যান্য ঘটনার আড়ালে চাপা পড়ে যায়, তখন তাদের স্বাভাবিক নিয়মে বদলি করা হয়। পুলিশের এই রেওয়াজ থেকে বেরিয়ে আসার সময় হয়েছে। এখনো যদি তারা না শোধরান তাহলে মানুষের ক্ষোভ বেড়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীকে নিয়ে বরাবরই দুর্নীতি আর ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ ছিল কিন্তু এখন যেন সবকিছুরই মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। রাস্তাঘাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সবখানেই সন্ত্রাসীরা যেমন চাঁদা আদায় করে, তেমন অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধেও। অবৈধ দোকানপাট, অবৈধ ব্যবসা সবকিছুতেই পুলিশকে ভাগ না দিয়ে চলার নাকি উপায় নেই। এখন তো তারা ছিনতাইকারীরের মতো রাস্তায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে জনমানুষকে হেনস্তা করে। নিরাপত্তার নামে রাস্তায় রাস্তায় যে চেকপোস্ট বসেছে, সেগুলো যেন চাঁদা তোলার স্পটে পরিণত হয়েছে। মোটরসাইকেল, গাড়ি ইত্যাদির কাগজপত্র চেকিংয়ের নামে চলে বাণিজ্য। এসব অজস্র অভিযোগের কথা সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে মিডিয়াকর্মীরা জানেন। সিএনজিচালকরা তো ট্রাফিক পুলিশদের বখরা দিয়ে চলে আর এর ফল ভোগ করে আমজনতা। সব জায়গাতেই দুর্নীতি আছে কিন্তু এমন নির্লজ্জ কাজ বিশ্বের আর কোনো পুলিশ বাহিনীর আছে কি না, আমার জানা নেই।
তাহলে কি আমরা ধরে নেব পুরো প্রশাসনটাই এমন? নিশ্চয়ই নয়। কারণ যে সময়টাতে রাব্বী আর বিকাশের ঘটনায় সারা দেশে ছি! ছি! পড়ে গেছে, বেরিয়ে আসছে পুলিশের আরো নানা কাহিনী, সে সময়ই কিন্তু পত্রিকায় এই খবরগুলোর পাশাপাশি ছোট্ট করে আরেকটি খবর ছেপেছে। পাবনা জেলার শ্রেষ্ঠ এসআই হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন ঈশ্বরদী থানার এসআই আবদুর রহিম। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিল, আসামি গ্রেপ্তার, মাদকদ্রব্য উদ্ধারসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য তাঁকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। তার মানে এই প্রশাসনে সৎ মানুষ আছেন, যাঁরা নিজের পদটার সম্মান দিতে চান। নিজের পরিবারকে সম্মানের সঙ্গ মাথা উঁচু করে চলার সাহস জোগাতে চান। আবদুর রহিমের মতো সৎ, ভালো মানুষ পুলিশ সদস্য কিন্তু অনেক আছেন। সেদিন আমার এক সহকর্মী বললেন এমন এক এসআইয়ের কথা। আমার সহকর্মী আসছিলেন সদরঘাট থেকে, সেখানে প্রচুর যানজট। সঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছাতে না পারার আশঙ্কায় মরিয়া হয়ে সে ওখানকার তার পরিচিত এক এসআইকে ফোন দেন যানজট থেকে বের হওয়ার কোনো সুযোগ আছে কি না জানতে। সেই এসআই কোনো সমাধান দিতে পারলেন না। তবে কিছুক্ষণের মধ্যে সেই সহকর্মী দেখলেন যানজট থেকে বের করতে পুলিশ নিজেই চলে এসেছে মোটরসাইকেল নিয়ে। তবে শুধু সাংবাদিক বলে নয়, ওই এলাকার মানুষের কাছে তিনি জনপ্রিয় সবার বিপদ-আপদে পাশে থাকার জন্য।
কাজেই আমরা মাসুদ শিকদারদের মতো এসআইদের কারণে পুরো পুলিশ প্রশাসনকে ছোট করে দেখতে চাই না, আবার তাঁদের দোষ ঢাকার অপচেষ্টাও দেখতে চাই না। আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলছিলেন পুলিশ বাহিনী প্রসঙ্গে, ‘মুক্তিযুদ্ধ থেকে পুলিশের জন্ম। এর জন্য আমরা গর্ববোধ করি। কিন্তু সম্প্রতি পুলিশের কিছু কিছু ঘটনা আমাদের অনেক পীড়া দেয়। সেবামূলক অবস্থান থেকে পুলিশের বিচ্যুতি হয়েছে এটা আমাদের বিব্রত করে। রক্ষক যদি ভক্ষক হয়ে যায়, তবে এ ব্যাপারগুলো অত্যন্ত দুঃখজনক।’
আমাদের কথা একটাই, সত্যকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা না করে বরং একটু পাল্টাই। প্রশাসনের মধ্যে জবাবদিহিতার সংস্কৃতি চালু করি।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ।