খোলা চোখে
পুলিশের সাদা পোশাক বিতর্ক
১.
আমাদের এক প্রতিবেশী বউ পেটান। তার মুখে দাড়ি আছে। সব সময় সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরেন। সাদা চোখে দেখলে যে কেউ তার প্রতি শ্রদ্ধাবনত হবেন।
দাড়ি আর পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা কেতাদুরস্ত অনেক লোক নিয়মিত ঘুষ খান। এদের অনেকে আবার নামাজও পড়েন। তো আমরা এর জন্য কি তাদের পোশাককে দায়ী করব?
যে লোক বউ পেটায়, যে লোক ঘুষ খায়- সে পাঞ্জাবি-টুপি না পরলেও এই কাজ করত। কেননা এটিই তার চরিত্র। এখানে পোশাকের কোনো ভূমিকা নেই।
বিতর্ক উঠছে বা এই বিতর্ক আগেও ছিল যে, সাদা পোশাকে পুলিশ রাতে টহল দেবে কি না বা তল্লাশি চালাবে কি না। বিশেষ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা পুলিশি নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নির্দেশ দেন- সাদা পোশাকে পুলিশের টহল চলবে না; জ্যাকেট বা কটি থাকতে হবে।
সাদা পোশাক মানে হোয়াইট ড্রেস বা সাদা রঙের পোশাক নয়। বরং সাদা পোশাক বলতে বোঝায় ইউনিফর্ম ছাড়া অন্য যেকোনো সাধারণ পোশাক। অর্থাৎ আমরা সব সময় যে পোশাক পরি, তার সবই সাদা পোশাক। কিন্তু পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সব বাহিনীরই নিজস্ব পোশাক বা ইউনিফর্ম রয়েছে এবং দায়িত্ব পালনকালে তাদের এই ইউনিফর্ম পরে থাকাই বিধান। যদিও বিশেষ কিছু অভিযান বা অনুসন্ধানের সময় তারা নিজেদের পরিচয় আড়াল করার জন্য সাদা পোশাক পরে থাকে এবং এটিও আইনসিদ্ধ। কিন্তু বিপত্তিটা বাধে এই সাদা পোশাকের বেলাতেই।
এ রকম অভিযোগ আকসার আসে যে, অমুককে সাদা পোশাকে কিছু লোক ধরে নিয়ে গেছে। অমুককে একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ইত্যাদি। আবার অনেক সময়ই ধরে নিয়ে যাওয়া ওই লোকদের আর হদিস মেলে না। অর্থাৎ গুম করে ফেলা হয়। ফলে এই প্রশ্নেরও মীমাংসা হয় না যে, গুম বা নিখোঁজ হওয়া ওই মানুষগুলোর কজনকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধরে নিয়ে গেছে, আর কজনকে অপরাধীরা নিয়ে গেছে। কারণ ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণেও অনেককে তার প্রতিপক্ষের লোকজন সাদা পোশাকে পুলিশ বা র্যাব পরিচয় দিয়ে ধরে নিয়ে যেতে পারে। অনেক সময়ই এ রকম হয়েছে যে, কাউকে পুলিশ, ডিবি বা র্যাব পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর ভুক্তভোগী পরিবার সংশ্লিষ্ট থানায় অভিযোগ করলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা স্বীকার করেনি।
২.
সাদা পোশাকে পুলিশ টহল দিতে পারবে না বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশকে আপাতদৃষ্টিতে শুভ উদ্যোগ মনে হলেও আদতে এটি কোনো টেকসই সমাধান নয়। কারণ ‘ম্যান বাহাইন্ড দ্য মেশিন’; অর্থাৎ যন্ত্রটি কী তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রটি কে চালাচ্ছে সেটি। যেমন ইন্টারনেট। এই মাধ্যমটিকে মিস্টার অমুক হয়তো পর্নোগ্রাফির কাজেই ব্যবহার করেন। কিন্তু আপনি এটি ব্যবহার করেন জ্ঞান অর্জনের কাজে।
ফেসবুক প্রকৃত অর্থে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হলেও অনেকে এটিকে দলীয় প্রোপাগান্ডা আর ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক উসকানি তৈরির মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহার করেন। তার মানে এখানে ইন্টারনেট বা ফেসবুকের নিজস্ব কোনো শক্তি নেই। পুরোটা নির্ভর করছে এর ব্যবহারকারীর ওপর। যেমন বলা হয়, ছুরি দিয়ে আপনি আপেল কাটবেন নাকি কারো গলা কাটবেন, সেটি নির্ভর করছে আপনার ইনটেনশন বা ইচ্ছা অর্থাৎ মানসিকতার ওপর।
একইভাবে পুলিশের গায়ে ইউনিফর্ম থাকল কি সাদা পোশাক থাকল, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভেতরের মানুষটা কে? একজন সৎ পুলিশ সদস্য বা কর্মকর্তা সাদা পোশাকে থাকলেও যা, ইউনিফর্ম থাকা অবস্থাতেও তাই।
রাজধানীতে পরপর দুটি ঘটনাই এর প্রমাণ। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম রাব্বীকে নির্যাতনকারী পুলিশ কর্মকর্তা এসআই মাসুদের গায়ে ইউনিফর্মই ছিল। পুলিশের পিকআপ ভ্যানে তুলেই তাঁকে পেটানো হয়েছে।
তবে এরপর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা বিকাশ নির্যাতিত হয়েছেন সাদা পোশাকের পুলিশের দ্বারা। তার মানে নাগরিকরা ইউনিফর্ম পরা এবং সাদা পোশাক পরা দুই ধরনের পুলিশের হাতেই মার খাচ্ছে। অর্থাৎ এখানে পোশাক কোনো মুখ্য নয়। ম্যান বাহাইন্ড মেশিনের মতো এখানে মূল বিষয় ম্যান ইন টু দ্য ড্রেস।
যে পুলিশ নাগরিককে পেটায়, খোঁজ নিলে দেখা যাবে সে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়েছে। ফলে এখন সে ওই ঘুষের টাকা তোলার জন্য যা ইচ্ছে তাই করে। এ ক্ষেত্রে তার পারিবারিক মূল্যবোধ, বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা, বন্ধুবান্ধব এবং মানুষ হিসেবে যে মানবিক গুণাবলি থাকা দরকার সেগুলোও খুব গুরুত্বপূর্ণ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যেসব কর্মকর্তা বা সদস্যের বিরুদ্ধে এ রকম নির্যাতনের অভিযোগ আছে, অনুসন্ধান করলে বেরিয়ে আসবে, তারা কোনো ভালো পরিবার থেকে আসেনি। তাদের বাবা-মা তাদের আদর্শবান করে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন।
সুতরাং পুলিশ সাদা পোশাকে টহল দিল কি ইউনিফর্ম পরল, তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ পোশাকের ভেতরের মানুষটি আসলে কতটুকু মানবিক, কতটুকু দায়িত্ববান এবং কতটুকু সৎ।
আবার অনেক অপরাধীও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক পরে অপরাধ করে থাকে। বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর পোশাকও উদ্ধার করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে জ্যাকেট বা কটি কোনো বিষয়ই নয়। পোশাক নকল করা বা আসল পোশাক জোগাড় করাও অপরাধীদের জন্য অসম্ভব কিছু নয়। সুতরাং সাদা পোশাকে পুলিশ টহল দিতে পারবে না- এই বিধানের পাশাপাশি নিজস্ব গাড়ি ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোনো সাদা গাড়ি অর্থাৎ সাধারণ গাড়ি দিয়ে অভিযান চালাতে পারবে না- এই নির্দেশনাও এখন জরুরি।
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক ও উপস্থাপক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর