বইমেলা
লেখক প্রকাশক আর পাঠকের মিলনমেলা
বাংলাদেশের মানুষের জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে বইমেলা। এভাবে লিখতে ভালো লাগল বলে লিখছি। আসলে এ কথার পুরোটি সত্য নয়। একুশের বইমেলার জন্য অধীর আগ্রহে বছরজুড়ে অপেক্ষা করে প্রধানত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। নিম্নবিত্তের ছোট্ট একটি অংশ যে বইয়ের টানে মেলায় আসে না তেমন নয়। তবে উচ্চবিত্তদের খুব হাতেগোনা অংশই বইমেলা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এমন মন্তব্য করার সাহস পাই বাস্তব পর্যবেক্ষণ থেকে। আমি দেশসেরা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক বছর ধরেই খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করি। ফেব্রুয়ারি এলে আমি ছাত্রছাত্রীদের কাছে প্রশ্ন রেখে জানতে পারি গড়পরতা ওদের ৬০ ভাগ কখনো একুশের বইমেলায় যায়নি। কেউ কেউ খবরও রাখে না অমন একটি মেলা কোথায় হয়। বাকিদের আবার একটি অংশ এপর্যন্ত জীবন পরিসরে দু-একবার মেলাতে গিয়েছে। এই না-যাওয়াদের বড় অংশই উচ্চবিত্তের সন্তান। এমন ছাত্রছাত্রীও পেয়েছি, যারা বাংলাদেশেই বসবাস করছে অথচ বাংলা পড়তে ও লিখতে পারে না। এসব কারণেই মানতে হবে বাঙালি মাত্রই বইমেলার জন্য উদ্বাহু হয়ে থাকে না।
প্রতিবছরই দেখা যাবে বইমেলার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করা বাঙালি পাঠকদের একটি অংশ দূর-দূরান্তের জেলা থেকে একবারের জন্য হলেও বইমেলায় ছুটে আসে। এই বাস্তবতা বিচারেই আমার লেখার শিরোনাম লেখক-প্রকাশক আর পাঠকের মিলনমেলা।’
সব প্রকাশকই চান সাধ্যমতো নতুন বইয়ের সম্ভার নিয়ে মেলায় আসতে। প্রকাশকরা সারা বছর নিজ নিয়মে বই প্রকাশ করছেন, বইয়ের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারপরও বইমেলাকে কেন্দ্র করে একটি বিশেষ প্রস্তুতি চলে। এর সঙ্গে যে শুধু বাণিজ্যভাবনা কাজ করে তেমনটি নয়। এই মেলাকে ঘিরে একটি প্রাণের টান তৈরি হয়ে আছে। বড় সত্য হচ্ছে, প্রকাশকদের উৎসাহে তো একুশের বইমেলার যাত্রা শুরু হয়েছিল। বাংলা একাডেমির বটতলায় বইমেলার যাত্রায় সেই যে একটি ছোট্ট স্ফুলিঙ্গ ধপ করে জ্বলে উঠেছিল, তা যে কখন বিশাল অবয়বে প্রজ্জ্বলিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল তাকে সীমা দিয়ে বোঝানো যাবে না। বাংলা একাডেমির অঙ্গনজুড়ে অশ্বত্থ বৃক্ষ হয়ে ছড়িয়ে পরেছিল। এখন মহীরুহ হয়ে বিস্তারিত হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অনেকটা জুড়ে। এখন অনেক বড় বড় স্টল সুসজ্জিত করে গ্রন্থ প্রদর্শন করছেন প্রকাশকরা। প্যাভিলিয়নের ধারণাও বাস্তব রূপ নিয়েছে। অর্থাৎ মেলা ক্রমে পূর্ণ অবয়বে দাঁড়াচ্ছে।
প্রকাশকের জীয়নকাঠির অংশ লেখক। লেখক ছাড়া প্রকাশকের অবস্থান অর্থহীন। অনেক লেখক অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন বইমেলার জন্য। সারা বছর লেখকদের বড় অংশেরই লেখার পরিকল্পনা হতে থাকে মেলাকে ঘিরেই। পুরোনো প্রতিষ্ঠিত লেখকরা বেশির ভাগ সময় প্রকাশকদের তাড়নায় সক্রিয় হন। আর নবীন লেখকরা পেতে চান প্রকাশকের সুদৃষ্টি। একটি বইমেলাতে প্রকাশ পেলে নবীন লেখকদের আনন্দ কোনো মানদণ্ডে বিচার করার নয়। এভাবে প্রকাশক আর লেখক এক মেলবন্ধনে মেলায় প্রাণ সঞ্চার করেন। তবে এই প্রাণ প্রতিষ্ঠা প্রকৃত অর্থে পূর্ণতা পায় পাঠকের উপস্থিতিতে। লেখকের পাণ্ডুলিপিকে প্রকাশক প্রকাশ করে ঝকঝকে তকতকেভাবে সাজিয়ে ফেলেন স্টল। আর এসব বই ছুঁয়ে সংগ্রহ করে মেলার পূর্ণতা এনে দেয় পাঠক। এভাবে বইমেলা লেখক, প্রকাশক আর পাঠকের মিলনমেলায় পরিণত হয়।
কয়েক বছর ধরে একুশের বইমেলায় পাঠক-দর্শকের সংখ্যা অনেকগুণ বেড়ে গেছে। লম্বা লাইনে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে মেলায় ঢুকতে হয়। একজন প্রকাশক একদিন বলেছিলেন এত দর্শকের প্রত্যেকে যদি একটি করে বই কিনত তবে বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের চেহারাটাই পাল্টে যেত। আমি ভাবি না-ই বা কিনল। এই এত এত ছেলেমেয়ে তরুণ-তরুণী মেলাতে আসছে আড্ডা দিচ্ছে এটিই বা কম কিসের। এদের আড্ডা তো বইয়ের ভুবনের ভেতর। কৌতূহলে অন্তত একটি-দুটি বইয়ের ওপর দৃষ্টি যায়। পাটভাঙা শাড়ির ভাঁজ খোলার মতো পৃষ্ঠা উল্টাতে গিয়ে নতুন বইয়ের সুঘ্রাণ নাক ছুঁয়ে যায়। এই অনুভূতিটিরও অনেক মূল্য। বইমেলায় যে আড্ডা দিতেও আসেনি সে কিন্তু এমন অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হয়।
তবে আমি মনে করি পাঠ্যাভ্যাস তৈরিতে পরিবারেরও ভূমিকা রয়েছে। ছোটবেলা থেকেই বইমেলায় নিয়ে আসার অভ্যাস সন্তানকে আগ্রহী করে বইয়ের ওপর। অনেক পরিবারই আছে স্কুল পাঠ্যবইয়ের বাইরে আনন্দ পাঠের জন্য আর কোনো বই সন্তানের হাতে তুলে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। নিজেরাও মেলায় এসে বই কেনার আগ্রহ খুঁজে পান না। আমার বেশ কয়েকবার কলকাতা বইমেলায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। আমি লক্ষ করেছি অনেক পাঠক এবং অনেক পরিবার প্রচুর বই কেনেন। আমি এমন কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি তারা বছর ধরেই একটি বাজেট তৈরি করতে থাকেন বইমেলার জন্য। ১৯৯২-এর কথা মনে করতে পারি। এক সন্ধ্যায় বইমেলার ভেতরে মাঠের মাঝখানে একটি খাবারের স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছি। দোকান ঘিরে বেশ ভিড় জমে গেছে।
ফিশফ্রাই, এগরোল ভাজা হচ্ছে। হঠাৎ দেখলাম ভিড় ঠেলেঠুলে একটি পরিবার এসে দাঁড়াল। চারজন বিভিন্ন বয়সের তরুণী, একজন তরুণ আর সম্ভবত তাদের মা। বই কেনা হয়তো শেষ হয়েছে। সবার হাতেই বইয়ের প্যাকেট। সামাল দেওয়াই ভার। মা বলে যাকে ভাবছি, তিনি ফিশফ্রাইয়ের দাম জিজ্ঞেস করলেন। দোকানি একটি দাম বলল। কিছুক্ষণ নীরব থেকে মনে মনে কি যেন হিসাব কষলেন।
তারপর খাবারের অর্ডার না দিয়ে ভিড় থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেলেন। আমি বিস্মিত হলাম এই ভেবে যে পরিবার এত বই কিনতে পারে সামান্য ফিশফ্রাই খাওয়ার সামর্থ তাদের থাকার কথা।
কৌতূহল মেটাতে পিছু নিলাম। একটি বুক স্টলের সামনে পেয়েও গেলাম। আমি ভণিতা না করে ফিশফ্রাই না খেয়ে চলে আসার কারণ জানতে চাইলাম। অসংকোচেই বললেন, বাজেট ফুরিয়ে আসায় একটি বই তারা কিনতে পারেননি। এখন হিসাব করে দেখলেন তাঁরা ছয়জন ফিশফ্রাই না খেলে সেই বইটি কিনতে পারেন।
আমার কাছে এটি একটি বড় অভিজ্ঞতা। এর পর থেকে একুশের বইমেলায় প্রতিবছরই অমন একটি পরিবার খুঁজে ফিরি। আমার বিশ্বাস, খাবারের দোকানের বাজেট বাঁচিয়ে হলেও আমাদের পাঠকও একদিন এভাবেই বই কিনবেন।
লেখক : এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।