সোজাকথা
থামছে না শিশুহত্যা
মা-বাবার ভালোবাসার ফুল ছোট্ট ফুটফুটে সোনামণি। কিন্তু সোনামণিকে দেওয়ার মতো সময় কোথায় মা-বাবার! তারা তো ব্যস্ত তাদের জীবন নিয়ে। ছোট্ট সোনামণির দেখভাল করে কাজের মানুষ। কত অবহেলায়, কত অনাদরে প্রিয় সন্তান বড় হয়ে উঠছে, তা দেখতে পায় না মা-বাবা। একদিন সোনামণি হারিয়ে যায়। মা দোষে বাবাকে, বাবা দোষে মাকে; কিন্তু সন্তানের খোঁজ আর পায় না। অবশেষে অনেক তোলপাড় করে সন্তানকে ফিরে পায় মা-বাবা, তবে সেটা সন্তানের লাশ। ছোট্ট সোনামণির হাতে থাকা আইফোনটাই জীবন কেড়ে নেয় তার। পাড়ার কিছু মাদকসেবী আইফোনটা পাওয়ার আশায় খুন করে নিষ্পাপ শিশুটিকে। হায় রে মা-বাবা, তাঁদের অভাব পূরণের চেষ্টা তাঁরা করেছেন প্রিয় সন্তানটির কাছে না থেকে গেজেটস আর খেলনা দিয়ে। সেলুলয়েডের পর্দায় হৃদয়বিদারক এই দৃশ্য একবার যে দেখেছে, চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। কিন্তু আমাদের চারপাশে সত্যি সত্যি প্রতিদিন শিশুহত্যার ঘটনা একের পর এক ঘটে চলেছে, তা কি সহ্য করা সম্ভব?
রংপুরের নিউ আদর্শপাড়ার মোছাদ্দেক হোসেনের চার বছরের শিশুসন্তান রহিমুল ইসলাম রওনক গত ১ ডিসেম্বর নিখোঁজ হয়। দুই মাস পর রংপুরের মিঠাপুকুর থেকে রওনকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। স্বজনরা বলছেন, শিশুটির বাবার সঙ্গে স্থানীয় একজনের বিরোধের জেরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। নোয়াখালীর চরজব্বারের সুবর্ণচর এলাকার আনোয়ার হোসেনের মেয়ে মুন্নী আক্তার চার বছর ধরে রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় এক বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করত। গত ২৪ জানুয়ারি পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে। ঢাকার ধামরাইয়ের চৌহাট এলাকার দেলোয়ার হোসেনের ছেলে শাকিল ও আবু বকরের ছেলে ইমরান হোসেনের গত শুক্রবার টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থেকে গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
সব নির্মমতাকে হার মানিয়েছে রাজধানীর খিলক্ষেতের নাজিমুদ্দীনের হত্যাকাণ্ড। কবুতর চুরির অভিযোগ দিয়ে গত বছরের ১২ এপ্রিল রাতে ও তার পরদিন সকালে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করা হয় নাজিমকে। বালু নদের পাড়ের এই নির্মম নির্যাতন ও হত্যার সময় উল্লাসে ফেটে পড়ে হত্যাকারীরা। সেই নির্মমতার ফুটেজও ধারণ করা হয় মোবাইলে।
শিশুহত্যার আরেক ভয়াবহ দৃষ্টান্ত সিলেটের সামিউল আলম রাজন হত্যা। গত ৮ জুলাই শহরতলির কুমারগাঁও এলাকায় চুরির অপবাদ দিয়ে হত্যা করা হয় রাজনকে। সেই হত্যা ও নির্যাতনেরও ভিডিও ধারণ করা হয়। এমন নির্যাতন ও হত্যার সময় উল্লাসও করে হত্যাকারীরা।
খুলনার টুটপাড়ায় আরেক ভয়াবহ শিশুহত্যার ঘটনার শিকার হয় গ্যারেজের কর্মী রাকিব। গত বছরের ৩ আগস্ট মোটরসাইকেলে হাওয়া দেওয়ার কম্প্রেসার মেশিন দিয়ে তার পেটের ভেতরে গ্যাস ঢোকানো হয়। এতে তার পেটের ভেতরের নাড়িভুঁড়ি, মলদ্বার, মূত্রথলি ফেটে মৃত্যু হয় তার।
কেবল এই তিনজন নয়, শিশুহত্যার এমন নির্মমতার খবর প্রায় প্রতিদিনেরই। চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি কেরানীগঞ্জের মুগারচর এলাকার দাদার পরিবারের হাতে অপহরণের পর খুন হয় শিশু আবদুল্লাহ। মুক্তিপণের টাকা নিয়েও তাকে হত্যা করে হাত-পা বেঁধে লাশ একটি ড্রামের ভেতর ঢুকিয়ে রাখা হয়।
এমন আলোচিত হত্যাকাণ্ডের আড়ালের চিত্র আরো ভয়াবহ। প্রায় প্রতিদিনই শিশুহত্যা হচ্ছে বাংলাদেশে। পরিসংখ্যান বলছে, শুধু ২০১৫ সালেই অপমৃত্যুর শিকার হয়েছে তিন হাজার ৮৯৩ শিশু। এই এক বছরে সরাসরি হত্যাই করা হয়েছে ২৯২ শিশুকে। এই চিত্র আরো ভয়াবহ ২০১৪ সালের। বছরের ৩৬৬ দিনে ৩৬৬ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে ওই বছর। ২০১৩ সালে ২১৮ জন ও ২০১২ সালে ২০৯ শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে বিভিন্নভাবে। এই হিসাবে গত চার বছরে সরাসরি হত্যার শিকার ১৮৫ শিশু।
চলতি বছরের চিত্র যেন আরো ভয়াবহ। বছরের প্রথম মাসেই ২৯ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। গড়ে দিনে একজন করে হত্যার এই পরিসংখ্যান বছর শেষে গিয়ে কোথায় থামবে, তার যেন কোনো সীমা নেই।
সবচেয়ে বেশি আতঙ্কের বিষয়, পেশাদার খুনিদের চেয়ে শিশুরা বেশি খুন হচ্ছে পরিচিতজন ও আত্মীয়স্বজনের হাতে। এমনকি মা-বাবার হাতেও শিশু খুন হওয়ার ঘটনাও কম নয়। ২০১৫ সালের ২৫ আগস্ট খুলনায় ১১ মাসের কন্যা সুমাইয়াকে হত্যা করেছে মা-বাবা। রাজধানীর আদাবরে শিশু সামিউল হত্যা, সবুজবাগে রিয়া হত্যা ও পুরান ঢাকার শিশু তানহা হত্যার রক্তও লেগে আছে মা-বাবার হাতে। পরিসংখ্যান বলছে, শুধু ২০১৫ সালের প্রথম ছয় মাসেই মা-বাবার হাতে খুন হতে হয়েছে ২৭ শিশুকে। এর মধ্যে মায়ের হাতে খুন হয়েছে ১৩ শিশু এবং বাবার হাতে খুন হয়েছে ১৪ শিশু।
হত্যার শিকার শিশুর তালিকা লম্বা হলেও বিচারের তালিকা খুব ছোট। বেশির ভাগ শিশুহত্যার বিচারের জন্য স্বজনদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে বছরের পর বছর। কোথাও মামলা হওয়া নিয়ে গড়িমসি, কোথাও তদন্তে গাফিলতি, আবার কোথাও বিচার কার্যক্রমেই কেটে যাচ্ছে বছরের পর বছর।
২০১৫ সালের অক্টোবরে মাদারীপুরে ধর্ষণের পর বিষ খাইয়ে হত্যা করা স্কুলছাত্রী দুই শিশুহত্যার বিচার হয়নি এখনো। চুরির অপবাদ দিয়ে ২০১৫ সালের আগস্টে বরগুনায় হত্যা হওয়া শিশু রবিউলের পরিবারও বিচারের অপেক্ষায়। একই বছরের ২০১৫ সালের আগস্টে ঢাকার কেরানীগঞ্জে নির্যাতন করে হত্যা করা শিশু রাব্বী হত্যার বিচারও এগোয়নি এখনো। একই অবস্থা ২০১২ সালের অক্টোবরে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশে গৃহশিক্ষকের হাতে মায়ের সঙ্গে খুন হওয়া আলভী ও আবিদা হত্যার বিচার, ২০১৩ সালের মে মাসের চট্টগ্রামের সিআরবিতে ছাত্রলীগ-যুবলীগের গুলিতে খুন হওয়া শিশু আরমান হত্যার বিচার, ২০১২ সালের এপ্রিলে বগুড়ায় অপহরণের পর মুক্তিপণ নিয়েও ইটভাটায় পুড়িয়ে হত্যা করা শিশু নাইমের পরিবারও অপেক্ষায় বিচারের। আর ২০১৫ সালের এপ্রিলে খিলক্ষেতে আলোচিত নাজিম হত্যার চার্জশিট দিতেই কেটে গেছে নয় মাসের বেশি সময়। বিচারের অপেক্ষায় তার পরিবারও। এক হিসাব বলছে, ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে চার হাজার ৬৮টি। এর কমপক্ষে ৩০ ভাগই শিশু নির্যাতনের। এ মামলার ১০ ভাগেরই বিচার হয়নি এখনো।
তবে বিচারের এত সব নিশ্চয়তা বা অপেক্ষার মধ্যে স্বজনদের জন্য কিছুটা হলেও আশার আলো জাগিয়েছে সিলেটের রাজন ও খুলনার রাকিব হত্যার বিচার। বলা যায়, কম সময়ের মধ্যেই এ দুই খুনের ঘটনায় রায় হওয়ায় কিছুটা হলেও দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়েছে। বিচার পাওয়ার আশা দেখছেন সন্তানহারা মা-বাবা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সহজেই উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য অপরাধচক্রের অন্যতম কৌশল হয়ে উঠেছে শিশুদের টার্গেট করা। সমাজ ও পরিবারের মধ্যে স্বার্থপরতার চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে বাড়ছে শিশুহত্যার মতো ভয়ংকর ঘটনা। বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং সামাজিক অসচেতনতার কারণেই শিশুহত্যার হার বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। তবে শিশু নির্যাতন ও হত্যার ঘটনায় জিরো টলারেন্সই পারে এ ধরনের নৃশংসতা বন্ধ করতে। বিভিন্নভাবে খুন হওয়া এসব শিশুর পরিবারের লোকজনের দাবি, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে অল্প সময়েই রায় ঘোষণা ও তা কার্যকর হোক।
শিশুহত্যা ও নির্যাতনের এই ভয়াবহতা বাড়ার কারণ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. জিয়া রহমান বলেন, ‘সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনে অপরাধেও পরিবর্তন এসেছে। সমাজ ও পরিবারের মধ্যে স্বার্থপরতা বাড়ছে। এর পর তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে পর্নোগ্রাফি থেকে শুরু করে পরকীয়াসহ আপত্তিকর নানা বিষয়েই আগ্রহ তৈরি হচ্ছে মানুষের মধ্যে। এসবের জের ধরে শিশুসন্তান হত্যা, অপহরণ ও নির্যাতনের মতো অপরাধ বাড়ছে। এ ব্যাপারে ব্যাপক সামাজিক কার্যক্রম শুরু করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্কুল পর্যায়েও কাউন্সেলিং চালু করতে হবে।’
শিশুদের নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের নির্বাহী পরিচালক রোকসানা সুলতানা অবশ্য মনে করেন, শিশুদের বিষয়টি অনেক বেশি সেনসিটিভ। সন্তানের জীবন বাঁচাতে মা-বাবা অপহরণকারীদের সব কথা মেনে নিতে চায়। এ ছাড়া শিশুকে গুম, অপহরণ ও হত্যা করে লাশ লুকিয়ে ফেলা সহজ। যত শিশু অপহরণের পর নির্মমভাবে খুন হয়েছে, তার বড় কারণ শিশুটি অপহরণকারীদের চিনে ফেলে। এ ছাড়া আকাশসংস্কৃতির প্রভাব তো রয়েছেই। তবে রোকসানা মনে করেন, ‘মা-বাবা তো সচেতন হবেনই, সে সঙ্গে শিশুকে এমনভাবে শিক্ষা দিতে হবে যে আত্মীয়স্বজন কারো সঙ্গে কোথাও যেতে হলেও মা-বাবাকে না বলে যেন যায় না। শিশুদের মধ্যে সচেতনতা শেখাতে হবে।’
তবে সবশেষে একটাই কথা মনে হয়, আমাদের শিশুকে রক্ষা করতে আমাদের মধ্যেই সচেতনতা বাড়াতে হবে। আমার শিশুকে ভালো রাখতে হলে আপনার শিশুর নিরাপত্তাও আমাকে দেখতে হবে। কারণ, সমাজে একা একা ভালো থাকা যায় না, সবাই মিলে ভালো থাকতে হয়। শিশুর নিরাপত্তা কিংবা শৈশবকে সুন্দর রাখার ব্যাপারে আমরা অনেক বেশি উদাসীন। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। আর অপরাধকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দ্রুততম সময়ে করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ।