বিশ্ব বেতার দিবস
দুর্যোগে দুর্গত মানুষের পাশে
স্যাটেলাইট চ্যানেল আর ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার এই যুগে রেডিও নিয়ে আলোচনাটা অনেকের কাছে বাহুল্য মনে হতে পারে। বাস্তবতা হলো, রেডিও এখনো যে কত শক্তিশালী মাধ্যম এবং প্রান্তিক মানুষের বিপদে-আপদে, দুর্যোগ-দুর্বিপাকে, তাদের অভাব-অভিযোগ কিংবা উন্নয়ন আর হাসি-কান্নায় কতটা কাছে থাকে, সেটি মাঠপর্যায়ে না দেখে কারো পক্ষে আন্দাজ করা কঠিন।
বিশেষ করে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চালু থাকা ১৬টি কমিউনিটি রেডিও আর বাংলাদেশ বেতারের কেন্দ্রগুলো নানা ইস্যুতে মানুষকে তথ্যসহায়তা দিয়ে যেভাবে ক্ষমতায়িত করছে, সেটি নিয়ে মূলধারার গণমাধ্যমে আরো বেশি আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। সেই সঙ্গে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও স্থানীয় পর্যায়ের বেতারকর্মীরা অনেকটা বিনা শ্রমে যেভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি নিজেদের দায়বদ্ধতার প্রমাণ দিচ্ছেন, সেটির আর্থিক মূল্যায়ন না হোক, অন্তত মৌখিক স্বীকৃতিটুকু তাঁদের প্রাপ্য।
১৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী পালিত হয় জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্ব বেতার দিবস। তথ্য মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশে দিবসটি পালিত হচ্ছে, যেখানে বাংলাদেশ বেতার, প্রাইভেট এফএম এবং কমিউনিটি রেডিওগুলো অংশ নিচ্ছে।
বেতার দিবসের এবারের থিম ‘দুর্যোগ’। বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ হওয়ায় স্বভাবতই এখানে বেতারের দায়িত্ব অনেক বেশি। দেশের উপকূলীয় এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে চালু থাকা কমিউনিটি রেডিওগুলো এরই মধ্যে সেই দায়িত্ব পালনে নিজেদের সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড় মহাসেনের সময় যখন উপকূলের অনেক এলাকা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তখন স্থানীয় পর্যায়ের এই রেডিওগুলো প্রতি মুহূর্তের খবর জানিয়েছে কমিউনিটির মানুষকে। কমিউনিটি রেডিওতে আবহাওয়ার সংবাদ শুনে বহু জেলে সমুদ্র থেকে ফিরে এসে নিজের জীবন বাঁচিয়েছেন, এ রকম উদাহরণও রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়েও এখন প্রান্তের মানুষ যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। কেননা কমিউনিটি রেডিও প্রতিনিয়তই এই বিষয়ের ওপর প্রতিবেদন, সচেতনতামূলক বার্তা ও অনুষ্ঠান প্রচার করছে।
দরিদ্র মানুষের ওপর প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব প্রতিরোধ বা প্রশমনের লক্ষ্যে কমিউনিটি রেডিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, নদীভাঙন, ভূমিকম্প ইত্যাদি বিষয়ে মানুষকে নিয়মিতই সচেতন করছে। তা ছাড়া প্রতিনিয়তই প্রচার করছে আবহাওয়ার খবর।
কমিউনিটি রেডিও স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সংঘাতময় কিংবা সংঘাতবিহীন জরুরি পরিস্থিতিতেও মানবিক সাহায্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। খাদ্যের অব্যাহত ঘাটতি এবং সংঘাতের মতো জরুরি পরিস্থিতিতে সামাজিকভাবে যেসব বিচ্যুতি বা স্থানচ্যুতি ঘটে, সেসব জনস্বাস্থ্যের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলে। ফলে জরুরি মানবিক সাহায্য সংক্রান্ত রেডিও অনুষ্ঠান প্রচারের উদাহরণ অনেক এবং বহুবিধ।
বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রশমন এবং এ ধরনের দুর্যোগের ক্ষেত্রে প্রস্তুতি গ্রহণের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষ তাদের উপার্জনের ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে পারে এবং এ ধরনের দুরবস্থার সঙ্গে যুক্ত ঝুঁকি ও বিপদাশঙ্কাও হ্রাস করতে পারে।
বাংলাদেশের মতো প্রেক্ষাপটে যেখানে সামাজিক দুর্যোগসহ বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ভূমিধস প্রভৃতি ঋতুভিত্তিক ও নৈমিত্তিক দুর্যোগ রয়েছে; কমিউনিটি রেডিও এসব ক্ষেত্রে আগেই বিপজ্জনক আবহাওয়া সংক্রান্ত সতর্কসংকেত স্থানীয় ভাষায় সহজভাবে প্রচার করছে।
দুর্যোগ-পূর্ব, দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ-পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে অবহিত করছে কমিউনিটি রেডিও। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির সঙ্গে অভিযোজনের কলাকৌশল প্রচারেও কমিউনিটি রেডিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
এলাকার অবস্থানের ভিত্তিতে সুনির্দিষ্টভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিরূপণ এবং খাতওয়ারি বিকল্প প্রস্তুতির জন্য সাড়া দেওয়া এবং তৎক্ষণাৎ জ্ঞান ও তথ্য সরবরাহ করার ক্ষেত্রেও কমিউনিটি রেডিও ভূমিকা রাখতে পারে। এ ছাড়া পুনর্বাসন ও কার্যকরী সমন্বয়, দুর্যোগ মূল্যায়ন, ঝুঁকিহ্রাস কার্যক্রম, দীর্ঘমেয়াদি টেকসই পরিকল্পনা ও নীতিনির্ধারণেও কমিউনিটি রেডিও ভূমিকা রাখতে পারে।
রেডিও কারিগরিভাবে প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন। ফলে দুর্যোগের সময়েও রেডিও চালু থাকে। এমনকি বিদ্যুৎ বিপর্যয় হলেও অবিরাম সম্প্রচার চালিয়ে যেতে সক্ষম। তা ছাড়া জরুরি অবস্থায় রেডিওর ভূমিকা ও অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা সঠিক তথ্যের অভাবে নাগরিকরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গুজব ও পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, যা অনেক সময় বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। রেডিও সে ক্ষেত্রে গুজবের বিপরীতে বস্তুনিষ্ঠ ও সঠিক তথ্য দিয়ে দুর্গত মানুষের পাশে থাকে বন্ধুর মতো।
বলা হয়, তথ্যই শক্তি। তথ্যহীনতা মানুষকে বিপদাপন্ন করে। আর তথ্য জানা থাকলে মানুষ সম্ভাব্য বিপদ বা দুর্বিপাক মোকাবিলায় কার্যকর প্রস্তুতি নিতে পারে। কমিউনিটি রেডিও তার কমিউনিটির মানুষকে সেই ভরসাটি দিচ্ছে বা দিতে পারছে। মনে রাখা দরকার, কমিউনিটির রেডিওর মূলত যারা শ্রোতা, তাদের বেশির ভাগই সমাজের সুবিধাভোগী অংশের বাইরে। যারা জেলে, কৃষক, দিনমজুর, স্বল্প আয়ের মানুষ-তারাই মূলত কমিউনিটি রেডিওর শ্রোতা ও কর্মী।
সারা বিশ্বেই কমিউনিটি রেডিও চলে সংশ্লিষ্ট কমিউনিটির মানুষের স্বেচ্ছাশ্রমে। আমাদের দেশে অনেকে এখনো এটিকে এনজিও রেডিও বলে ভাবতে পছন্দ করলেও, বাস্তবতা হলো- বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত কমিউনিটি রেডিওগুলো এরই মধ্যে তৃণমূল মানুষের একটি প্লাটফর্মে পরিণত হয়েছে, যেখানে তারা নিজেদের সমস্যা সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলছে এবং নিজেদের বেঁচে থাকার পথ নিজেরাই বাতলে নিচ্ছে।
তবে রেডিওমাধ্যমের চ্যালেঞ্জও কম নয়। বিশেষ করে কমিউনিটি রেডিওগুলো এখনো ওই অর্থে কমিউনিটির সব স্তরের মানুষের কণ্ঠস্বরে পরিণত হতে পারেনি। এজন্য অনুষ্ঠান পরিকল্পনা, নির্মাণ, সম্প্রচার এমনকি এর ব্যবস্থাপনার প্রতিটি ক্ষেত্রে কমিউনিটির মানুষের অংশগ্রহণ আরো বাড়াতে হবে। কমিউনিটি রেডিওগুলো অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হলেও, এর টিকে থাকার জন্য যে বিজ্ঞাপন নীতিমালা রয়েছে, সেটি নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। সরকার অনেক দিন ধরেই বলছে, কমিউনিটি রেডিওর জন্য একটি তহবিল গঠন করা হবে, কিন্তু এটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। সবচেয়ে বড় কথা, আর্থিক সুবিধা দিতে না পারায় বেশির ভাগ স্বেচ্ছাসেবীই কিছুদিন পর কমিউনিটি রেডিওতে কাজ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ফলে কমিউনিটি রেডিওগুলো একদিকে যেমন স্থানীয় মানুষের উন্নয়নে, বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুযোগে বন্ধুর মতো কমিউনিটির মানুষের পাশে থাকে; তেমনি এখন কমিউনিটির মানুষের এবং সর্বোপরি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন ও সরকারেরও দায়িত্ব রয়েছে, এই রেডিওগুলো যাতে টিকে থাকে- তার ব্যবস্থা করা।
আমীন আল রশীদ : কমিউনিটি রেডিও গবেষক ও যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।