স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস
জয়নাল দিপালীর রক্তের দাগ কি মুছে যাবে?
টিএসসি থেকে আফতাবনগরের মাঠটা কতদূর? সেই ১৯৮৩ থেকে ২০১৬ কি অনেকটা সময়? এটা ঠিক সরকার দ্রুত সচেতন হয়ে ওঠায় এবার অতটা এগিয়ে যায়নি রক্তস্রোত; তবে ঝরেছে রক্ত, হয়েছে প্রতিবাদ আর বিপ্লবী ছাত্ররা ইতিহাস সাক্ষী রেখে আপস করেনি প্রতিষ্ঠা করেছে তাদের অধিকার। অবিনাশী ফাল্গুন প্রকৃতির মতো আমাদের ইতিহাসেও নিয়ে এসেছিল দ্রোহের আগুন। মহান ভাষা আন্দোলনের পাশাপাশি আরো একটি কারণে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস এ ফাল্গুনের কাছে ঋণী। ৮ ফাল্গ–ন হারিয়ে গেছে হঠাৎ করেই ইংরেজি ২১ ফেব্র“য়ারির দাপটে। সেদিক থেকে ধরতে গেলে আরো করুণ পরিণতি ১৪ ফেব্র“য়ারি ছাত্র বিপ্লবের যার তিরোধানটা ভালোবাসা দিবস নামের এক খেয়ালি অভিধায়।
বাংলাদেশের ইতিহাস যতবার থমকে গেছে ঠিক ততবার নতুন করে বিপ্লবী ছাত্রজনতা সোচ্চার হয়েছে। এমনি করে ১৯৮৩ সালে এরশাদ আমলের শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খানের বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় বিপ্লবী ছাত্র-জনতা। তারা ঢাকা মহানগর থেকে শুরু করে দেশব্যাপী গড়ে তোলে এক ব্যাপক গণআন্দোলন। সুষ্ঠুভাবে আন্দোলন পরিচালনা করার উদ্দেশ্যে তখনকার ছাত্র সংগঠনগুলো সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। তারা দাবি আদায়ের দিন হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন এই ১৪ ফেব্রুয়ারি যাকে এখন সবাই বিশ্ব ভালোবাসা দিবস হিসেবে জানে। দিনের কর্মসূচি হিসেবে নানা ধরনের প্লাকার্ড ফেস্টুন নিয়ে শোভাযাত্রা আর স্লোগান চলতে থাকে। সংগ্রাম পরিশদের সিদ্ধান্তে ছাত্রজনতা অগ্রসর হয় সচিবালয় অভিমুখে। তাদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচি তখনকার স্বৈরাচারী সরকার মেনে নিতে পারেনি। জবরদস্তিমূলক শাসনকাঠামো এবং মজিদ খানের শিক্ষানীতি তাদের কাছে ছাত্র জনতার দাবির বিপরীতে মুখ্য হয়ে ওঠে। ফলে ঘেরাও কর্মসূচিতে পুলিশ নির্বিচার গুলি চালায়। পুরো দেশে অনেক হতাহতের সংবাদ বিচ্ছিন্নভাবে পাওয়া গেলেও শুধু মহানগর ঢাকাতেই ১০ জন নিহত এবং শতাধিক আহত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের দ্বিধাবিভক্ত বামদলগুলোর কেউ কেউ এ দিন নিয়ে অনেক আলোচনা করলেও শেষ পর্যন্ত কালের গহ্বরে হারিয়ে যেতে বসেছে এ রক্তাক্ত ইতিহাস। এরপর থেকে ১৪ ফেব্র“য়ারিতে কেউ আর দিপালী, জয়নালের নাম নেয় না। ২১ ফেব্র“য়ারির আয়োজন যদি জাতীয় হয় তবে সময়ের আবর্তে ১৪ ফেব্র“য়ারির আয়োজন হয়ে গেছে গণমুখী। তাই প্রতি বছরের প্রথম মাসটা পার হতে না হতেই আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র“য়ারি, গানের কথামালায় শুরু হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের আয়োজন।
সম্প্রতি শিক্ষাব্যয় বেড়ে যাওয়া নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ ছিল চোখে পড়ার মতো। এরপর সরকার দ্রুতই মেনে নিয়েছিল শিক্ষার্থীদের দাবি। এতে তেমন ভয়াল-সহিংস পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়নি সবাইকে। তেমনি তখনকার আমলে ছাত্রজনতা কোনো প্রতিবাদ না করে মজিদ খানের শিক্ষানীতি মেনে নিলে এখন শিক্ষার ৫০ ভাগ ব্যয় শিক্ষার্থীর পরিবারকেই বহন করতে হতো। এর মাধ্যমে সর্বজনীন শিক্ষার সুযোগ বিনষ্ট হয়ে শেষ পর্যন্ত বিশেষ শ্রেণীর হাতে তা আরো কুক্ষিগত হতো। বলতে গেলে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হতো দেশের সিংহভাগ মানুষ। এ ক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো সম্প্রতি শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে মাতৃভাষাকে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ মনে করা হলেও মজিদ খান মাতৃভাষার গুরুত্ব ম্লান করে দিয়ে ভাষার মাসেই প্রণয়ন করেছিলেন এক হটকারী শিক্ষানীতি। তাঁর প্রণীত শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক স্তর থেকে বাংলার সঙ্গে আরবি ও ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। বিষয়টি আমাদের ভাষা আন্দোলনের চেতনার পরিপন্থী হওয়ায় ভাষার মাসেই রয়েছে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলার এক গৌরবোজ্জ্বল অতীত।
বিশ্বায়নের যুগে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের হাত থেকে আর কিছুকে রক্ষা করা যাক না যাক ১৪ ফেব্রুয়ারির স্মৃতিচারণাটা প্রজন্মের স্বার্থেই জরুরি ছিল। কিন্তু গত শতকের শেষ দশকে এসে ভালোবাসা দিবসের আমদানি ও তার সফল বাজারজাতকরণ সবাইকে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসের নাম ভুলিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। আজ খুব সামান্যই প্রচারে আসে দিবসটির কথা। তবে একটা বিষয় মনে রাখা সবচেয়ে জরুরি- ভাষা ও ভালোবাসা এ দুটি বিষয়ই সহজাত। কিন্তু করপোরেট যুগের বেনিয়ারা এ দুটো সহজাত বিষয় নিয়ে তাদের পুঁজি সম্প্রসারণ করে যাচ্ছে নিরন্তর। এ ক্ষেত্রে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস নিয়ে অনুষ্ঠান আয়োজন করলে ব্যবসার সুযোগ কম; তাই তাদের আগ্রহ ভালোবাসা দিবসে। স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস আয়োজনে রাস্তার মোড়ে মোড়ে ফুলে তোড়া, অনলাইন শপিং বুথ থেকে পশমী ভল্লুক কিংবা গিফট বক্স বিক্রির সুযোগ কম, তাই এ দিবস নিয়ে আলোচনা কম। তাই নিজ দেশে প্রজন্মের শিক্ষাজীবন সহজ ও সুন্দর করতে মাত্র কয়েক দশক আগে জীবন দেওয়া জয়নাল দিপালীদের নাম ভুলে গেছে প্রজন্ম। অন্যদিকে যুদ্ধবাজ রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস খ্রিস্টের জন্মের মাত্র কয়েক শতক পরে যে দুর্ঘটনা ঘটিয়েছিল তা নিয়ে এত মাতামাতি।
২৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমান তরুণদের যুদ্ধে মনোযোগী করতে ক্লডিয়াস সব ধরনের বিয়ে ও বাগদানকে বেআইনি ঘোষণা করে যে গর্হিত নজির দাঁড় করায় তার বিরুদ্ধে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের প্রতিবাদ সত্যিই সম্মানের চোখে দেখতে হবে। অন্যদিকে নিপীড়নমূলক আইনের বিরুদ্ধে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের প্রতিবাদ যেমন ছিল স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রাম তেমনি আমাদের স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামের উদ্দেশ্যও অনেকটা এক। এ ক্ষেত্রে সময় ব্যবধানে এক আন্দোলন ছিল সহজাত প্রবৃত্তিকে প্রতিষ্ঠার, অন্য আন্দোলন মৌলিক অধিকার সংহত করার। তাই একটা আন্দোলনকে অন্যটির আড়ালে চাপা দেওয়া কিংবা একটির ওপর অন্যটিকে আরোপিত না করে উদযাপন চলুক না পাশাপাশি। অন্তত স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস এবং ভ্যালেন্টাইনস ডে হিসেবে নতুন আয়োজনে ১৪ ফ্রেব্র“য়ারি যদি তরুণদের সামনের পথচলা মসৃণ করতে পারে তাতে দোষ কি?
লেখক : পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।